মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তবে আন্দোলনটি বেশি মাত্রায় হচ্ছে এক দশক ধরে। দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। একই বই, একই সিলেবাস, একই যোগ্যতার শিক্ষক অথচ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য উৎকট রূপ নিয়েছে। 

আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য না বুঝে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন, শিক্ষকরা শুধু তাদের বেতন-ভাতা সুবিধাদির জন্য আন্দোলন করছেন। অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের চেয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেই বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের দাম অতিমাত্রায় বৃদ্ধি, সময়মতো শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক না পাওয়া, ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন ছাত্র সংগঠনগুলো গড়ে তুলতে পারেনি। 

যে কারণে রাজপথে শিক্ষকসমাজ
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করছেন। কর্মচারী পান ৮ হাজার ২৫০ টাকা। ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা– এটা সবার জন্য। উৎসব বোনাস দেওয়া হয় ২৫ শতাংশ। কর্মচারীদের দেওয়া হয় ৫০ শতাংশ। বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয় ২০ শতাংশ। বৈশাখী ভাতায় সরকারি-বেসরকারি কোনো বৈষম্য নেই। উৎসব বোনাস ছাড়া বেতন-ভাতাদি থেকে গ্রাচ্যুইটির জন্য সরকার আবার ১০ শতাংশ কেটে নিচ্ছে। এমন নির্মম সিদ্ধান্ত সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও নেই। ২০১৮ সাল থেকে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকরা। একজন এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক প্রথম বছরে কর্তনের পর বেতন পাচ্ছেন ১২ হাজার ৪০০ টাকা।

অধিকাংশ তরুণ শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স পাস। এনটিআরসিএ নির্ধারিত যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ সবাই। অর্থাৎ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও যোগ্যতার বিচার নেই। অন্যদিকে কয়েক হাজার পদ এখনও শূন্য। গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেও যোগদান করেননি অনেকে। ফলে শিক্ষক সংকটও চরমে। নামমাত্র বেতনে জীবনযাপন যদি দুরূহ হয়, মেধাবীরা কেন এ পেশায় আসবেন? 
দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষকের কর্মস্থল নিজ বসত থেকে অনেক দূরে। ভিন জেলায় হলে পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকতে হয় বাসা ভাড়া করে। একজন শিক্ষককে বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে আসতে প্রতিদিন যদি ১০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়, মাসে ২২ দিন আসা-যাওয়া করলে ২২শ টাকা যাতায়াতে খরচ হয়। কর্মস্থলে দুপুরের খাবারও রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১০০ টাকা খরচ হলে এখানেও গুনতে হয় ২২শ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ও দুপুরের খাওয়া বাবদ ৪ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হয়। ওই শিক্ষক মাস শেষে পরিবারের জন্য কিই-বা রাখতে পারবেন? ফলে সংসারের টানাপোড়েনে পড়তে হয় শিক্ষককে। স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মায়ের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। ২৫ শতাংশ উৎসব বোনাসে আসে ৩ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে একজনেরই ঈদের পোশাক কেনা সম্ভব না। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য থাকে কী? ঈদের অন্যান্য খরচ সুদূরপরাহত।

আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রস্তাব 
দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রস্তাব দিয়েছে 
বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। তারা প্রমাণসহ দেখান যে, প্রচলিত অবস্থায়  প্রতিষ্ঠানের সব আয় নিয়ে গেলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যদি শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ টাকা হারে ধরা হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কিছু পরিমাণ টাকা লাগবে, যা রাষ্ট্রের জন্য ন্যূনতম বোঝাও হবে না।

 এ বিষয়ে বিগত সরকার নীতিগতভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েও কার্যত ধোঁকাবাজি করেছে। শিক্ষক সমাজের বিশ্বাস, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্দ্বিধায় শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের গতি বাড়িয়ে তুলবে। যে বৈষম্যহীন স্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করল, তাতে সবাই আশা করতেই পারে আর কোনো বৈষম্য হয়তো থাকছে না। 
বিগত আমলে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা জাতীয়করণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমলা, বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি, এমপি, মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করছেন। বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মাত্রায় শিক্ষা ব্যবসা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা বেতন ও সেশন ফি নিচ্ছে এবং সে টাকা স্থানীয় কমিটি, প্রতিষ্ঠানপ্রধানসহ আত্মসাৎ করার ব্যাপক অভিযোগও আছে। নিবিড় পর্যালোচনায় উঠে এসেছে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরাই বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা-উপজেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এসব নেতা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলছেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড় অঙ্কের বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি নামে-বেনামে ব্যয়ের ভাউচার সন্নিবেশন করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করছেন। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। কার্যত এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধান আন্দোলনে আগ্রহী নন এবং পদও কুক্ষিগত করে রাখেন কিংবা তার অধীন শিক্ষকদের আন্দোলনে আসতে উৎসাহিত করছেন না। 

দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য আরেকটি আন্দোলন কেন অনিবার্য হয়ে উঠবে? মানুষ প্রত্যাশা করতেই পারে দেশকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাই এটি উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যাতে সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যায়। এ দেশের শিক্ষার্থীরা যেন বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। একটি টেকসই মানবিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে ভালো শিক্ষা আশা করা যায় না, ভালো কিছু অর্জন হয় না। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য রেখে কার্যত ভালো জাতিও গড়ে উঠবে না। 

জাহাঙ্গীর হোসেন: সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য করণ র শ ক ষকদ র শ ক ষকর ব যবস থ র জন য সরক র করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

কুমিল্লায় করোনায় আক্রান্ত ৪

কুমিল্লায় চারজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনিবার (১৪ জুন) সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর মো. বশির আহমেদ। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর মো. বশির আহমেদ বলেন, “গত দুইদিনে তিনজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আজ শনিবার আরো একজনের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।”

তিনি বলেন, “আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কুমিল্লা নগরের, কেউ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। সবার নমুনা কুমিল্লা নগরের একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করা হয়েছিল।”

আরো পড়ুন:

চট্টগ্রামে আরো ১ জনের করোনা শনাক্ত 

কিট সংকটে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা বন্ধ

ডা. বশির আহমেদ বলেন, “আক্রান্তদের মধ্যে একজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। দুইজন ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। একজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”

করোনার প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় নতুন করে সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। ফলে অনেকটাই স্বস্তিতে ছিলেন নগরবাসী। হঠাৎ একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হওয়ায় জনমনে আবারো আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই মাস্ক পরছেন এবং সাবধানতা অবলম্বনের চেষ্টা করছেন। তবে, গণপরিবহন, বাজার কিংবা ওষুধের দোকানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার তেমন প্রবণতা দেখা যায়নি।

কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা আমেনা আক্তার বলেন, “আবার যেন সেই দিনগুলো ফিরে আসছে। দোকান-বাজারে মাস্ক ছাড়া মানুষ চলাফেরা করছে। আমরা তো আরেক দফা লকডাউনের ভয়ে আছি।”

সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরির জন্য জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ে প্রচার অভিযান চালানো হবে।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডাক্তার সানজিদুর রহমান বলেন , “করোনা পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনা অবহেলার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে অবস্থা জটিল হতে পারে।”

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পঙ্কুশ  বড়ুয়া বলেন, “করোনার বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হবে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।”

ঢাকা/রুবেল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ১
  • রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
  • গুম করা হতো তিনটি ধাপে 
  • এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা
  • রেনু বেগমের ‘বুকভাসা চোখের পানি’ কেন
  • ইরান অনড়, ইসরায়েল কঠোর
  • ইরানে নিরাপদে আছেন ৬৬ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী
  • নীরব ভালোবাসার আরেক নাম
  • নারীবাদের ছদ্মবেশে ভারত যখন যুদ্ধ চালায়
  • কুমিল্লায় করোনায় আক্রান্ত ৪