১৪০ কোটি জনসংখ্যার ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের তকমা পেলেও তাদের প্রায় ১০০ কোটি মানুষেরই পছন্দসই পণ্য কেনা বা সেবা গ্রহণের মতো পর্যাপ্ত অর্থের অভাব রয়েছে, যা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

উদ্যোগ মূলধন নিয়ে কাজ করা ‘ব্লুম ভেঞ্চার’ ভারতে সমীক্ষার ভিত্তিতে ‘ইন্ডাস ভ্যালি অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০২৫’ নামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ২৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১১ সালে মুম্বাইয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

বিবিসি লিখেছে, প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের ভোক্তা শ্রেণির আকার কার্যকরভাবে বলতে গেলে স্টার্ট-আপ বা ব্যবসার মালিকদের জন্য মেক্সিকোর মতো অর্থাৎ মাত্র ১৩ থেকে ১৪ কোটি মানুষের বাজার। যেখানে ৩০ কোটি মানুষ ‘উদীয়মান’ বা ‘আকাঙ্ক্ষী’ ভোক্তা। তবে তারা ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করতে পারেন না; তারা কেবল তাদের মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করা শুরু করেছেন; তা ছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম লেনদেন সহজ করায় তারা কিছু খরচে ঝুঁকেছেন।

ইন্ডাস ভ্যালি অ্যানুয়াল প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতে ভোক্তা শ্রেণি যতটা ‘গভীর হচ্ছে’ ততটা ‘প্রসারিত’ হচ্ছে না। এর অর্থ হলো ভারতের ধনী জনসংখ্যা সত্যিই সংখ্যায় বাড়ছে না; যদিও যারা ইতোমধ্যে ধনী, তারা আরো ধনী হচ্ছে।

এসব বিষয় ভারতের ভোক্তা বাজারকে একটি স্বতন্ত্র রূপ দিচ্ছে, বিশেষ করে ‘উচ্চস্তরের ভোক্তাদের জন্য পণ্য’ ধারণাকে ত্বরান্বিত করছে; যেখানে ব্র্যান্ডগুলো সর্বজনীন বাজারের বদলে ধনীদের জন্য ব্যয়বহুল, আরো উন্নত পণ্যের প্রবাহ দ্বিগুণ করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

ভারতে এই প্রবণতা স্পষ্ট বোঝা যায় সর্বাধুনিক সুবিধার প্রাসাদোপম বাড়ি ও প্রিমিয়াম কোয়ালিটির মোবাইল ফোন বিক্রির পরিসংখ্যান থেকে। এমন কী উচ্চমানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরের পণ্য ও সেবা বিক্রির প্রতিযোগিতাতেও এই লড়াই দেখা যায়। সাশ্রয়ী মূল্যের মাঝারি মানের বাড়িগুলোর বাজার এখন এই খাতে ভারতের সামগ্রিক বাজারের মাত্র ১৮ শতাংশ, মাত্র পাঁচ বছর আগেও যা ছিল ৪০ শতাংশ।

ব্র্যান্ডেড পণ্যও ভারতের বাজারের একটি বড় অংশ দখল করছে। চলমান অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা বলছে, কোল্ডপ্লে এবং এড শিরানের মতো আন্তর্জাতিক শিল্পীদের কনসার্টের উচ্চমূল্যের টিকিটও মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে সেদেশে।

প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক সজিথ পাই বিবিসিকে বলেছেন, “যেসব কোম্পানি পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, তারা উন্নতি করেছে। যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাজারের দিকে খুব বেশি মনোযোগী অথবা তাদের এমন একটি মিশ্র পণ্য রয়েছে, যা উচ্চস্তরের শেষ ধাপের জনগণের দিকে মনোযোগী নয়; তারা মার্কেট শেয়ার হারিয়েছে।”

প্রতিবেদনে উঠে আসা ফলাফলে দীর্ঘদিনের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আরো শক্তিশালী হয়েছে যে, ভারতের কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা ইংরেজি অক্ষর ‘কে’ আকৃতি ধারণ করেছে; যেখানে ধনী আরো ধনী হয়েছে এবং দরিদ্রদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।

বিবিসি লিখেছে, আসলে ভারতে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত প্রবণতা, যা মহামারির আগেই বোঝা গিয়েছিল। ভারত ক্রমেই অসম আয়ের দেশ হয়ে উঠছে।  শীর্ষ ১০ শতাংশ ভারতীয়ের আয় এখন দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশের সমান; যা ১৯৯০ সালে ছিল ৩৪ শতাংশ। প্রান্তি জনগোষ্ঠীর আয় মোট জনসংখ্যার আয়ের ২২ দশমিক ২ থেকে নেমে ১৫ শতাংশে ঠেকেছে।

ভোক্তার ক্রম ক্ষমতার এই মন্দাভাব শুধু ক্রয়ক্ষমতা ধ্বংসেরই চিত্র নয়; আর্থিক সঞ্চয় এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার গভীরতাও বৃদ্ধি করেছে।

সজিথ পাই বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সহজে অনিরাপদ ঋণের ওপর কড়াকাড়ি আরোপ করেছে এবং কোভিড মহামারির পরে বাজারে অর্থের চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছে। এ ধরনের ঋণ বা ধার বন্ধ করায় ভারতের উদীয়মান ও আকাঙ্ক্ষী ভোক্তারার ক্রম ক্ষমতা কমিয়েছে বা তাতে প্রভাব ফেলেছে।

“স্বল্পসময়ের মধ্যে দুটি জিনিস ব্যয়ের সামর্থ বাড়াতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। রেকর্ড ফসল উৎপাদনের সঙ্গে গ্রামীণ চাহিদা বাড়ানো এবং সম্প্রতি ঘোষিত নতুন বাজেটে ১২ বিলিয়ন কর রেয়াত দেওয়া। এর ফল ‘নাটকীয়’ না হলেও ভারতের জিডিপি বাড়াতে পারে, যা হবে মূলত খরচ করার মাধ্যমে; অন্তত অর্ধেক নাগরিকের ক্ষেত্রে তা অর্জন করা যেতে পারে।

নাগরিকের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্স জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের ভোক্তা চাহিদার প্রধান ইঞ্জিন বলা হয়, দীর্ঘদিন তাদের মজুরি প্রায় একই থেকে গেছে।

"ভারতের কর-প্রদানকারী জনসংখ্যার মধ্যে ৫০ শতাংশ মধ্যবিত্ত, আদতে যাদের আয় গত এক দশকে স্থবির হয়ে রয়েছে। থমকে থাকা এমন আয়কে প্রকৃত অর্থে অর্ধেক আয় বোঝায়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির  সঙ্গে সামঞ্জস্য করলে প্রকৃত আয় বাড়ে না।”

মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, "আয় নিয়ে এমন নাজুক অবস্থা মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের ঘটি ধ্বংস করে ফেলেছে। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক বারবার বলেছে যে, ভারতীয় পরিবারগুলোর নিরেট সঞ্চয় ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে বোঝা যায়, ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারের ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত পণ্য ও সেবা সামনের বছরগুলোতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে পারে।”

“মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের শহরের চাকরিতে আসা কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন দাপ্তরিক, সাচিবিক ও অন্যান্য রুটিন কাজকর্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত করে ফেলতে সক্ষম,” বলা হয়েছে মার্সেলাসের প্রতিবেদনে।

"ভারতে উৎপাদন কারখানায় কাজ করা সুপারভাইজারের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।”

ভারত সরকারের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষাও এসব উদ্বেগকে চিহ্নিত করেছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে শ্রম বাস্তুচ্যুতি ভারতের মতো প্রধানত পরিষেবা-ভিত্তিক অর্থনীতির জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয়, যেখানে আইটি কর্মীবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপেক্ষাকৃত কম সেবা ও মূল্য উৎপাদনে যুক্ত। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা।

সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, "ভারত একটি ভোগ-ভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। এইভাবে তার কর্মশক্তির বিচ্যুতি ঘটলে তা ভোক্তার ক্রম-ক্ষমতার পতন ঘটাবে। ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে বাধ্য। যদি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আবির্ভূত হয় এবং অনুমানগুলো বাস্তব হতে থাকে; তাহলে তাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ স্লথ করে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।”

অন্যান্য ব্যবসায়ীসহ বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের ভারতে ব্যবসার পরিবেশ, চলতি ধরন ও প্রবণতা, ব্যবসার ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে গবেষণাবিভিত্তিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে ব্লুম ভেঞ্চার।  

 

 

 

 

ঢাকা/রাসেল 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জনস খ য র প রবণত র জন য ক ষমত ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। তবে এখন যে অস্থিরতা এ অঞ্চলে চলছে তা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতকে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

সাম্প্রতিক নেপালের সহিংস অস্থিরতা তারই উদাহরণ। শুধু নেপালের ঘটনা নয়। ভারতের পূর্বদিকে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল এবং তার জের ধরে সেখানে সরকার পতন হয়েছিল; সেই সংকটের মীমাংসা এখনও হয়নি।

অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়েছে ও সম্প্রতি কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্তে তাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।

আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি যোদ্ধারাও আছেন।

আরও পড়ুনভারত ও চীনের টানাটানিতে পড়েছে নেপাল৩১ জুলাই ২০২০

ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান এখনও অতীতের ‘ভূতদের’ সঙ্গে লড়াই করছে। উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, দুর্বল অর্থনীতি আর অকার্যকর শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানকে অস্থির করে রেখেছে। ভারতের দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা তিন বছর আগে প্রেসিডেন্টকে সরানোর পর আপাত শান্ত হয়েছে। কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর উত্তরে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাও এই অস্থিরতার বড় কারণ হয়ে আছে।

ভারতের জন্য এসব সংকট মোটেও দূরের কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যেই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে অস্বস্তি তৈরি করছে। পাকিস্তানের সীমান্তপারের সন্ত্রাসের হুমকি এ গ্রীষ্মে কাশ্মীরে প্রায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছিল। আর এখন নেপালের অস্থির রাজনীতি চীনের জন্য নতুন করে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। এত বড় এক অস্থিরতার বলয়কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

এখন কীভাবে এই ধাক্কাগুলো সামলানো যায় এবং কীভাবে গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা যায়, সেটিই ভারতের নেতৃত্বের সামনে মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।

নেপাল দিয়েই শুরু করা যাক। দেশটি দুই দশক আগে দীর্ঘ মাওবাদী বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে যে উচ্চাভিলাষী সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তা টিকিয়ে রাখতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, বিতর্কিত ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। পক্ষপাত, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে স্থিতিশীলতার আশা বারবার ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি যেসব ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছে, তা আসলে এই গভীর অস্থিরতার লক্ষণ।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে, তারা আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বা মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প ছিল, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া শুল্কনীতির কারণে সেটিও এখন টালমাটাল।

আরও পড়ুনভারত ‘তুমি রিয়েলিটি মাইন্যে ন্যাও’০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।

এই অঞ্চলের যে কোনো অশান্তি সেই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে। তাছাড়া থাইল্যান্ড বহুদিন ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। যদি এর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় কিংবা বা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের শান্তি-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কম্বোডিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের বিরোধ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডরের স্বপ্নই ভেঙে পড়তে পারে।

পাকিস্তানকে ‘চিরকালীন সংকটে থাকা দেশ’ বলা হয়তো কঠিন শোনায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটিই বাস্তবতা। সেখানে বারবার বেসামরিক সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে। যেমন, ২০২২ সালে ইমরান খানের নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর ইশারায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। রাজনীতি রক্তক্ষয়ী খেলায় পরিণত হলে চরমপন্থীরা মাথা তোলে, আর নাজুক অর্থনীতি সেই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে সেটিই দেখা গেছে।

আরও পড়ুননেপালের গণ–অভ্যুত্থান ভারতের মাথাব্যথা বাড়াল১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারতের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের এই সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়। এগুলো প্রায়ই কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাস ছড়ায়, আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট করে, এমনকি পারমাণবিক সংঘাতের শঙ্কাও তৈরি করে। ভারত যখন বাইরের দিকে তাকাতে চায়, এই স্থায়ী অস্থিতিশীলতা তখন ভারতকে উপমহাদেশের দাবার ছকে আটকে রাখে। এর সঙ্গে পাকিস্তান-চীন জোট মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি নিকট ভবিষ্যতে বদলানোর সম্ভাবনা কম।

এসব ঘটনা মিলিয়ে যে বড় প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে, তা হলো: ভারতের চারপাশে গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংবিধান বারবার বদলানো হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আদালতকে ব্যবহার হচ্ছে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক সেনাপ্রধান রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদের কখনো কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, কখনো নির্বাসনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের জন্য এ প্রবণতা মোকাবিলা করা জরুরি। আর এখন আরও দৃঢ় আঞ্চলিক কৌশল ছাড়া উপায় নেই। বাস্তবে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে সংকট দেখা দিলে ভারতই প্রথম ভরসা। তবে যখন কোনো দেশ মনে করে তাদের ভারতের সাহায্য দরকার নেই, তখন তারা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকেও গুরুত্ব দেয় না।

আরও পড়ুননেপালের অভ্যুত্থান নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে মিথ্যা বয়ান হাজির করছে১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারতের চারপাশের অশান্ত পরিস্থিতিই যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও অনিশ্চয়তা যোগ করছে। ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি এতটাই খামখেয়ালি যে, ছোট দেশগুলো এখন নিরাপদ থাকতে বিকল্প পথ খুঁজছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পর্যন্ত প্রশ্ন উঠছে—চীন যখন শক্তি প্রদর্শন করছে আর মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন কি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটা উচিত না?

ভারত যদিও এ ঝড়ের মুখে দৃঢ় থেকেছে, তবুও আঞ্চলিক টানাপোড়েন আর ট্রাম্পসৃষ্ট অস্থিরতা ভারতের বহুদিনের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলছে। এখন ভারতের কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা নয়, বরং সম্পর্কের কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি ধরে রাখা। পাশাপাশি আচমকা মার্কিন নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়াও দরকার।

ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য চায় না। তার লক্ষ্য হলো এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও সংযুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা যেখানে অতীতের বারবারের সংকট সরে যাবে এবং সে জায়গায় ভবিষ্যতের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

নিরুপমা রাও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে