দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসব সাগরদাঁড়ীর মধুমেলা।
আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হলো মেলা। বাংলাসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মোৎসবকে ঘিরে এ মেলার আয়োজন হয়। এ বছর মহাকবির ২০১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী এ মেলা।
জানা যায়, ১৯১৯ সালে মধুসূদন দত্তের জীবনীগ্রন্থের লেখক নগেন্দ্রনাথ সোম তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সাগরদাঁড়ী এসে মধুসূদনের জন্মোৎসব উদযাপন করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘মধু-স্মৃতি’র ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মধুসূদনের জন্মতিথির উৎসব উপলক্ষে আমি বাঙ্গালা ১৩২৬ সনের ১২ মাঘ (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁহার জন্মভূমি সাগরদাঁড়ী গ্রামে অবস্থিতি করিয়াছিলাম।’ তখন থেকেই সাগরদাঁড়ীতে শুরু হয়েছিল মধুসূদন স্মরণানুষ্ঠানের।
শুরু থেকে এই জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের জন্য সর্বস্তরের জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত হতো ‘মধুসূদন জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি’। তারাই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তখন বলা হতো ‘মধুসূদন জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান’ বা ‘মধুজয়ন্তী’। ১৯৭৩ সালের ২৫ জানুয়ারি সাগরদাঁড়ীতে দুই বাংলার খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের মিলনমেলায় তৎকালীন তথ্য ও বেতারমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন উপস্থিত পল্লিকবি জসীম উদ্দীন তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘মধুসূদন স্মরণোৎসব’। এর আগে থেকে এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে তা পরিচিতি পায় ‘মাইকেল উৎসব’ নামে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) মধুসূদন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শুরু করে। তারাই এটিকে ‘মধুমেলা’ নামকরণ করে।
১৯৯৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস মধুমেলার উদ্বোধন করেন। ওই বছর থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ মেলার পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। ২০০১ সাল থেকে এর আয়োজন করা হয় ‘যশোর জেলা প্রশাসন’ থেকে।
এ বছর সাত দিনব্যাপী ‘মধুমেলা’য় ছিল মহাকবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক পরিবেশনা। মেলাঙ্গনে ছিল যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ, জাদু প্রদর্শনী, মৃত্যুকূপ, নাগরদোলাসহ বিভিন্ন আয়োজন। ১৯৯৪ সাল থেকে মেলাঙ্গনের এক অংশে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আয়োজনে থাকে কৃষিমেলা। এলাকার কৃষকরা সারাবছর তাদের উৎপাদিত সেরা পণ্য নিয়ে মধুমেলার অপেক্ষায় থাকেন। এ ছাড়া কুটিরশিল্পসহ গ্রামীণ পণ্যের পসরা বসে মধুমেলায়।
সাতক্ষীরা থেকে মা-বাবার সঙ্গে মধুমেলা দেখতে আসা শিক্ষার্থী তাহসিনা ফারিয়া জানায়, ‘এবারই প্রথম মধুমেলায় এসেছি। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে বইয়ে পড়েছি। এখানে এসে মধুসূদনের বসতভিটা, মধুপল্লি, কপোতাক্ষ নদসহ মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে অনেক মজা পেয়েছি।’
কেশবপুর উপজেলার কলাগাছি গ্রামের ইসরাফিল হোসেন বলেন, ‘এবারের মধুমেলায় ব্যতিক্রম ছিল কৃষিমেলা। সেখানে থাকা বিভিন্ন কৃষিপণ্য দেখে ভালো লেগেছে। বলা যেতে পারে, মেলার ভেতর আরেক মেলা।’
মা-বাবার সঙ্গে যশোর থেকে মধুমেলা দেখতে আসা শিক্ষার্থী আবির বিন হেলাল জানায়, ‘মেলায় এবারই প্রথম এসেছি। কৃষিমেলায় এসে ২৫ কেজি ওজনের মিষ্টিকুমড়া ও ছয় ফুট উচ্চতার ৩৭ কেজি ওজনের মানকচু দেখে ভালো লেগেছে। এ ছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্যও পছন্দ হয়েছে।’
সাগরদাঁড়ী মধুসূদন একাডেমির পরিচালক মধুসূদন গবেষক ও কবি খসরু পারভেজ বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ উৎসব মধুমেলা। কালে কালে মধুসূদন স্মরণোৎসব বাংলাদেশের একটি বড় লোকমেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। যশোরবাসীর কাছে, কেশবপুরবাসীর কাছে, সাগরদাঁড়ীবাসীর কাছে অনেক বেশি উচ্ছ্বাস ও আনন্দের মেলা। এ মেলার মধ্য দিয়ে যেমন আমাদের সংস্কৃতির বিকাশের সুযোগ ঘটে, তেমনি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে মধুসূদনের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে জানা-বোঝার সুযোগ ঘটে।’
সাগরদাঁড়ীর পোস্টমাস্টার মুফতি তাহেরুজ্জামান তাছু বলেন, ‘মধুমেলা উপভোগ করার জন্য শুরুতেই সাগরদাঁড়ী এলাকাসহ চারপাশের গ্রামে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করে। অনেকেই মেয়ে-জামাই, বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয়দের দাওয়াত দেন। আত্মীয়দের রসপিঠা খাওয়ানোর জন্য মেলার এক মাস আগে থেকে চালের গুঁড়া তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। মেলার সময় প্রতিটি বাড়িতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। মধুমেলায় কয়েক লাখ দর্শনার্থী ও মধুপ্রেমীর সমাগম ঘটে।’
মধুপল্লির কাস্টডিয়ান হাসানুজ্জামান বলেন, ‘মধুমেলা উপলক্ষে মধুপল্লি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। দর্শনার্থীরা মধুপল্লিতে কবির ভাস্কর্য, প্রসূতিস্থল, কাছারিবাড়ি, স্মৃতিবিজড়িত আসবাব ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখতে পারছেন।’
কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মধুমেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক শবপ র র জন ম ন র জন র জন য স গরদ
এছাড়াও পড়ুন:
বকুলতলায় বৃষ্টির সুর
নীল-সাদা পোশাকে সজ্জিত হয়ে নানা বয়সী মানুষ এসে জড়ো হতে থাকেন। যেন শহরের হৃদয়ে নেমে আসে গ্রামবাংলার ঘ্রাণ। মেঘলা আকাশের নিচে কণ্ঠে সুর, পায়ে তাল, কল্পনায় বর্ষার রূপই দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় গতকাল রোববার এভাবে উদযাপন হলো ‘বর্ষা উৎসব ১৪৩২’।
বর্ষা উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে আষাঢ়ের প্রথম দিনে রাগ, রস ও রং মিলে তৈরি হলো এক বর্ষামুখর ক্যানভাস। এবারের আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন নবীন সংগীতশিল্পী সোহানী মজুমদার। সেতারের কোমল তারে বেজে ওঠে রাগ ‘আহীর ভৈরব’। রাগভিত্তিক এ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে মিলে যায় প্রাচ্যের সংগীত ঐতিহ্য ও বর্ষার আধ্যাত্মিকতা। সেই মুহূর্তে বকুলতলায় যেন ভেসে বেড়ায় বৃষ্টির সুর আর আকাশের নরম আলো।
‘বর্ষাকথন’ পর্বে বর্ষার ভাবনা, পরিবেশ ও সময়ের প্রেক্ষাপটে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি শিল্পী কাজী মিজানুর রহমান।
ঘোষণা পাঠ করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট এবং সভাপতিত্ব করেন লেখক ও গবেষক অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরী। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী নুসরাত ইয়াসমিন রুম্পা।
ঘোষণাপত্র পাঠে জানানো হয়, ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে আজ ঋতুচক্রে দেখা দিচ্ছে অসামঞ্জস্য। গ্রীষ্ম হয়ে উঠছে খরতর, বর্ষা রুষ্ট, বসন্ত ক্ষীয়মাণ। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে মানুষের সীমাহীন ভোগবাদী আচরণ, প্রকৃতির ওপর অনবরত অনাচার। ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত, সমুদ্রজল স্ফীত, ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত– প্রকৃতি আজ সংকটে।
এ প্রসঙ্গে মানজার চৌধুরী সুইট সমকালকে বলেন, এ উৎসব শহুরে জীবনে আমরা প্রায় ১৮ বছর ধরে পালন করে আসছি। উৎসবের শিকড় নিহিত রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল’-এ। আমরা তারই উত্তরসূরি হয়ে আষাঢ়ের প্রথম দিনটিকে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিই। এতে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং তার সংকটও তুলে ধরা হয়। আমরা চাই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক
গড়ুক, তার বিপন্নতাকে বুঝুক এবং তা রক্ষায় সক্রিয় হোক।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ ধরনের উৎসবই সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ। শিকড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার মধ্যে নিহিত আমাদের সংস্কৃতি ও চেতনার পুনর্জাগরণ।
বর্ষা মানে নতুন জন্মের বারতা। সেই বারতা ছড়িয়ে দিতে উৎসবে প্রতীকীভাবে শিশু-কিশোরের হাতে তুলে দেওয়া হয় বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা। এই চারাগুলো শুধু বৃক্ষ নয়, বরং হয়ে উঠেছে সবুজ ভবিষ্যতের আশ্বাস।
উৎসবে একক সংগীত পরিবেশন করেন ইয়াসমিন মুশতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী ও নবনীতা জাইদ চৌধুরী অনন্যা।
রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন অণিমা রায়, শামা রহমান, মকবুল হোসেন ও ফেরদৌসী কাকলি। লোকসংগীত পরিবেশন করেন বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, শ্রাবণী গুহ রায় ও এস এম মেজবাহ। আধুনিক গান গাইতে মঞ্চে ওঠেন রত্না সরকার।
দলীয় সংগীতে অংশ নেয় সীমান্ত খেলাঘর আসর (শিশু-কিশোর), সুর বিহার, বহ্নিশিখা, সুর নন্দন এবং সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলি ও আসান উল্লাহ তমাল। শিল্পবৃত্ত শিশু-কিশোর দল পরিবেশন করে আবৃত্তি ও নৃত্য কোলাজ।
নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নেয় ধৃতি নর্তনালয়, নৃত্যাক্ষ, স্পন্দন, বেমুকা ললিতকলা কেন্দ্র, সিনথিয়া একাডেমি অব আর্টস ও নৃত্যম।