শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে মনিপুরী তাঁতিদের
Published: 23rd, March 2025 GMT
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ঈদকে সামনে রেখে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মনিপুরী পাড়ার তাঁতিরা। তবে আগের মতো চাহিদা না থাকায় লাভের আশা কমে গেছে। তবুও তাদের ঐতিহ্যের শিল্পকে ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এ শিল্পের কারিগররা।
মনিপুরী তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ‘‘টেকনোশিয়ানরা সিন্ডিকেট করে আমাদের হাতেবুনা শিল্পের ধস নামানোর চেষ্টা করছেন। তাদের হাতে চলে যাচ্ছে আমাদের আদি শিল্প। এখন আসল মনিপুরী শাড়ি কপি করা হচ্ছে।’’
মৌলভীবাজার কমলগঞ্জ উপজেলার ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে মনিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। এরসঙ্গে ১৫ হাজার মুসলিম মনিপুরীদের বসবাস রয়েছে এখানে। বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংক ঋণ সহজ করায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে এখন সবার ঘরে ঘরে হস্তচালিত তাঁত মেশিন সচল রয়েছে। প্রতি পরিবারের নারীরা মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। এই আয়ের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাঁত শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণের কিস্তি দিয়ে বাকি টাকায় সংসার চালান তারা।
রবিবার (২৩ মার্চ) কমলগঞ্জ উপজেলার মনিপুরী অধ্যুষিত এলাকার কান্দিগাও, মাঝের গাও, বন্দরগাও, ঘোড়ামারা, আলীনগর ও মধাবপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সব বাড়িতে মনিপুরী নারীরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ঈদকে সামনে রেখে তাঁতের শাড়ি বুনতে ব্যস্ত রয়েছেন।
কথা হয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মৌমিতার সঙ্গে। তিনি বলন, ‘‘এক সময় আমাদের আয়ের বড় একটা অংশ আসত তাঁতশিল্প থেকে। ৯০ দশকের শেষের দিকে এসে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের নিপুণ কারিগর মনিপুরী নারীরা অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ২০০০ সালের শুরুতে মনিপুরী তাঁতের শাড়িসহ অন্যান্য কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘুরে দাড়াঁয় এ শিল্প।’’
এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত লুবনা আক্তার বলেন, ‘‘আমি বাণিজ্যিকভাবে তাঁতের শাড়ি তৈরির জন্য ৫০টি তাঁত মেশিন স্থাপন করেছি। ২৫টি সচল রয়েছে। সুতার দাম বৃদ্ধি, মজুরির খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভ কমে গেছে।’’
বন্দরগাঁও গ্রামের সুফিয়া আক্তার বলেন, ‘‘এখন মনিপুরী পাড়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে হস্তচালিত তাঁতের মেশিন আছে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে ২-৩ দিনের মধ্যে একটি শাড়ি তৈরি করা যায়। ঈদকে সামনে রেখে আমরা মুসলিম মনিপুরীরা ব্যস্ত সময় পার করছি। প্রতিটি শাড়ি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি করে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করব।’’
মাঝের গাঁও গ্রামের সুনীতি সিং বলেন, ‘‘শাড়ি কম বিক্রি হচ্ছে। এখন বাজারে মনিপুরী শাড়ির কপি চলে এসেছে। এতে আসল মনিপুরী শাড়ির কদর কমে গেছে।’’
ভানুবিল কমিনিটি ব্যাজ ট্যুরিজমের উদ্যোক্তা নারায়ণ সিং জানান, আসল মনিপুরী শাড়ি বুনুনকারীদের হাত থেকে টেকনোশিয়ানদের হাতে গিয়ে কপি হচ্ছে। এতে মনিপুরী শাড়ির দাম ও মান কমে যাচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হরেন্দ্র সিং ও তিলকপুর গ্রামের সাখাওয়াত মিয়া বলেন, ‘‘আমরা স্থানীয়ভাবে শাড়ি সংগ্রহ করে বিভিন্ন মহাজনদের কাছে সরবরাহ করি। কিন্ত সিজনের সময় তারা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেয়। পর্যটকদের কাছে মনিপুরী শাড়ির চাহিদা অনেক বেশি। মধ্যস্বত্বভোগীরা ভাগ বসিয়ে দেয়। এতে শাড়ি বুননকারীরা লোকসানে পড়েন। আসল মনিপুরী শাড়ি কিনতে হলে মনিপুরীদের হাত থেকে কেনা উচিত।’’
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘‘মনিপুরী শাড়ি কমলগঞ্জের ঐতিহ্য। এটা ধরে রাখার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আসলে আমি তাদের সহযোগিতা করব।’’
ঢাকা/বকুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর কমলগঞ জ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা।