জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমাইতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেইভাবে সরাসরি বল প্রয়োগের নির্দেশ দিয়াছিলেন, উহা ছিল নজিরবিহীন। তাঁহার ক্ষমতা টিকাইবার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নির্দেশ প্রতিপালনের পরিণতিতেই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটে; যেইগুলি ইতোমধ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত।
মঙ্গলবার প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও উহার স্বীকৃতি মিলিবার বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া আমরা মনে করি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে স্পষ্ট– বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মারণাস্ত্র দিয়া গুলি চালানো, গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, চিকিৎসাপ্রাপ্তির অধিকার কাড়িয়া লইবার ন্যায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করিয়াছে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাতিসংঘ সংগত কারণেই ইহাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলিয়াছে।
বস্তুত গত বৎসরের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার শুরু হইতেই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুসন্ধানের দাবি উঠিয়াছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল আসিয়া তদনুযায়ী অনুসন্ধান করে এবং ছয় মাস পর হইলেও সংস্থাটি যেই প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়াছে, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা, তৎসহিত তাঁহার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে আসাদুজ্জামান খান কামালকেও দায়ী করা হইয়াছে। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী লইয়া জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্মরণে রহিয়াছে, আওয়ামী লীগের সময়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল যুক্তরাষ্ট্র। এতদ্ব্যতীত পুলিশ যেইভাবে বিগত সরকারের ‘দলীয়’ বাহিনীর ন্যায় বিরোধীদের দমন এবং জুলাই-আগস্টে যেইরূপে বল প্রয়োগ করিয়াছিল, তাহার পরিণতিতেই সংস্থাটির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেককে গা-ঢাকা দিতে হইয়াছে। র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর আচরণের কতটা পরিবর্তন হইয়াছে, উহাও প্রশ্নসাপেক্ষ। যদিও সরকার তাহাদের সংস্কারে কমিশন গঠন করিয়াছে এবং ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু জাতিসংঘ ইহাও উল্লেখ করিয়াছে, পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হইলেও কেবল পুলিশের ব্যাপারেই অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা লইয়াছে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনেই চৌদ্দশত মানুষ নিহত হইবার বিষয়টি আসিয়াছে; যথায় তাহারা উল্লেখ করিয়াছে, অধিকাংশই বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাইয়াছে। এমনকি শিশুরাও তাহাদের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পায় নাই; আন্দোলনের প্রারম্ভে নারীরা আক্রান্ত হইবার বিষয়েও জাতিসংঘের প্রতিবেদন তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ আমলে লইয়া মানবতাবিরোধী এই সকল অপরাধের বিচার জরুরি হইলেও সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নহে বলিয়াই প্রতীয়মান। বিশেষত তাহাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর যেইভাবে গড়পড়তা মামলা হইয়াছিল, উহাতে যদ্রূপ নিরপরাধ মানুষের হয়রানির উপলক্ষ রহিয়াছে, তদ্রূপ অপরাধীর পার পাইবার শঙ্কাও তৈয়ার হইয়াছে। বিশেষ করিয়া জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যাহারা শহীদ এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন, তাহাদের ন্যায়বিচারের স্বার্থেই অপরাধীদের বিচার করিতে হইবে।
অধিকতর উদ্বেগের বিষয়, জাতিসংঘ প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, সরকারের পরিবর্তন হইলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তৎসহিত নিয়মিত আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহিত জড়িত বিগত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করিবার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হইলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকারের এই সকল প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হইবার যেই আশঙ্কা জাতিসংঘ করিয়াছে, উহা অমূলক নহে।
আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি যদ্রূপ বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পথপ্রদর্শক হইবে, তদ্রূপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শিক্ষা গ্রহণ করিবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই আগস ট সরক র র কর য় ছ অপর ধ হইয় ছ হইল ও
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।