জাতির অহংকার ও গৌরবের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
Published: 19th, March 2025 GMT
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নিজ প্রাণ সঁপে দিয়েছিল বাঙালিরা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির দুর্ভোগের বিনিময়ে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল এই স্বাধীন রাষ্ট্র।
একটি প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাসে যুদ্ধ জয় করা এক বিরল ঘটনা। এই বিজয় অর্জনের পেছনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক।
দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ এবং জনগণের প্রতি ভালোবাসা– এ দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সেনাবাহিনীর দেশপ্রেম। আমার বিশ্বাস, একটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশসেবায় সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা দেশপ্রেমিক গণমানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পরপরই বাঙালি নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেছিলেন, বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বাঙালিদের মুক্তি সম্ভব নয়। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে; বাঙালির ভাষা কেড়ে নিতে চায়, সেই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য নয়। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতের নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে দখলদার হানাদার বাহিনীর বুলেট আঘাত হানতে থাকে নিরস্ত্র, নিরীহ, নিরপরাধ, বিপন্ন ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। বাঙালি জাতির ওপর হানাদার বাহিনীর এই কুখ্যাত পূর্বপরিকল্পিত ও ন্যায়নীতিবহির্ভূত গণহত্যাটি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিতি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই হানাদার বাহিনীর হামলার জবাবে ভীত কিংবা হতবিহ্বল না হয়ে সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা সরাসরি বিদ্রোহ করে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন-সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সে সভায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ, সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি, একক কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন, সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ফোর্সেস গঠন করা হয়। পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আগের সিদ্ধান্তের আলোকে গোটা দেশকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ একটি পরিকল্পিত রূপ লাভ করে। পরে ১০ থেকে ১৭ জুলাই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের এক সম্মেলনে অপারেশন চালানোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিভক্ত করে পেশাদার দুরন্ত, অকুতোভয় বীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের এসব সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘জেড ফোর্স’, ‘এস ফোর্স’ ও ‘কে ফোর্স’ নামে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক দূরদর্শী সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধে নতুন গতিশীলতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে লাখো জনতার সম্মুখে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অবনত মস্তকে প্রায় ৯৩ হাজার দখলদার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও দখলদার হানাদার বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই আত্মসমর্পণের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩ জন বীরশ্রেষ্ঠসহ ১ হাজার ৫৩৩ জন সেনাসদস্য শাহাদাত বরণ করেন এবং ২৯১ জন সেনাসদস্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সংকটের সময়েও সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য জীবন দিয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে র্যাবের সদস্য হয়ে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি করে সেনাবাহিনী দেশ-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। পদ্মা সেতু, জাতীয় মহাসড়ক, মহিপাল ফ্লাইওভার, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফিট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফিট খাল খনন প্রকল্প হাতিরঝিল, স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতাবিশিষ্ট বর্ডার সড়কসমূহ, মেরিন ড্রাইভসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনা তৈরিতে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সশস্ত্র বাহিনী নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছে। তার অন্যতম উদাহরণ মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লকডাউন কার্যকর, ত্রাণ সহায়তা, বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ করোনা মোকাবিলায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতেও আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে যুদ্ধবিধ্বস্ত কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর, সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য সুনামের সঙ্গে কাজ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসন ক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন বাংলাদেশকে শান্তি রক্ষা মিশনের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করে।
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই জনগণের আস্থা ও ভরসার নাম সেনাবাহিনী। সব সময়ই দুর্গত মানুষের পাশে থেকেছে সেনাসদস্যরা। ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০২০ সালে আম্পান এবং অতিসম্প্রতি ২০২৪-এর আগস্ট মাসে ফেনী-কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যাদুর্গত অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে উদ্ধার, ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয়েছে জনগণের কাছে প্রশংসিত। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে সেনাসদস্যরা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন।
২০২৪-এর এই গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সংকটময় সময়ে বর্তমান সেনাপ্রধান এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান খুব সুন্দরভাবে ও অসাধারণ পরিপক্বতার সঙ্গে দেশের দায়িত্ব ড.
সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ পেশাগত উৎকর্ষে বিশ্বের যে কোনো বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। মিসাইল, আধুনিক ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সব শাখাসহ সেনাবাহিনী এমন সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিদ্যাপীঠ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বর্তমান সময়ে সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখাকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, দুটি পদাতিক ব্রিগেড, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি ও জেসিও-এনসিওস একাডেমির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ একটি পরিচিত এবং গর্বিত নাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সব সাফল্যমণ্ডিত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে বিশাল সম্মান বয়ে এনেছে, তা শুধু সেনাবাহিনীর নয় বরং এ দেশের সবার অহংকার ও গৌরব।
কর্নেল এ এস এম নাছের, পিএসসি, জি+: সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ১৯৭১ স ল র স ন সদস য কম ন ড র জনগণ র র জন য পদ ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
একটি টাইম স্কেল-সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্তদের দুটি উচ্চতর গ্রেড পেতে আইনি বাধা কাটল
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে, তিনি উচ্চতর গ্রেড পাবেন না উল্লেখ করে জাতীয় বেতন স্কেল স্পষ্টীকরণ-সংক্রান্ত পরিপত্র পুরোটাই অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক চারটি আপিল ও আটটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) নিষ্পত্তি করে আজ বুধবার রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে এ রায় দেন।
রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, স্পষ্টীকরণ–সংক্রান্ত পরিপত্রের প্যারা-গ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ২০১৫ সালের জাতীয় পে–স্কেলের উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতাসংক্রান্ত প্যারা-৭ যেমন আছে, তেমনই থাকবে। স্পষ্টীকরণ পরিপত্রের প্যারা-গ-এর কারণে দুটি উচ্চতর গ্রেড পাওয়ায় যে প্রতিবন্ধকতা, তা আর থাকল না। এটি না থাকার কারণে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১৫ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ যাঁরা ২০১৫ সালের আগে একটা টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁদের দুটি উচ্চতর গ্রেড পেতে বাধা আইনি বাধা থাকছে না।
পে-স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদে আছে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’
এর আগে সব পর্যায়ের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামো (জাতীয় পে–স্কেল)–সংক্রান্ত আদেশ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। এটি জাতীয় পে–স্কেল ২০১৫ নামে পরিচিত।
পে–স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ৭ (১) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো স্থায়ী কর্মচারী পদোন্নতি ছাড়া একই পদে ১০ বছর পূর্তিতে এবং চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন।
৭ (২) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো কর্মচারী তাঁর চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্তির পর পরবর্তী ৬ষ্ঠ বছর পদোন্নতি প্রাপ্ত না হলে ৭ম বছরে চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন।
৭ (৩) উপ–অনুচ্ছেদের ভাষ্য, (১) ও (২) উপ–অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আর্থিক সুবিধা বেতন স্কেলের চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে এবং চতুর্থ গ্রেড বা তার ওপরের গ্রেডের কোনো কর্মচারী এই সুবিধা গ্রহণ করে এই আদেশের অধীন তৃতীয় গ্রেড বা তার ওপরের গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন না।
আর ৭ (৪) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক সিলেকশন গ্রেড স্কেল বা উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল) বা অন্য কোনো স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার এক বছর পর পরবর্তী উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না।
পরিপত্রের প্যারা-গ অবৈধ
জাতীয় বেতনকাঠামো প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর ‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ স্পষ্টীকরণ’ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর (গ) অনুচ্ছেদে উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতা বিষয়ে বলা রয়েছে।
(গ) (১) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে তিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উচ্চতর গ্রেড পাবেন না।
(গ) (২)–এর ভাষ্য, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী একটিমাত্র উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় বছর পূর্তির পর সপ্তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন।
(গ) (৩) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী কোনো প্রকার উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) না পেয়ে থাকলে সন্তোষজনক চাকরির শর্তে তিনি ১০ বছর চাকরি পূর্তিতে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড এবং পরবর্তী ৬ষ্ঠ বছরে পদোন্নতি না পেলে ৭ম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন।
আর সরকারি কর্মচারীদের প্রদত্ত এসব আর্থিক সুবিধা কোনোক্রমেই ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বরের আগে দেওয়া হবে না বলে পরিপত্রের (গ) (৪) উল্লেখ করা হয়।
আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালের পে–স্কেলের ৭ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে চতুর্থ গ্রেড বা তার ওপরের কর্মচারী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না। একই সঙ্গে ২০১৫ পে–স্কেলে আগে যেসব কর্মচারী দুই বা ততোধিক টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁরাও উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না মূল পে–স্কেলে বলা আছে। অথচ ২০১৫ সালের আগে যাঁরা একটি মাত্র টাইম স্কেল অথবা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁরা একটিমাত্র উচ্চতর গ্রেড পাবেন বলে স্পষ্টীকরণ–সংক্রান্ত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ২০১৫ সালের জাতীয় পে–স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পরিপত্র দিয়ে মূল জাতীয় বেতনকাঠামো সংশোধন এখতিয়ারবহির্ভূত। যে কারণে রিটগুলো করা হয়।
মামলার পূর্বাপর
‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ স্পষ্টীকরণ’ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর রিট করেন কয়েকজন সরকারি চাকরিজীবী। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে স্পষ্টীকরণ পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মিত আপিল করে।
এ ছাড়া ওই পরিপত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীরা পৃথক রিট করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষিত হয়।
হাইকোর্টের পৃথক রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের সঙ্গে অপর আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষের এসব আপিল ও লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে আজ রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রিট আবেদনকারীর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন ও আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল শুনানি করেন।