কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মাহমুদ খলিলকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করায় ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা তীব্র ক্ষোভ ও দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্ববাসীর কাছে খলিলের গ্রেপ্তার বিস্ময়কর মনে হতে পারে; তবে আমাদের কাছে তা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, আমরা গাজার ওপর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনবিরোধী ঘৃণা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।

২০২৩ সালের অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর এই ঘৃণা আরও বেড়েছে। এটি ট্রাম্পকে ‘অপ্রয়োজনীয়দের’ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং বাক্‌স্বাধীনতা ও শিক্ষা অর্জনের অধিকার খর্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে।

গত বসন্তে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস–এ আমি একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আমি আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি (ইউএসসি) কর্তৃপক্ষের কঠোর সমালোচনা করেছিলাম। কারণ, তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করতে দাঙ্গা পুলিশ ডেকেছিল। এরপর এক ক্ষুব্ধ পাঠক আমাকে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি হামাসকে এত ভালোবাসো, তাহলে গাজার দক্ষিণে চলে যাও। তাহলে অন্তত ভবিষ্যতে কোনো বোমা হামলায় তোমার নামও নিহতদের তালিকায় থাকবে।’ 

এর কয়েক মাস পর আমার লেখা ক্যাম্পাস লকডাউনের ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা নিয়ে প্রায় চার হাজার স্বয়ংক্রিয় ই-মেইল আসতে থাকে, যার শুরুতেই লেখা থাকত ‘চরম ঘৃণ্য স্যান্ডি টোলান’।

আর আমি তো ভুলতে পারব না—গত সপ্তাহে যখন আমি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলাম, তখন ক্ষুব্ধ টেক্সানরা আমার বক্তৃতা বন্ধ করতে কীভাবে চিৎকার করছিলেন।

তবে এসব ঘটনা আমার কাছে তেমন বড় কিছু মনে হয় না। আমি ভাবি, আমার সেই সহকর্মীদের কথা, যাঁরা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, তারপর গ্রেপ্তার হয়েছেন বা শাস্তি ভোগ করেছেন। কিংবা সেই শিক্ষার্থীদের কথা, যাঁদের নাম কালোতালিকায় তোলা হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি চাকরির অফারও বাতিল করা হয়েছে। 

এত কিছু সহ্য করার পরও আমার অভিজ্ঞতা গাজার মানুষের চরম দুর্ভোগের সামনে একেবারেই তুচ্ছ। গত ১৭ মাসে সেখানে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ইসরায়েলি বাহিনীর ছোড়া মার্কিন অস্ত্রে মারা গেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, অনেকের দেহের অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিহত হয়েছেন এক শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মী; সঙ্গে শত শত ছাত্রছাত্রী। 

গাজার বাস্তবতা তুলে ধরতে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যায়, তা মূলত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর দীর্ঘদিন ধরে মুছে ফেলার ফল। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ফিলিস্তিনিদের হয় ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রিত করে, নয়তো শুধু ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে। এসব সংবাদমাধ্যম তাঁদের কখনোই একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখে না।

এই অমানবিকীকরণের কারণেই মাহমুদ খলিলের মতো ব্যক্তির গ্রেপ্তার এত সহজ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয় সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য। তিনি ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, ‘আমরা এই সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের খুঁজে বের করব, গ্রেপ্তার করব এবং বহিষ্কার করব। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এই নির্দেশ মানবে।’

খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনই এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিন ধরে অবমাননা ও দমন করার কারণে এই কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর অযৌক্তিকভাবে ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ)-এর মিথ্যা অভিযোগ ব্যবহার করা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই অভিযোগগুলোর শিকড় গত বছরের গাজা আন্দোলনে প্রোথিত, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছিল এবং ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল—যা আসলে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির মূলনীতির অংশ ছিল।

এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরও কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। এমনকি গণহত্যা ও হলোকাস্ট নিয়ে গবেষণা করা অনেক বিশেষজ্ঞও এই মতামতের সঙ্গে একমত। তাই এটি কোনোভাবেই ইহুদিবিদ্বেষ হতে পারে না।

অবশ্যই প্রকৃত ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি এসব অভিযোগ করছেন বাক্‌স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য, সত্যিকারের ইহুদিবিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য নয়।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তকারীদের পাঠাচ্ছে। এই তদন্তকারীরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে রিপোর্ট তৈরি করবেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদ খলিলের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি প্রথম ঘটনা, এ রকম আরও অনেক কিছু আসছে।’ 

ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আর্থিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নীতিগত সমর্থন আদায় করতে চাইছে। এই চাপের মূল হাতিয়ার হলো ফেডারেল তহবিল (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়ন) হ্রাসের হুমকি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে যেগুলো গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য ফেডারেল তহবিলের ওপর নির্ভরশীল—সরকারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইউএসসি (ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া) এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ফেডারেল গবেষণা অনুদান, শিক্ষার্থীর ঋণসুবিধা বা বিশেষ প্রকল্পের তহবিল হারানোর ভয়ে নীতিগত পরিবর্তনে বাধ্য হতে পারে।

স্বৈরশাসকদের আদেশ মানার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে যখন তা মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই হয় এবং তাদের দমনমূলক পরিকল্পনা কোনো গোপন বিষয় নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড দুর্বল করে দিতে চায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, তা খুবই স্পষ্ট আর তা হলো দমনমূলক চাপের কাছে নতিস্বীকার করা যাবে না। আমাদের এখন নিজেদের মূল্যবোধ নির্ভয়ে রক্ষা করতে হবে, বাধ্য হয়ে নয়, বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের জ্ঞানচর্চা রক্ষা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। 

স্যান্ডি টোলান লস অ্যাঞ্জেলেসের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যানেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমের অধ্যাপক


দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ইসর য় ল গণহত য আম দ র র জন য হয় ছ ন ক র কর র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান

ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতম বর্বরতা থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। 

আজ বুধবার ফিলিস্তিন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। 

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ইসরায়েল এ পর্যন্ত ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী সকলকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠনই বলছে, ‘গাজায় গণহত্যা চলছে’

ফিলিস্তিন সংকট সমাধান: সবার দৃষ্টি জাতিসংঘের বিশ্ব সম্মেলনে

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থন পুর্নব্যক্ত করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপনের একমাত্র পথ হিসেবে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। 

গাজা পুনর্গঠনে আরব পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের নেতৃত্বে গাজা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে প্রস্তত রয়েছে। তিনি গাজায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম বাধা দেয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা সর্বাত্বকভাবে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।

২০২৩ সালের অক্টোবরের পর হতে গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ এবং একটি স্থায়ী সমাধানের পথ সুগম করতে জাতিসংঘের সদস্যদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করার জন্য ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ‘জাতিসংঘ হাইলেভেল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর দ্য পিসফুল সেটেলমেন্ট অব দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন অ্যান্ড দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য টু-স্টেট সল্যুশন’ শীর্ষক মন্ত্রী পর্যায়ের এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

এতে বাংলাদেশসহ ১১৮টি দেশের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছে।

ঢাকা/হাসান/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬০ হাজার ছাড়াল
  • গণহত্যার বিচারের পর পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি রেজাউল করীমের