ট্রাম্প যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠছেন
Published: 23rd, March 2025 GMT
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মাহমুদ খলিলকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করায় ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা তীব্র ক্ষোভ ও দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিশ্ববাসীর কাছে খলিলের গ্রেপ্তার বিস্ময়কর মনে হতে পারে; তবে আমাদের কাছে তা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, আমরা গাজার ওপর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনবিরোধী ঘৃণা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।
২০২৩ সালের অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর এই ঘৃণা আরও বেড়েছে। এটি ট্রাম্পকে ‘অপ্রয়োজনীয়দের’ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং বাক্স্বাধীনতা ও শিক্ষা অর্জনের অধিকার খর্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত বসন্তে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস–এ আমি একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আমি আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি (ইউএসসি) কর্তৃপক্ষের কঠোর সমালোচনা করেছিলাম। কারণ, তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করতে দাঙ্গা পুলিশ ডেকেছিল। এরপর এক ক্ষুব্ধ পাঠক আমাকে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি হামাসকে এত ভালোবাসো, তাহলে গাজার দক্ষিণে চলে যাও। তাহলে অন্তত ভবিষ্যতে কোনো বোমা হামলায় তোমার নামও নিহতদের তালিকায় থাকবে।’
এর কয়েক মাস পর আমার লেখা ক্যাম্পাস লকডাউনের ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা নিয়ে প্রায় চার হাজার স্বয়ংক্রিয় ই-মেইল আসতে থাকে, যার শুরুতেই লেখা থাকত ‘চরম ঘৃণ্য স্যান্ডি টোলান’।
আর আমি তো ভুলতে পারব না—গত সপ্তাহে যখন আমি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলাম, তখন ক্ষুব্ধ টেক্সানরা আমার বক্তৃতা বন্ধ করতে কীভাবে চিৎকার করছিলেন।
তবে এসব ঘটনা আমার কাছে তেমন বড় কিছু মনে হয় না। আমি ভাবি, আমার সেই সহকর্মীদের কথা, যাঁরা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, তারপর গ্রেপ্তার হয়েছেন বা শাস্তি ভোগ করেছেন। কিংবা সেই শিক্ষার্থীদের কথা, যাঁদের নাম কালোতালিকায় তোলা হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি চাকরির অফারও বাতিল করা হয়েছে।
এত কিছু সহ্য করার পরও আমার অভিজ্ঞতা গাজার মানুষের চরম দুর্ভোগের সামনে একেবারেই তুচ্ছ। গত ১৭ মাসে সেখানে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ইসরায়েলি বাহিনীর ছোড়া মার্কিন অস্ত্রে মারা গেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, অনেকের দেহের অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিহত হয়েছেন এক শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মী; সঙ্গে শত শত ছাত্রছাত্রী।
গাজার বাস্তবতা তুলে ধরতে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যায়, তা মূলত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর দীর্ঘদিন ধরে মুছে ফেলার ফল। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ফিলিস্তিনিদের হয় ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রিত করে, নয়তো শুধু ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে। এসব সংবাদমাধ্যম তাঁদের কখনোই একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখে না।
এই অমানবিকীকরণের কারণেই মাহমুদ খলিলের মতো ব্যক্তির গ্রেপ্তার এত সহজ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয় সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য। তিনি ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, ‘আমরা এই সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের খুঁজে বের করব, গ্রেপ্তার করব এবং বহিষ্কার করব। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এই নির্দেশ মানবে।’
খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনই এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিন ধরে অবমাননা ও দমন করার কারণে এই কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর অযৌক্তিকভাবে ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ)-এর মিথ্যা অভিযোগ ব্যবহার করা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই অভিযোগগুলোর শিকড় গত বছরের গাজা আন্দোলনে প্রোথিত, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছিল এবং ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল—যা আসলে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির মূলনীতির অংশ ছিল।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরও কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। এমনকি গণহত্যা ও হলোকাস্ট নিয়ে গবেষণা করা অনেক বিশেষজ্ঞও এই মতামতের সঙ্গে একমত। তাই এটি কোনোভাবেই ইহুদিবিদ্বেষ হতে পারে না।
অবশ্যই প্রকৃত ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি এসব অভিযোগ করছেন বাক্স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য, সত্যিকারের ইহুদিবিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য নয়।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তকারীদের পাঠাচ্ছে। এই তদন্তকারীরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে রিপোর্ট তৈরি করবেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদ খলিলের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি প্রথম ঘটনা, এ রকম আরও অনেক কিছু আসছে।’
ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আর্থিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নীতিগত সমর্থন আদায় করতে চাইছে। এই চাপের মূল হাতিয়ার হলো ফেডারেল তহবিল (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়ন) হ্রাসের হুমকি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে যেগুলো গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য ফেডারেল তহবিলের ওপর নির্ভরশীল—সরকারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইউএসসি (ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া) এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ফেডারেল গবেষণা অনুদান, শিক্ষার্থীর ঋণসুবিধা বা বিশেষ প্রকল্পের তহবিল হারানোর ভয়ে নীতিগত পরিবর্তনে বাধ্য হতে পারে।
স্বৈরশাসকদের আদেশ মানার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে যখন তা মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই হয় এবং তাদের দমনমূলক পরিকল্পনা কোনো গোপন বিষয় নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড দুর্বল করে দিতে চায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, তা খুবই স্পষ্ট আর তা হলো দমনমূলক চাপের কাছে নতিস্বীকার করা যাবে না। আমাদের এখন নিজেদের মূল্যবোধ নির্ভয়ে রক্ষা করতে হবে, বাধ্য হয়ে নয়, বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের জ্ঞানচর্চা রক্ষা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
● স্যান্ডি টোলান লস অ্যাঞ্জেলেসের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যানেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমের অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ইসর য় ল গণহত য আম দ র র জন য হয় ছ ন ক র কর র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ
‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে’ আগামী ২ মে (শুক্রবার) রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে এই সমাবেশ হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত দল এনসিপি।
সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলের সাতটি অপরাধের কথা উল্লেখ করেছে এনসিপি। এগুলো হলো ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ দমনের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড; গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহরণ; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ; ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো হত্যাযজ্ঞ; লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার; ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় চালানো নজিরবিহীন গণহত্যা।
এরপর চারটি দাবিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রচারপত্রে। এগুলো হলো প্রতিটি অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন গঠন করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের ব্যবস্থা; আগামী নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ প্রশ্নের মীমাংসা তথা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল; বিচার চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমায়েত হতে পারে। এই সমাবেশে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
দলগতভাবে আওয়ামী লীগের বিচার, দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মশালমিছিল করছে এনসিপি। এর ধারাবাহিকতায় এবার কিছুটা বড় পরিসরে ঢাকা মহানগর শাখার ব্যানারে সমাবেশ হতে যাচ্ছে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরের থানা পর্যায়ে কিছুদিন ধরে এনসিপির যে কর্মসূচিগুলো হচ্ছে, এগুলোরই চূড়ান্ত সমাবেশটা হবে আগামী ২ মে।