১৯ জুলাই রাতে গুলশান থেকে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বন্ধুকে কর্মসূচিটা দিয়ে আমার ভাতিজা মহিউদ্দিন রিয়াজকে ফোন করলাম। তাঁদের বাসা মিরপুরের কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনের পাশে। নতুন কেনা সিমটা ব্যবহার করে তাকে কল দিয়ে বলি, আমি আসছি।
রাত সাড়ে ১০টা–১১টার দিকে নিকেতন-হাতিরঝিল এলাকায় হেঁটে হেঁটে আমি সিএনজি খুঁজছিলাম। এলাকাটায় বেশি আলো নেই। কিছুটা আলো-আঁধারি। হঠাৎ কোত্থেকে একটা হাই–এস গাড়ি আমার খুব কাছাকাছি চলে এল। আমি ঘোরারও সুযোগ পেলাম না। তার আগেই সাদাপোশাকে সাত–আটজন লোক হুট করে নেমে এসে মোটা কালো কাপড় দিয়ে আমার পুরো মুখ ঢেকে ফেলল। আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। বলল, তারা ডিবি। আমি চিৎকার করতে গেলে তারা আমাকে চুপচাপ থাকতে বলল, নইলে ক্ষতি হবে। আমি বুঝতে পারলাম, এদের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আর উপায় নেই। গাড়িতে চুপ করে বসে থাকলাম।
নিজেদের ওরা ডিবি পরিচয় দিলেও তাদের কথা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ৩০ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে তারা আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে একটা ভিডিও বার্তা প্রচারের জন্য সেখানে তারা আমাকে অনবরত চাপ দিয়ে গেল। আমি বললাম, এখন তো ইন্টারনেট নেই, কীভাবে ভিডিও বার্তা দেব। তারা বলল, টেলিভিশন থেকে প্রচার করা হবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মূলত তাদের নির্দেশ মেনেই চলছিল।
তারা বলল, ‘তোদের লোকদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। তুই যদি না দিস, অন্য কারও কাছ থেকে আমরা ঠিকই পেয়ে যাব।’ ঘণ্টাখানেক ধরে তারা আমাকে নানাভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করল। বলল, ‘তোদের কারণে এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। ভিডিও বার্তা না দিলে সব হত্যার দায় তোদের নিতে হবে।’ আমার পক্ষে ভিডিও বার্তা দেওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। আন্দোলন স্থগিত করার সীমা ততক্ষণে পার হয়ে গেছে। বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, যদি আমার জীবনও চলে যায়, তবু শহীদদের সঙ্গে বেইমানি করব না।
একপর্যায়ে মুঠোফোনের লক খুলে দেওয়ার জন্য তারা আমার মুখের বাঁধন খুলে দেয়। আমি বললাম, আপনারাই তো এটা খুলতে পারেন। আমি নিচে বসা ছিলাম। একজন এসে আমার পায়ে দুই-তিনটা লাথি মেরে ফোন কেড়ে নেয়। এরপর লক খুলতে না বললেও ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য তারা আমাকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। এভাবে প্রায় ঘণ্টা তিনেক চাপাচাপি চলে।
ভিডিও বার্তা না দিলেও এরপর তারা আমাকে আর মারধর না করে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে। জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাকে বলেন, সারজিস আলম আর হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাঁরা ভিডিও বার্তা দেবেন। আমিও যদি ঘোষণা দিই, তাহলে কাল থেকে খুনখারাবি বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার কোটা সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার কোটা সংস্কার রিটের শুনানির তারিখ এগিয়ে ২১ জুলাইয়ে নিয়ে এসেছিল।
২০ জুলাই রাতের তখন প্রথম প্রহর। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা বারবার জানতে চাইছিলেন, কার কার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। আমি কিছুই বলিনি। বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা কেমন হতাশ হয়ে পড়লেন। একপর্যায়ে একজন বললেন, একে দিয়ে হবে না। কিছুক্ষণ পরে আরেকজন এসে আমার শরীরে একটা ইনজেকশন দিল। কীসের ইনজেকশন প্রশ্ন করায় সে বলল, ‘ঘুমের ইনজেকশন। কিছু হবে না।’ এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
■ মা–বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা চার-পাঁচ দিন ধরে আমাকে খুঁজছিলেন। এমনকি এ–ও ভেবেছিলেন যে আমি শহীদ হয়ে গেছি। ■ জামায়াতে ইসলামী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে ছাত্রশিবির সব সময়ই সরকার পতনের আন্দোলনে ছিল।আমাকে রাখা হয়েছিল ছোট একটা কক্ষে। একটাই দরজা। কোনো জানালা নেই। শুধু একটা ভেন্টিলেটর আর তিনটি এগজস্ট ফ্যান ছিল। আর ছিল একটা ফ্যান আর একটা লাইট। আমি ভাবছিলাম, এটা কি আয়নাঘর? আয়নাঘর নিয়ে এর আগে অনেক আন্দোলন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আয়নাঘরের যে বর্ণনা শুনেছিলাম, তার সঙ্গে এর কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। অতিরিক্ত এগজস্ট ফ্যান দেখে আয়নাঘর বলেই মনে হচ্ছিল। পরে আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে নিশ্চিত হই, সেটি আয়নাঘরই ছিল। নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে যেখানে রাখা হয়েছিল, পরে তাঁর মুখে সেই কক্ষের বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে, আয়নাঘরের সঙ্গে সেটির মিল আছে।
জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারছিলাম না তখন দিন না রাত। ওয়াশরুম থেকে আসার পরে তারা কলা আর রুটি খেতে দিল। কিছুক্ষণ পর একজন এসে বলল, ‘তোকে ছাড়াই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তুই–ই এটা করতে পারতি।’ কী সমাধান হয়েছে, জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দিল না। আমার শরীরে আবার ইনজেকশন দেওয়া হলো। বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই বলে আমি কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করিনি।
আবার জ্ঞান ফিরলে তারা বলল, ‘তোমাদের তিনজনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।’ আমি বুঝতে পারছিলাম না, কারা সেই তিনজন। আমার মাথায় ছিল, সারজিস আর হাসনাত যেতে পারেন। তৃতীয়জন কে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে খাবার দিয়ে আবারও ইনজেকশন দেওয়া হলো।
২৩ জুলাই রাতে আমাকে মুঠোফোন ফিরিয়ে দেওয়া হলো। যার হাতে আমাকে সোপর্দ করা যাবে, সে রকম কাউকে ওরা কল দিতে বলল। আমার বাবা, নাহিদ ভাই, হাসিব, এ রকম কয়েকজনকে আমি কল দিলাম। কাউকেই পাওয়া গেল না। ইন্টারনেট তখনো বন্ধ। ফোনে কাউকে না পাওয়ায় তারা আমাকে ছাড়ল না। পরদিন ২৪ জুলাই আমাকে যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তারা আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। নিকেতনের পাশে হাতিরঝিলের যে অংশ, সেখানে একটা ছোট ফটক আছে, যেটা দিয়ে ঢুকলে মহাখালী দক্ষিণ এলাকা পড়ে, তার কাছে তারা আমাকে ফেলে যায়।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক।.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইনজ কশন ব রব র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মেয়েকে নিয়ে টিকে থাকতে না পেরে বিদেশ চলে যান পিয়া বিপাশা
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিনোদন অঙ্গনে পা রাখেন পিয়া বিপাশা। এরপর অভিনয় করেছেন মিউজিক ভিডিও, নাটক ও সিনেমায়। কিন্তু হুট করেই নাই হয়ে গেলেন। পরে জানা গেল অভিনেত্রী আমেরিকায়। গেল পাঁচ বছর সেখানেই বাস করছেন তিনি। সম্প্রতি দেশের একটি গণমাধ্যমে প্রবাসজীবনসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
পিয়া বিপাশা জানান, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তাঁরা বিয়ে করেন। দুজনে মিলে বিয়ে করলেও আনুষ্ঠানিকতা সারেননি। চলতি বছরের শেষ দিকে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেওয়ার ইচ্ছা।
পিয়া বিপাশা বলেন, ‘বাংলাদেশে ভালো লাগত না। কারণ, লবিং ছাড়া কাজ হতো না। ভালো একটা সিনেমা করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়নি। এরপর আমার মিডিয়ায় কাজ করার ইচ্ছাই নষ্ট হয়ে যায়। আমি আসলে কাজ করতে চেয়েছিলাম টাকা কামানোর জন্য। কাজ না করতে পারলে টাকা কামাব কী করে। তাই সিদ্ধান্ত নিই অন্য কিছু করার।’
বিপাশার কথায়, ‘টাকা রোজগারের জন্য আমি বিনোদন অঙ্গনে কাজ করেছিলাম। কারণ, আমার একটা মেয়ে ছিল। মেয়েকে নিয়ে টিকে থাকার বিষয় ছিল। পরে দেখলাম, যেভাবে কাজ হয়, আমাকে দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমেরিকায় চলে আসার। এখানে এসে বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। অনেক টাকাও আয় করছি।’
পিয়া বিপাশা বলেন, ‘সত্যি বলতে এখন আমার এমন অবস্থা, টাকা ইনকাম না করলেও হয়। যতটুকুই করি, আমার মেয়ে ও হাজব্যান্ড ওরাই বলে। আমার এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই। যা চেয়েছি, গত পাঁচ বছরে সবই পেয়েছি। টাকাপয়সা, সুন্দর জীবন, প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ভালো স্বামী—সবই আমার হয়েছে। টাকা নিয়ে এখন কোনো চিন্তা নেই আমার—যা আয় করি, তা ব্যয় করার সময় পাই না।’
পিয়া বিপাশা জানান, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে বিভিন্ন পণ্যের যেসব পোস্ট করেন, তার জন্য বেশ ভালো সম্মানী পান। তাঁর দাবি, এই সম্মানী কখনো দুই হাজার ডলার, আবার কখনো তিন হাজার ডলারের মধ্যে।
২০১৩ সালে ‘দ্বিতীয় মাত্র’ নাটকে তাহসান খানের বিপরীতে অভিনয় করেন। ছোটবেলায় রূপকথার বই পড়তে পছন্দ করতেন। বই পড়ার সময় গল্পের নায়িকার চরিত্রে নিজেকে কল্পনাও করতেন। বড় পর্দায়ও অভিনয় করেছিলেন। ‘রুদ্র: দ্য গ্যাংস্টার’ নামের সেই ছবি মুক্তি পায়। এরপর ‘রাজনীতি’ ছবিতে শাকিব খানের বিপরীতে অভিনয়ের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। পরে সেই ছবিতে পিয়া বিপাশার পরিবর্তে অপু বিশ্বাস অভিনয় করেন।