পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কোনো নির্বাচন হয়নি। সত্তরে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু নির্বাচনের রায় উপেক্ষা করে গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যে গণহত্যা চালানো হয়, তা নিছক মানুষ হত্যা ছিল না; ছিল জেনোসাইড। জেনোসাইড শুধু ‘ম্যাস কিলিং’ বা ‘ব্যাপক হারে হত্যা’ নয়। বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা ধর্ম-বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ ও পীড়ন, যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটাই জেনোসাইড। যেহেতু বাঙালি তার স্বাধিকার সংগ্রামের এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলন করেছিল, সে কারণে তারা বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে।
২৫ মার্চে অপারেশন সার্চলাইট নামে তারা পরিকল্পিতভাবেই ‘জেনোসাইড’ সংঘটিত করে। এই জেনোসাইডের ব্যাপকতা ও নৃশংসতাও ছিল ব্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প সময়ে এত ব্যাপক গণহত্যা কোথাও দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। একে পরিকল্পিত গণহত্যা বলার কারণ হলো, বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে নির্বিচারে গণহত্যা হয়েছে।

 এমন কোনো জেলা বা উপজেলা সদর নেই, যেখানে গণহত্যা চালানো হয়নি। গণহত্যার ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়কেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। কারণ তাদের ধারণা ছিল, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই স্বাধিকার আন্দোলনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ধারণা ছিল, যারা বুদ্ধিজীবী তথা শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসকরাও এই স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা জোগাচ্ছে। সে জন্য তাদের চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যে জেনোসাইড হয়েছে, তার পর বাংলাদেশে আমরা যদি একটি মানবিক সমাজ গড়তে চাই, তবে এমন অমানবিক, মানবতাবিরোধী এই হত্যাকাণ্ডের স্মারকগুলোর সুরক্ষা খুব প্রয়োজন। এতে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের কাছে বর্তমান প্রজন্মের যেই ঋণ আছে, সে ঋণ শোধ হতে পারে। দেশ স্বাধীন না হলে তো আমরা কিছুই পেতাম না। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আকাঙ্ক্ষাই হয়তো পূরণ হয়নি। অনেকের স্বপ্ন ছিল, সেখানে আশাভঙ্গ হয়তো হয়েছে; কিন্তু যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের ঋণ অস্বীকার করা যাবে না। আমরা দেখেছি, বধ্যভূমিগুলো সময়ের পরিক্রমায় স্থাপনা হয়ে গেছে। এগুলোর স্মারক থাকা দরকার ছিল, অর্থাৎ এখানে মুক্তিযুদ্ধে এতজন শহীদ হয়েছেন। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি থাকার দরকার ছিল। এটি সরকারিভাবে না হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে করা যেত। এ তো গেল আমাদের করণীয়।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে এই অর্থে যে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে জেনোসাইডের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে কিছু গবেষণা হয়েছে, একাডেমিক কাজ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকের কাজে বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্তত বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এ গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি জোরালো হয়েছে। জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সে জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া মুক্তি সম্ভব ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ নিয়ে লড়াই হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেকে সাহায্য করেছেন। এভাবে যারাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা যাবে না। কাউকে সম্মান করতে গিয়ে অপরকে যেন অসম্মান না করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা, তিনি রাজনীতিবিদ হোন বা সেনাবাহিনীর সদস্য হোন কিংবা সাধারণ মানুষ হোক কিংবা শিল্পী-সাহিত্যিক হোক; যে যেভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন, সেভাবে তাদের সম্মান করা দরকার।
ডা.

সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ বস গণহত য র

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল