কার্যকর করহার কমানোর যৌক্তিক পদক্ষেপ দরকার
Published: 10th, March 2025 GMT
বিগত পাঁচ বছরে কোম্পানি করের হার ৩৫ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কি কোম্পানির কর দায় কমেছে? আমাদের দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ কমেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো অনলাইনে খোঁজ নিলে জানতে পারে, করহার ২৫ শতাংশ। কিন্তু আসলেই কি কার্যকর করহার সেটি? হিসাব কষে আমরা যখন বলি, কার্যকর করহার ৮০ শতাংশ, তখন অনেকেই তা বিশ্বাস করতে চান না।
বর্তমানে কোম্পানির ক্ষেত্রে কার্যকর করহার বৃদ্ধির মূল কারণ দুটি। প্রথমত, উৎসে করের হার অতিরিক্ত বেশি। দ্বিতীয়ত, কিছু খরচ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা পরিপালন এবং নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা।
এ মুহূর্তে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ খুবই দরকার। তাই এখনই সময় জনস্বার্থে কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনা। বিশেষ করে কার্যকর করহার হ্রাসের যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া।শুরুতে উৎসে করের কারণে কার্যকর করহার বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। একটি কোম্পানি কাঁচামাল আমদানি করলে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে ওই কাঁচামাল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পণ্য যদি কোনো উৎসে কর কর্তনকারী পরিবেশক বা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়, তাহলে আবারও ৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হয়।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আমদানি মূল্য ৫০ টাকা। তার ওপর ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর(এআইটি) প্রদান করা হয়, যার পরিমাণ ২.
একটি পরিবেশক কোম্পানি সাধারণত ৫–৮ শতাংশ কমিশন পেয়ে থাকে। বর্তমান আয়কর আইন অনুযায়ী, এই কমিশনের ওপর ১০ শতাংশ কর কর্তন করা হয়। ধরা যাক, কোনো এক বছর ৮ কোটি টাকা কমিশনের ওপর ৮০ লাখ টাকা কর কর্তন করা হলো। ওই বছর পরিবেশক কোম্পানির খরচ হলো ৭ কোটি টাকা। আর নিট লাভ এক কোটি টাকা। এই ১ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ করহার প্রয়োগ করলে প্রদেয় কর দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা। অথচ আগে কেটে রাখা ৮০ লাখ টাকা বিবেচনায় নেওয়া হলে ১ কোটি টাকার লাভের ওপর কার্যকর করহার দাঁড়ায় ৮০ শতাংশ। যেসব কোম্পানি সাড়ে ১২ শতাংশ লাভ করতে পারে না, তাদের কার্যকর করহার আরও বেশি।
কয়েক বছর ধরে উৎসে কর কিছুটা কমানো হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। কার্যকর করহার বৃদ্ধি পায় আইনি বাধ্যবাধকতা পরিপালন ও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণের কারণে। আয়কর আইনের ধারা ৫৫ মোতাবেক ব্যবসার খরচ পরিশোধে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীকে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়। উৎসে কর কর্তন ও পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী যে কর রিটার্ন দাখিল করেছেন, তার প্রমাণপত্র (পিএসআর) সংগ্রহে রাখতে হয়।
ধরা যাক, কোনো কোম্পানি এক কোটি টাকার বিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করল। উৎসে করও দিল, কিন্তু পিএসআর নিল না। সে ক্ষেত্রে ওই কোম্পানিকে ভবিষ্যতে ১ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ বা ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অনেক পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী নগদে লেনদেন করেন। উৎসে কর ও পিএসআর দিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে যেসব কোম্পানি কর সঠিকভাবে পরিচালনা করতে চায়, তাদের খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন না করলে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত উৎসে কর দিতে হয়। পিএসআর না থাকলে আরও অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ কর দিতে হবে।
আয়করউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট ক র ওপর সরবর হ ৫০ ট ক কর দ ত
এছাড়াও পড়ুন:
নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগ কড়া নাড়ছে দরজায়
জ্বালানিশক্তির হাত ধরেই মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে। আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করা থেকে শুরু করে বাষ্পশক্তির ব্যবহার, পরমাণু বিভাজনের মতো মাইলফলক অর্জন—সবই জ্বালানিশক্তির অবদান।
আজ আমরা এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির এক অপার সম্ভাবনা।
গত বছর নতুন করে যে বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, তার প্রায় সবটাই এসেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ দুই ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যা জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে ৮০০ বিলিয়ন ডলার বেশি।
সৌর ও বায়ুশক্তি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিদ্যুতের উৎস, নবায়নযোগ্য খাতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, ত্বরান্বিত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য এখনো অনেক বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়।
যেসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি আঁকড়ে ধরে আছে, তারা তাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষা তো দিচ্ছেই না; বরং ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ, তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো মানে জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জীবাশ্ম জ্বালানির বাজারমূল্য অনিশ্চিত, এর সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা এবং কিংবা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কবলেও পড়তে হতে পারে, যেমনটি আমরা দেখেছি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে আগ্রাসনের সময়; কিন্তু সূর্যালোকের বেলায় মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই, বাতাসের ওপরও কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না এবং প্রায় প্রতিটি দেশেই এত নবায়নযোগ্য সম্পদ আছে যে প্রত্যেকেই চাইলে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।
সর্বোপরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত লাখোকোটি মানুষের কাছে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও টেকসই বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। বিশেষত অফ-গ্রিড ও ছোট ছোট সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলগুলো এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারে।
সব মিলিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা এ মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য; কিন্তু এই রূপান্তর এখনো যথেষ্ট গতিশীল বা সবার জন্য সহজলভ্যও নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।জ্বালানি খাতে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য বিরাজ করছে, এবং কার্বন নিঃসরণ এখনো তার ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখেছে। অথচ জলবায়ু–সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি এড়াতে চাইলে এগুলো হ্রাস করা ছাড়া উপায় নেই। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ছয়টি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত, রাষ্ট্রগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর ভবিষ্যতের প্রতি পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে, প্রতিটি দেশ নতুন জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনা জমা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) নামে পরিচিত।
এনডিসিতে পরবর্তী দশকের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এ পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেখানে সব ধরনের কার্বন নিঃসরণ ও সব খাতকে পর্যালোচনায় রাখতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট রূপরেখা হাজির করতে হবে।
জি–২০ দেশগুলো, যারা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী, তাদেরই এর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে। আধুনিক গ্রিড ও স্টোরেজ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারবে না; কিন্তু নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগ করা প্রতি ডলারের মধ্যে মাত্র ৬০ সেন্ট ব্যয় হয় গ্রিড ও স্টোরেজ বাবদ। এ অনুপাতটিকে ১/১-এ উন্নীত করতে হবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মেটানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও নিজ নিজ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।
চতুর্থত, আমাদের জ্বালানি রূপান্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এর অর্থ হলো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর আগামীর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা; এবং সেই সঙ্গে জরুরি খনিজ সরবরাহ-শৃঙ্খল সংস্কার করা।
এ মুহূর্তে এগুলো অধিকার হরণ ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে জর্জরিত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো মূল্য-শৃঙ্খলের তলানিতে বন্দী হয়ে আছে। অবশ্যই এর অবসান ঘটাতে হবে।
পঞ্চমত, আমাদের বাণিজ্যকে জ্বালানি রূপান্তরের সহায়ক হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের শৃঙ্খলটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং এ মুহূর্তে বৈশ্বিক বাণিজ্য আর এককেন্দ্রিক থাকছে না। নতুন জ্বালানিব্যবস্থার যুগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর উচিত সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করা, নবায়নযোগ্য উৎসের পণ্যে শুল্ক কমানো এবং বিনিয়োগ চুক্তি আধুনিকীকরণ করা যাতে তারা এই রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে পারে।
ষষ্ঠত ও শেষত, আমাদের উচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া। আফ্রিকা গত বছর নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের মাত্র ২ শতাংশ পেয়েছে, যদিও বিশ্বের সেরা সৌর শক্তির ৬০ শতাংশ উৎস এ মহাদেশে রয়েছে। আমাদের কিছু আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে—যাতে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজেটে টান না পড়ে এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলো যাতে তাদের ঋণদান ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে এবং অনেক বেশি বেসরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারে।
আমাদের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো ও বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে, যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিশ্রুতি, জলবায়ু সংকটের ক্ষতিপূরণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ বিকল হয়ে পড়ার ঝুঁকির আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়।
এক নতুন জ্বালানি সম্ভাবনার যুগ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে—এমন এক যুগ যেখানে সাশ্রয়ী, নবায়নযোগ্য, প্রাচুর্যময় জ্বালানি এক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধিশালী পৃথিবীকে শক্তি জোগাবে, যেখানে রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং বিদ্যুৎসেবা থাকবে সব নাগরিকের হাতের মুঠোয়।
ঠিক এ মুহূর্ত আমরা চাইলেই বৈশ্বিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারি। আসুন, আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাই।
আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব