উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ
Published: 27th, February 2025 GMT
পৃথিবীর বহু দেশ ভাষিক সাম্রাজ্যের কবলে পড়েছে। এতে জাতীয় আদর্শ পরিপন্থি আদর্শ অনুসরণ করে দেশগুলো নিজেদের ভাষানীতি প্রণয়ন করছে। এই বাস্তবতা থেকে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ ধারণার জন্ম। ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ হলো প্রভাবশালী দেশের কোনো ভাষা কোনো অনুবর্তী দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াসবিশেষ।
সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক অনুবর্তী দেশের জনগণের চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে উৎসারিত। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যম ভাষিক সাম্রাজ্যবাদিতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ইউরোপীয় দেশগুলোর এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সাবেক উপনিবেশগুলোয় তাদের ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রচলনের যে বাস্তবতা, তা মূলত ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ। সমসাময়িককালে আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ভাষিক সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষাগুলোকে বিশ্বায়নের ভাষা হিসেবে প্রচলনে তৎপর।
বিশ্বজুড়ে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের বাস্তবতা হলো এই, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত দেশ যেমন– কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, পাপুয়া নিউগিনি ও ভারত; সাবেক ফরাসি উপনিবেশভুক্ত দেশ যেমন– ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট, মাদাগাস্কার, হাইতি, সেনেগাল, বুরকিনা ফাসো, বেনিন ও গিনি, সাবেক স্পেনীয় উপনিবেশভুক্ত দেশ যেমন– ইকুয়েডর, কিউবা, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, বলিভিয়া, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া এবং সাবেক আরব উপনিবেশভুক্ত দেশ যেমন– সুদান, চাদ ইত্যাদি দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেসব দেশের জাতীয় আদর্শ পরিপন্থি ভাষিক আদর্শ অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব দেশ সেখানে বিরাজিত বহুভাষিকতার বাস্তবতার কারণে জাতীয় আদর্শ পরিপন্থি ভাষিক আদর্শ অনুসরণে বাধ্য হচ্ছে। এসব সাবেক ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও স্পেনের উপনিবেশভুক্ত দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের দেশে কথিত ভাষার চেয়েও যথাক্রমে ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষাকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাকরণে সচেষ্ট। তারা বহুভাষিকতা সমাজভাষিক আদর্শকে পাশ কাটিয়ে যথাক্রমে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষাকে আত্তীকরণের নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে এবং এসব ভাষার দেশীয়করণ ত্বরান্বিত করতে গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে। এসব দেশ আন্তর্জাতিকতাবাদ ভাষিক আদর্শের মুলা ঝুলিয়ে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এ চারটি ভাষা ব্যাপকভাবে সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই এসব দেশে ভাষিক আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ– এ তিন ভাষিক আদর্শই যুগপৎভাবে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষা প্রচলনে সহায়ক সমাজ ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ হিসেবে কার্যকর।
সাবেক ব্রিটিশ, ফরাসি ও স্পেনীয় উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে, সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ হিসেবে প্রাপ্ত ভাষাকে ব্যবহার না করেও অগণতান্ত্রিক ভাষা রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করছে। তার মধ্যে অন্যতম ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ হলো ডাচ্ ভাষা। কিন্তু এ দেশটি ডাচ্ বা ইংরেজি ভাষাকে আত্তীকরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে, মালয় উপদ্বীপের ভাষাকে দেশীয়করণে সচেষ্ট। অন্যদিকে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ ব্রিটিশ ভারত থেকে সৃষ্ট দেশ ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ ইংরেজি এবং রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির ভাষা যেমন হিন্দি ও উর্দু– এই দুটি ভাষাকেই যুগপৎ আত্তীকরণের নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।
হিন্দু ও ইসলাম ধর্মীয় আদর্শগত বিভেদজনিত কারণে উদ্ভূত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি বহুভাষিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। নতুন সৃষ্ট এ দুটি রাষ্ট্রে বহু ভাষা থাকার কারণে দুটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথাক্রমে হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে কেন্দ্র করে বহুভাষী জনগোষ্ঠীকে একীভূত করতে প্রয়াসী হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই দু’দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের দেশে যথাক্রমে হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে প্রবর্তনের প্রয়াস চালায়। এ ব্যাপারে ভারত হিন্দি ভাষা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন ও ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তি প্রথম থেকেই উর্দু ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বাংলা ভাষার অধিকার আন্দোলনের স্ফুরণ ঘটে। বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আর মূল পাকিস্তানে রয়ে যায় অফুরন্ত ভাষিক সমস্যা। এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের নেতৃত্ব উর্দু ও ইংরেজি ভাষাকে সে দেশের জাতীয় ও এজমালি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যীয় ইন্ডিয়ার নেতৃত্ব ইংরেজি ভাষাকে যুক্তরাজ্যীয় দাপ্তরিক ভাষা এবং হিন্দি ভাষাকে ঐচ্ছিক যুক্তরাজ্যীয় ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে ভারত হিন্দি ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
যেহেতু এসব বহুভাষী দেশের লক্ষ্য ছিল ভাষার ভিত্তিতে বহুধাবিভক্ত জনগোষ্ঠীকে একটি এজমালি রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে একীভূত করা, কাজেই সেসব দেশ আত্তীকরণের মাধ্যম হিসেবে গৃহীত ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষাকে দেশীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ উদ্যোগের ফলে এসব ভাষা দেশীয়কৃত হয়ে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে; একই সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সংজ্ঞাপনের এজমালি মাধ্যম হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
ড.
এ বি এম রেজাউল করিম ফকির: প্রাক্তন পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ন ত ত ব ভ ষ ক আদর শ র র জন ত ক দ শ য়করণ উপন ব শ ব যবহ র য় আদর শ ব স তবত
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতীকী মূল্যে কাউকে সরকারি জমি দেওয়া হবে না: অর্থ উপদেষ্টা
এখন থেকে সরকারি জমি প্রতীকী মূল্য কাউকে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, সরকারি জমি যারা নিতে চাইবে যথাযথ মূল্য দিয়ে নিতে হবে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সচিবালয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা সম্প্রসারণের জন্য বন্ধ থাকা চট্টগ্রামের জলিল টেক্সটাইল মিলসের ৫৪.৯৯ একর জমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তরের একটি প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে উপস্থান করা হয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘জলিল টেক্সটাইল মিলস তারা নিতে চাচ্ছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি প্রতীকী মূল্যে দেব না। এখন থেকে প্রতীকী মূল্যটা এভয়েড (এড়িয়ে চলা) করবো। যারাই নিতে চায় অর্থ দিয়ে নেবে। কারণ প্রতীকী মূল্যে দিলে যারা নিয়ে যায়, তারা ঠিকমত ইউটিলাইজ করে না। অনেক ক্ষেত্রে ১০ একর জমির প্রয়োজন থাকলেও প্রতীকী মূল্যের কারণে ১০০ একর জমি দরকার বলে জানানো হয়।’’
তাহলে কি জলিল টেক্সটাইল মিলসের জমি হস্তান্তরের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়নি? সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তাদেরকেই দেওয়া হবে, তবে মূল্যটা নির্ধারণ করে প্রস্তাব আসতে হবে।’’
এদিকে বৈঠক শেষে বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি (বিওএফ) সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলের নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রাম জেলার ভাটিয়ারিতে অবস্থিত জলিল টেক্সটাইল মিলস হস্তান্তরের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ব্যক্তি মালিকানায় ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার ফৌজদারহাট এলাকায় মেসার্স জলিল টেক্সটাইল মিলস স্থাপন করা হয়। মিলের জমির পরিমাণ ৫৪.৯৯ একর। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করার পর উইভিং এবং ডাইং বিভাগ স্থাপনের মাধ্যমে মানসম্মত উৎপাদনের জন্য ৩ বার স্বর্ণপদক লাভ করে মিলটি।
লাভজনকভাবে পরিচালিত মিলটি বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতিমালার আওতায় ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মিলের সাবেক শেয়ার হোল্ডারদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। মালিক পক্ষের মধ্যে অর্ন্তকলহের কারণে ১৯৯৭ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে তৎকালীন সরকার দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মিলটি অধিগ্রহণ করে। ওই দিন সরকার মিলের সাবেক ৪০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার সেলিম চৌধুরী গংদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে মিলটি হস্তান্তর করে।
সেলিম চৌধুরী গং মাত্র ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা দিয়ে মিলটি অধিগ্রহণের পর হস্তান্তর চুক্তির শর্তানুযায়ী সরকারি পাওনা, ৬০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা, ২০০০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে মিল চালু, অর্থ মন্ত্রণালয়, বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ না করে চুক্তির সব শর্ত লঙ্ঘন করে। সুচতুরভাবে মালিকপক্ষ ২০০০ সালের শেষের দিকে নামমাত্র ১টি ইউনিট চালু করে পরবর্তীতে শ্রম আইন বহির্ভূতভাবে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনিটটিও বন্ধ করে দেয়।
এ অবস্থায় ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৬ মাসের মধ্যে মালিকপক্ষ মিল চালু না করলে হস্তান্তর চুক্তির শর্তানুযায়ী সরকার মিলটি অধিগ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। মালিকপক্ষ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ২০০৫ সালের ২০ নভেম্বর সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিলটি বন্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে। দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি জলিল টেক্সটাইল মিলস পুনঃগ্রহণ করে সরকার এবং মিলটি বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়।
ঢাকা/হাসনাত//