হরতাল, অবরোধসহ বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি নানাভাবেই মাঠে নামার চেষ্টা করছে; কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পথে বড় বাধা তাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগ। গত ১৫ বছরে গুম, খুন ও দমন নির্যাতনের অভিযোগ তো আছেই। হাজারো মানুষের রক্তে আওয়ামী লীগের হাত রঞ্জিত। এই রক্তমাখা হাত নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসা সম্ভব? সমসাময়িক ইতিহাস বলে, সম্ভব না।

উদাহরণ খোঁজার জন্য সুদূর অতীতে ফিরে যেতে হবে না। এই তো কয়েকদিন আগে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের বাথ পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বার্থ পার্টির বিরুদ্ধেও নিজ দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। বাশার আল-আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ায় গোপন জেলখানার সন্ধান মিলেছে, বাংলাদেশের আয়নাঘরের মতো। যেখানে আসাদবিরোধীদের ধরে নিয়ে আটকে রাখা হতো। চালানো হতো নির্মম নির্যাতন।

আমাদের দেশেও আওয়ামী লীগ একই কায়দায় বিরোধী মত দমনে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে। দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল দলটি। নিরীহ, নিরস্ত্র নাগরিকের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কৃত অপরাধের কারণে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে বিবেচনা করলে দলটির মধ্যে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলি আর অবশিষ্ট নেই।

জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অনুতাপও নেই। বরং বলার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। গণহত্যার দায় নিয়ে পালিয়ে থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে বরং নিরীহ কর্মীদের জনরোষের সামনে ঠেলে দিচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।

আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হতে পারে– এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। গণহত্যাকারী দলগুলোর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তাদের বিচার কীভাবে হয়েছে, তা বিবেচনা করতে হবে।

গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গত শতকেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বেশ কিছু নজির আছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি বলা হয় জার্মানির ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পাটি বা নাৎসি পার্টির নাম। এই দলটিও বেশ জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি পার্টি হলোকাস্টে অংশ নেয়। প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি ও লাখ লাখ অন্যান্য সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর, ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৫-৪৬ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে পার্টির শীর্ষ নেতাদের বিচার এবং দলটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, তুরস্ক, ইরাক, সার্বিয়া, স্পেন, ইন্দোনেশিয়া, নিকারাগুয়ায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইতিহাসের ঘটনাবলি বিশ্লেষণে বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ উদ্যোগে গণহত্যাকারী দল নিষিদ্ধ হয়েছে। এদের যদি রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়া হতো, ফ্যাসিবাদী শাসনে নিহত মানুষগুলোর সঙ্গে সরাসরি বেইমানি হতো। কারণ মানুষগুলো গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী পরাজিত হলে, গণতন্ত্র ফিরে এলে গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না। নিরীহ মানুষের রক্ত হাতে নিয়ে অপরাধী দল রাজনীতিতে ফিরতে পারে না। পারা উচিতও না।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস বিভাগ জানিয়েছে, অনুমতি দেওয়া হবে না। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে কর্মসূচি আটকাবে সরকার। কারণ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে দল হিসেবে বিচারের কাজ শুরু হয়নি। বরং মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিক দলের বিচারের সুযোগ বাদ দেওয়া হয়েছে।

দেশে সংস্কার নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে। খোলনলচে বদলে ফেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আসল সংস্কার হচ্ছে আওয়ামী লীগকে গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা। এটাই হবে রাজনীতির সংস্কার। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না– এটি প্রমাণ করতে পারলেই দেশের সবচেয়ে বড় সংস্কার করা হবে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। যে সংগঠনের মাধ্যমে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বিচারও করতে হবে। এখানে কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা উদ্দেশ্য নিয়ে গণহত্যায় অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের নামে ও আদর্শে সমবেত হয়ে হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছে। তাই গণহত্যার দায়ে যেমন ব্যক্তির বিচার করতে হবে, তেমনি দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও বিচার করতে হবে।

আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বলা হয়, দল হিসেবে নিষিদ্ধ করলেও দলটির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সমর্থক কই যাবে। তারা আবার ফিরে আসবে। তাই আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এসব খোঁড়া যুক্তি। ওপরে বর্ণিত দেশগুলো গণহত্যাকারীদের আইনগত ও রাজনৈতিক উভয়ভাবেই মোকাবিলা করেছে। গণহত্যাকারী দলগুলোকে আইনিভাবে বিচারের মুখোমুখি করার পরই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে।

বিচারের মাধ্যমে দলকে অপরাধের সাজা দেওয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে অপরাধের সাজা দেওয়া সম্ভব না। রাজনৈতিকভাবে আদর্শের মোকাবিলা করা হয়। জার্মানিতে ডিনাজিফিকেশনের মাধ্যমে নাৎসি পার্টির রাজনীতিকে মোকাবিলা করা হয়েছে। নাৎসি অভিবাদন, স্যালুট, প্রতীক, গান ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

শহীদরা জীবন দিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে। এবার আমাদের দায় শোধের পালা। আওয়ামী লীগ নেতাদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি দলটির বিচার ও নিষিদ্ধ করে সেই দায় শোধ করতে হবে। ডিআওয়ামীফিকেশনের উদ্যোগ নিতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি, প্রতীক, গানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারি তাহলে জুলাই, আগস্টে শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে।

আমরা যদি ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করি, ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দিই, তবে ইতিহাসের দায়বোধ আমাদের মুক্তি দেবে না। বরং এই গণহত্যার দায় আমাদের কাঁধেও কিছুটা আসবে বৈকি। কারণ আমরাই জনসাধারণকে মিছিলে যেতে উৎসাহিত করেছিলাম। আমাদের কথাতেই অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন জুলাই-আগস্টের শহীদরা।

ড.

মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আওয় ম ল গ গণহত য ক র ন ষ দ ধ কর গণহত য র র জন ত ত র র জন ত আম দ র অপর ধ আগস ট আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স। 

গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’

পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।

আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’ 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’

তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের ‘কঠোরতম ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব
  • যারা জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ চায়, তারা আদালতে অভিযোগ দিতে পারে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
  • ‘গাজায় গণহত্যা চলছে, আমি সেই গণহত্যার নিন্দা করছি’