মুদ্রানীতিতে মোটা দাগে সুদহার ও মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, তা রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সুদহার অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। কেননা, সুদহার কমলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। ডলারের দর ১২২ টাকা রাখার যে সিদ্ধান্ত, তা সঠিক নয়। ডলারের জোগান কমলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। আরেকটি বিষয়, আইএমএফ কর্মসূচি থেকে সরে গেলে সবার কাছে নেতিবাচক বার্তায় খরচ বাড়বে ব্যবসায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। নীতি সুদহার পরিবর্তন করা হয় মূলত মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতিতে একটি মিশ্র চিত্র দেখা যাচ্ছে, যেখানে নীতি সুদহার পরিবর্তনের মতো কোনো সংকেত নেই। নীতি সুদহার কমালে অবশ্য ব্যবসায়ীরা খুশি হতেন। তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতো। আবার সুদহার কমলেই বিনিয়োগ বাড়বে, এটি এরই মধ্যে ভুল প্রমাণিত। দীর্ঘদিন ৯ শতাংশে আটকে রেখেও বিনিয়োগ বাড়েনি। এটা ঠিক, সুদহার কমলে ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ কমবে। তাতে তাদের মুনাফা বাড়বে। সাধারণ মানুষ কোনো সুফল পাবে না। কারণ, ব্যবসায়ীরা বেশি দামেই পণ্য বিক্রি করবেন। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনও কমেনি। এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার মূলে মৌসুম। ফলে এখনই সুদহার কমানোর সময় আসেনি। সুদহারের কারণে বিনিয়োগ বেড়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয় বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মেলে না।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর মাধ্যমে। বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে ঋণের জোগান না বাড়িয়েও বেসরকারি খাতের জন্য একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার কমেছে। আবার স্বল্পমেয়াদি বন্ডের সুদহার দীর্ঘমেয়াদির তুলনায় বেশি। এ থেকে বার্তা পাওয়া যায়, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা কমেছে। ব্যাংকাররা এতদিন মনে করছিলেন, সরকারি খাতে বেশি সুদ পেলে বেসরকারি খাতে কেন ঋণ দেবেন? এখন সেই ধারণায় পরিবর্তন আসবে, সামগ্রিকভাবে যা ইতিবাচক।

অন্যদিকে, মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে যে অবস্থান, তা ঘোষিত নীতির সঙ্গে একেবারে অসংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক টেলিফোনে কিংবা অন্য উপায়ে ১২২ টাকার ওপরে ডলার না কেনার অদৃশ্য করিডোর দিয়েছে। ডলারের দর বাড়লে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির যে যুক্তি, তা আগের সুরের পুনরাবৃত্তি। মনে রাখতে হবে, ডলারের জোগান কমে গেলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়বে। আমদানি ব্যাহত হলে প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়বে। গ্রীষ্মকাল আসছে, বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে। তেল-গ্যাসের আমদানি বাড়বে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে লোডশেডিংয়ে মানুষ ক্ষেপে যাবে।

২০২২ সালে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর কম রাখা হয়েছিল। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি হুহু করে তখন বেড়েছিল। তাছাড়া বড় বড় এক্সচেঞ্জ হাউস ডলারের দর নির্ধারণে কারসাজির যে কথা বলা হচ্ছে, তা ঘটলে আন্তর্জাতিক রেগুলেটরের কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরা শুধু বাংলাদেশে ব্যবসা করে না। তারা কারসাজির ক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশকে কেন বেছে নেবে? দ্বিতীয়ত, ডলারের দর নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে কোনো কারণে আইএমএফের কর্মসূচি আটকে গেলে, বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু অর্থ ছাড়ের অঙ্ক দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। মনে হতে পারে, তাদের এক কিস্তি তো আমাদের ১৫ দিনের রেমিট্যান্সের তুলনায় কম। সেটি ইস্যু না। বরং আইএমএফের নীতির সঙ্গে দ্বিমতে অর্থ ছাড় আটকে গেলে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থার রেটিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এলসি কনফারমেশন বা অন্য গ্যারান্টির চার্জেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অবশ্য আইএমএফের সব কথা শুনতে হবে, তেমন না। সাংঘর্ষিক অবস্থানের পরিবর্তে যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে।

লেখক : সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস য় র বর ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ

২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।

আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।

পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।

সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে
  • আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
  • ট্রাম্প ও আইএমএফ—এই দুই পায়ের ওপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট: আনু মুহাম্মদ