জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আত্মপ্রকাশের এক মাসও পেরোয়নি। এরই মধ্যে দলটির শীর্ষ নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ ও সমন্বয়হীনতা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তাদের কয়েকজনের আচরণ ও কথাবার্তায় রাজনৈতিক বিবেচনাবোধের স্পষ্ট অনুপস্থিতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারসিজ আলম আলাদা পোস্ট দেন। একই ঘটনার দুই পোস্ট নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।  দলের অন্য শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন এ নিয়ে সরাসরি নিজেদের মন্তব্য দিতে থাকেন। সারজিসের পোস্টের নিচে মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘এসব কী ভাই! পাবলিকলিই বলছি, দু’জনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না। মানুষ এনসিপিকে নিয়ে যখন স্বপ্ন বুনছে, তখন এভাবে এনসিপিকে বিতর্কিত করা কাদের এজেন্ডা!’ 

হাসনাত ও সারজিস কি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? সারজিসের ভাষ্যে স্পষ্ট, তারা নিজেদের আগ্রহে সেখানে যান। সেখান থেকে ফিরে ১০ দিন পর দেওয়া হাসনাতের আক্রমণাত্মক ভাষ্যে তাঁর ‘অনভিজ্ঞতা’ ও ‘অদূরদর্শিতা’ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। পারস্পরিক অনানুষ্ঠানিক কথা উন্মুক্ত করে দেওয়া কোনো পক্ষের জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়।
যে প্রসঙ্গ নিয়ে এত জলঘোলা– ‘রিফাইন্ড’ বা পরিশোধিত আওয়ামী লীগকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুনর্বাসিত করবার চেষ্টা– তা কি আওয়ামী লীগের গণ্য করার মতো কোনো নেতা দাবি করেছেন? তারা তো দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই শূন্যতার পেছনে কেন ধাওয়া করছেন এনসিপি নেতৃবৃন্দ? জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের হিংস্র ভূমিকা চাক্ষুষ করেছে দেশের মানুষ; তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগ আগামীতে রাজনীতিতে থাকতে পারবে কিনা; বা থাকলে কোন নেতৃত্বের আওতায় থাকবেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল নিয়ে যেখানে আলাপ হতে পারে; তার বদলে কে কোথায় 
কী বলল, তাই নিয়ে শোরগোল বাধিয়ে মূল গন্তব্য থেকে দৃষ্টি দূরে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বুদ্ধিদীপ্ত ও ইতিবাচক নয়।

০২.


তাহলে দেশের জন্য মূল গন্তব্য কী? তা নিশ্চয় আওয়ামী লীগ পরিচালিত অগণতান্ত্রিক, একদলীয় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বেরিয়ে অবাধ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি। এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যথার্থ কাজ। সরকার যে ইতোমধ্যে ৬টি সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির কাজ শুরু করেছে, তা এই লক্ষ্যে পরিচালিত বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু এর মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্বের বিশৃঙ্খল কথাবার্তা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা ইত্যাদি অশুভ ইঙ্গিত দেয়। সেই আদি প্রশ্ন আবারও করতে হয়, হাসনাত বা সারজিস কি দলের পক্ষ থেকে আসন সমঝোতা প্রশ্নে আলোচনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা? তারা ব্যক্তিগত পরিসরে কার সঙ্গে কী আলোচনা করবেন, সেটি ইচ্ছে হলেই তারা চিৎকার করে বলতে পারেন? রাষ্ট্রে শৃঙ্খলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি যার যার পেশাগত ও ব্যক্তিগত মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা। গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ী নেতৃত্বের মর্যাদা যেমন অক্ষুণ্ন রাখতে হবে, তেমনি রক্ষা করতে হবে সব অংশীজনের মর্যাদা।

০৩.
জনমানুষের বিপুল ভালোবাসা পাওয়ার পরও ছাত্রনেতৃত্ব মাঝেমধ্যে এমন কিছু আচরণ করছেন, যাতে মনে হচ্ছে, তারা নিজেদের কাজ ও এসবের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন নন। তারা নানা বিষয়ে তর্ক করছেন, দাবি জানাচ্ছেন; কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর সাত মাসের বেশি সময় পার হলেও দেশের তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে নিজেদের কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনার কথা জানাতে পারেননি। দেশে প্রতিবছর ২৬ থেকে ২৭ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ চাকরিপ্রার্থী হয়। এদের কর্মসংস্থান কোথায়, কীভাবে হচ্ছে? নাকি সকল তরুণ আগামীতে এনসিপিতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেবে? এই পার্টির কর্মী নিশ্চয়ই সার্বক্ষণিক নয়, এই বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা যেমন সুস্পষ্ট হওয়া উচিত, তেমনি জরুরি পার্টি নেতৃবৃন্দের পেশার বিষয়টিও পরিষ্কার করা। রাজনৈতিক দলের আয়ের উৎস পরিচ্ছন্ন না হলে সেই দল থেকে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আশা করা যায় না। 

০৪.
দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি প্রশ্নে বিপুল কথাবার্তা ছাত্রনেতৃবৃন্দের সমান্তরালে অন্তর্বর্তী উপদেষ্টারাও বলে চলেছেন। সমকাল জানিয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না। তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।” (২১.০৩.২৫) 

যা প্রতিষ্ঠিত সত্য, সেসব পরিবর্তন করে আসলে কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় বর্তমান সরকার? মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকবেন না।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’! রাজনৈতিক চার শতাধিক নেতাও তাই? মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল কোন প্রক্রিয়ায়? কারা তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? কার আহ্বানে ও নেতৃত্বে সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ইতিহাসে নির্ধারিত। শেখ মুজিবের অবদান শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পত্তি নয়। কন্যার অপরাধে জাতির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আর দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস পরিবর্তনের এই পুরোনো ধারা দেশের অগ্রগতিতে আদৌ ভূমিকা রাখে না। বর্তমান বাংলাদেশের বিকাশের পথে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কি? নইলে এসব সংস্কারে মনোযোগী কেন সরকার? দেশের আইনশৃঙ্খলা ন্যুব্জ, অর্থনীতি পর্যুদস্ত ও লুণ্ঠিত, শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত, বেকার সমস্যা আকাশছোঁয়া– এসবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নজরদারি ও নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী নির্বাচিত সরকারের সামনে তা উদাহরণ হয়ে থাকতে পারত। তা না করে আজ মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা, কাল চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আনন্দ শোভাযাত্রায় পরিণত করা, দেশের মানুষের জন্য আদৌ নতুন কোন শুভ যোগ করবে? এ নিয়ে সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা সরকারি কোনো উদ্যোগ নয়, ছিল না– এখানেও হাত দিতে হবে কেন সরকারকে? মঙ্গল শব্দটিতেই বা কেন এত বীতরাগ? স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সুলতানি আমলের মিছিলের অনুসরণে ঈদ মিছিল হবে এবার। সুলতানি আমলে সম্ভবত পুরুষরাই কেবল এই মিছিলে অংশ নিতেন। আমরা কি সুলতানি আমলেই ফিরে যাব? এবারও ঈদের মিছিলে কেবল পুরুষরাই থাকবে, নাকি নারীদের অংশগ্রহণ অনুমোদন করবে সরকার? নারীরা মিছিলে অংশ নিলে তাদের পোশাক কী হবে? বিভিন্ন ভাষণে, মাহফিলে যেভাবে নারীদের পোশাক নিয়ে বয়ান দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে সংশয় জাগা বিচিত্র কিছু নয়।

চারপাশে এত সংশয় ও অস্থিরতার নেপথ্যে যার যার সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে স্থির না থেকে অন্যান্য কাজে বেশি মনোযোগী হওয়াই কারণ। অন্তর্বর্তী সরকারের নামের মধ্যেই রয়েছে তাদের কার্যপরিধির ইশারা; অন্তর্বতী সরকার– অর্থাৎ আরেকটি সরকার আসবার আগের মধ্যবর্তী সময়কালের জন্য যে সরকার। কাজেই নির্বাচিত সেই সরকার আসবার আগে, ন্যূনতম সময়ের মধ্যেই ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপের নানা কসরত অবশ্যই সন্দেহ দানা বাঁধায়। বিশেষত প্রতিষ্ঠিত সত্য ও প্রচলিত সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে গায়ের জোর খাটিয়ে পরিবর্তনের চেষ্টা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবার পরিবর্তে আরও বিভাজিত ও পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করবে। 

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এনস প গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক ক র কর ক ত কর র জন য আওয় ম এনস প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাগরিক সমাজ শাসকদের পক্ষে থাকে কেন?
  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি