জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যায় জড়িতরা এখনও অধরা। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আবাসিক হল থেকে অস্ত্র উদ্ধারের পরও মামলা করেনি। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৬ জুলাই বেরোবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তাঁকে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনার।
গত ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যায় জড়িত অভিযোগে দুই শিক্ষক ও সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হয়। সভার পর চার মাস কেটে গেলেও তাদের বিচারের আওতায় আনতে প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি। এরই মধ্যে গত ২০ জানুয়ারি ১০৯তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যায় জড়িত অভিযোগে ৭১ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সেমিস্টার অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা বোর্ড ২৩ শিক্ষার্থীকে এক সেমিস্টার, ৩৩ জনকে দুই সেমিস্টার ও ১৫ প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সেমিস্টার থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন।
এর বাইরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ১৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার আশ্বাস দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অভিযুক্তরা হলেন ছাত্রলীগের শাখা সভাপতি পমেল বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহাফুজ, সংগঠনের কর্মী ধনঞ্জয় কুমার টগর, গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), বাবুল, বিধান, তানভীর, আদুল্লাহ আল নোমান খান, রিফাত, ফারহাদ হোসেন এলিট, মোমিনুল, আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান ও মামুন।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আবু সাঈদ হত্যার দিনে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়। কিন্তু তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনেনি। সাবেক উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, পরিবহন পুলের উপপরিচালক তাপস কুমার গোস্বামী, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন সর্দার, পেনশন শাখার উপপরিচালক রিয়াজুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর নুরুজ্জামান, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কর্মচারী বিপ্লব, বহিষ্কৃত সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ, ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুল ইসলাম, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মচারী ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মাহবুবার রহমান, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়া, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার উপরেজিস্ট্রার হাফিজ আল আসাদ রুবেল, মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আহসান হাবীব তুষার, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সেশন অফিসার এ কে এম রাহিমুল ইসলাম দিপু, প্রক্টর অফিসের কর্মচারী মো.
আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন ও এস এম আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা চাচ্ছিলাম যারা আহত, তারা সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহী। এখন আমরা নিজেরাই সাক্ষ্য দেব। সাক্ষীদের তালিকা করছি। শিগগির এ তালিকা প্রশাসনের কাছে জমা দেব।’
জানতে চাইলে প্রক্টর ফেরদৌস রহমান বলেন, দুই শিক্ষক ও সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ করা হয়েছে। আমরা তিনবার নোটিশ দেব। উত্তর না পেলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক শওকাত আলী বলেন, ‘আবু সাঈদ ও তাঁর সহপাঠীদের ওপর হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। শিগগির মামলা হবে। অপরাধীদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।’
হত্যা মামলায় রিমান্ডে ছাত্রলীগ নেতা
রংপুর অফিস জানায়, আবু সাঈদ হত্যা মামলায় বেরোবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী আকাশের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার রংপুর মেট্রোপলিটন আমলি আদালতের বিচারক আসাদুজ্জামান এ আদেশ দেন।
১ ফেব্রুয়ারি আকাশকে জামালপুরের ইসলামপুরের গঙ্গাপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গণঅভ্যুত্থানের পর পালিয়ে নিজ এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি।
আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় তাঁর বড় ভাই রমজান আলী হত্যা মামলা করেন। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে। তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই রংপুরের এসপি এ বি এম জাকির হোসেন জানান, এ মামলায় পুলিশসহ এ পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর মকর ত ব যবস থ র কর ম ত কর ম রহম ন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন নামঞ্জুর
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাত শিশুর জামিন আবেদনের শুনানি হয়। গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সৈয়দ আরাফাত হোসেন তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়। তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। ওই পাঁচজনের জামিন আবেদন করা হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
কারাগার সূত্র জানায়, গত ১৬ জুলাই সংঘর্ষের পর ১৭ ও ১৮ জুলাই জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৮ শিশুকে আটক করে পুলিশ। ১৮ জুলাই তাদের আদালতে হাজির করে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২১ জুলাই তাদের যশোরের পুলেরহাট শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আদালতের নথি অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বয়স, ঠিকানা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই। তবে গতকাল পর্যন্ত ১২ শিশুর নাম ও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আটক করা হয়েছে।
আরও পড়ুনগ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ২৭ জুলাই ২০২৫একজন শিশুর বাবা বলেন, ‘সংসারে অভাব–অনটন, নিজেরাই সংসার চালাইতে পারি না। আমার কষ্ট দেখে ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। সে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রমজান শেখ নামের একটা রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। কাজের সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’
আরেক শিশুর ভ্যানচালক বাবা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কোথাও কোনো কাইজের মধ্যে নেই। তিনডা ছেলে, বড়টা একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ছোট দুইডা এখনো পড়ে। যারে ধরছে, সে সবার ছোট। ওই দিন সকালে আমার মাদ্রাসায় গেছে, পরীক্ষা ছিল। পরে দুপুরের আগে আমি নিজে যাইয়ে নিয়ে আসছি। সেদিন বাড়িতেই ছিল। পরের দিনও সারা দিন বাড়ি ছিল, সেদিন তো কারফিউ ছিল। আসরের নামাজের পর আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে গেছে চটপটি খাইতে। পাশে মাদ্রাসার সামনেই চটপটির দোকান বসে। সেই হান দে ওরে ধইরে নিছে।’
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ধরার ঘণ্টাখানেক পর থানা থেইকা ফোন দিছে, কয় ছেলে ধরা হইছে। আমরা থানায় গিয়া অনেক কইছি, ও তো কোথাও যায় না, কোনো গ্যাঞ্জামের ছেলে না। মাদ্রাসায় পড়ে। কিন্তু কেউ কিছুই শুনল না। ছেলেরে ছাড়ায় আনতে অনেক জায়গায় দৌড়াইছি।’ তিনি জানান, এ ঘটনার পর থেকে তাঁদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
এ ছাড়া জামিনের আশ্বাস দিয়ে কয়েকজন লোক তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় আরও একটি মামলা, আসামি ৪৭৭ জন৩১ জুলাই ২০২৫গ্রেপ্তার এক শিশুর আইনজীবী ফিরোজা বেগম বলেন, ১৬ জুলাই সহিংসতার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় এই শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় দ্রুত তদন্ত করে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি তৌফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুরা অল্প সময় আগে গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনো তদন্ত চলছে। তাই হয়তো বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেছেন। এ মামলায় এখনো কারও জামিন হয়নি।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে সংঘাতের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন ১৮ জুলাই ২০২৫