রোববার সকালে এক সহকর্মীর ফেসবুকে খবরটি দেখে শঙ্কিত হই। তিনি লিখেছেন, ২৯ মার্চ বাংলামোটরে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁর স্ত্রী ও পুত্র আহত হন। পথচারী ও পুলিশের সহায়তায় তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁরা এখন বাসায় সুস্থ আছেন। রিকশাচালকও সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন ওই সহকর্মী। এ ধরনের ঘটনায় চালকদের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। তিনি রেখেছেন।

কিন্তু ওই চালক ভাই কি নিয়মমতো রিকশা চালিয়েছিলেন? শুনেছি তিনি নিয়ম মানেননি। দ্রুত চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন। নিয়ম মানলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এটা সব যানবাহেনর জন্য সত্য। অধিকাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক বেপরোয়া গতিতে চালান। ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে।

কয়েক দিন আগের খবর। সকালে রমনা পার্কে হাঁটতে বের হয়েছিলেন একজন অভিনেত্রী। হেঁটে বাসায় ফেরার সময় গলির ভেতর হঠাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা তাঁকে ধাক্কা দেয়। তিনি রাস্তায় পড়ে গেলে গায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় অটোরিকশাটি।

মাসখানেক আগে এক সাংবাদিক বন্ধু তেজগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার আসতে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন। তিনিও ব্যাটারিচালিত রিকশায় ছিলেন। রিকশার সামনে দিয়ে যাওয়া একটি কুকুরকে বাঁচাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সেই রিকশাও চলছিল বেপরোয়া গতিতে।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগই মোটর সাইকেলে। এরপরই ব্যটারিচালিত তিন চাকার রিকশা।

ময়মনসিংহের খবরটি খুবই মর্মান্তিক। এক দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু। গৌরীপুরে ট্রাকের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের মা, দুই মেয়ে ও তাদের নানি নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও দুজন। গাজীপুর এলাকার প্রগতি ফিড মিলের সামনে ময়মনসিংহগামী ট্রাকের সঙ্গে গৌরীপুরগামী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পুলিশের ভাষ্য, ঈদের ছুটিতে তাঁরা ময়মনসিংহের বাসা থেকে অটোরিকশায় করে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে অটোরিকশাটিকে ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক ধাক্কা দেয়।

খবরে আরও জানা গেল, অটোরিকশাটি যিনি চালিয়ে নিচ্ছিলেন, তিনি একজন প্রতিবন্ধী। আমরা এমন দেশ করলাম, একজন প্রতিবন্ধীকেও রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের পাশে দাড়ায় না।

গণপরিবহনের স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারা দেশ ছেয়ে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় এক ছাত্রী মারা যান। সে সময়ে অটো রিকশা বন্ধের দাবি জানিয়ে আদালতে রিট করা হয়েছিল। রাস্তায় নেমেছিলেন প্যাডেল চালিত রিকশাচালকেরাও। ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে তাঁদের রোজগার কমে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রিট টেকেনি। এখন ঢাকার রাস্তায় প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত বিকশার সংখ্যা বেশি। এর চালকেরাও গরিব মানুষ।

মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এর স্টেশনগুলো ঘিরে ব্যাটারিচালিত রিকশার ভিড় বেড়েছে। যানজট থাকলে বিপদ কম; কিন্তু ফাঁকা রাস্তা পেলেই চালকেরা বেপরোয়া গতিতে চালান এবং প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন।

অটো বন্ধ হলে তাদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে আমরা মনে করি, বিকল্প কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ব্যটারিচালিত রিকশা চলুক। তবে চালক ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ থাকবে, একটু আস্তে চালান ভাই। আপনিও বাঁচবেন। যাত্রীও বাঁচবেন।

গত ২১ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বৈধ যানবাহন আছে ৬২ লাখের মতো। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ তিন চাকার যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। অথচ উন্নত দেশগুলোতে মানুষের প্রধান ভরসা গণপরিবহন। সেখানে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে গণপরিবহনে চলাচল করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো সরকারই গণপরিবহনের ওপর গুরুত্ব দেয় না। গণপরিবহন সবল হলে এখন যে পরিবহন খাতে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে সেটা থাকবে না। এ কারণে পরিবহন খাতের মালিক মোক্তারেরা সমস্যা জিইয়ে রাখতে পছন্দত করেন। সরকার বদলের পর চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না। চাঁদার গ্রহিতা বদল হন মাত্র।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। প্রাণহানির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তিন চাকার যানবাহন। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১ হাজার ৯২৪ জন; যা মোট নিহত মানুষের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর তিন চাকার যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, অটোভ্যান ইত্যাদির দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৭ জন মারা গেছেন; যা মোট নিহত মানুষের ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকার নিবন্ধন দেয় না বলে এগুলোকে অবৈধ যানবাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আমাদের দেশে একসময় হাতে টানা রিকশা ছিল। কলকাতায় গেলে এখনো দু–চারটি দেখতে পাওয়া যায়। টানা রিকশার তুলনায় প্যাডেলচালিত রিকশা ছিল একটি ‘বিপ্লব’। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে টেনে নিচ্ছেন, এটা অমানবিক। সে ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আরও বেশি স্বস্তি দিতে পারত, যদি না ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটত।

ব্যাটারিচালিত রিকশা চলুক; তবে নিয়মকানুনের মধ্যে। এই বাহনটি নিরাপদ করতে হলে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গতিসীমা ঠিক করে দিতে হবে। অনেক আগে একটি স্লোগান লেখা থাকত বাসের পেছনে, ‘একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না’। ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় পড়লে চালক ও যাত্রী উভয়ের জীবন বিপন্ন হয়। ময়মনসিংহের যেই পরিবার ঈদে বাড়িতে যাচ্ছিল, তারা কখনোই ভাবতে পারেনি, চার চারটি জীবন এভাবে চলে যাবে।

আমরা আশা করব, এই ঈদের ছুটিতে যানবাহন চালানোর ব্যাপারে সবাই সতর্ক থাকবেন। কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করবেন না। মনে রাখতে হবে, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন য় প গণপর বহন ক দ র ঘটন পর বহন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতি মেয়ে

ফরিদপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর কমিটি গঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা।গত মঙ্গলবার এনসিপির সদস্যসচিব আক্তার হোসেন ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ওই চিঠিতে ফরিদপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছে মো. আব্দিুর রহমানকে এবং সংগঠক করা হয়েছে মো. রাকিব হোসেনকে।
 
এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের পাঁচটি জেলা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী জেলার দু’জন করে ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।  

ফরিদপুর জেলার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যে দু’জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের একজন হলেন সৈয়দা নীলিমা দোলা। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে এবং জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ নাসিরের ভাগনি। দোলার বাবা সৈয়দ গোলাম দস্তগীর পেশায় ব্যবসায়ী।

সৈয়দা নীলিমা ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। বর্তমানে ‘সিনে কার্টেল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী।
 
এ বিষয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী রাজনীতি করা সংক্রান্ত কিছু পোস্ট আপনাদের সামনে আসতে পারে। আমি নিজে এর একটা ব্যাখ্যা রাজপথের সহযোদ্ধাদের দিয়ে রাখতে চাই। আমি ১০ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করছি। নো মেট্রো অন ডিইউ মুভমেন্ট, রামপাল বিরোধী আন্দোলন, ডিএসএ বাতিলের আন্দোলন, সুফিয়া কামাল হলকে ছাত্রলীগ মুক্ত করাসহ অন্যান্য সকল আন্দোলনে আমি পরিচিত মুখ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লেখালেখিও পুরনো। ২০১২ সালে পরিবার ছাড়ার পর রাজপথই আমার আসল পরিবার। জুলাইয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অন্যতম মামলা তাহির জামান প্রিয় হত্যা মামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরাসরি ছাত্রলীগ করে অনেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আমি কখনও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তাই আমার নাগরিক কমিটির সদস্য হতে বাধা কোথায়? এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেনে-বুঝে এবং আমি ‘লিটমাস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে।’ 

আওয়ামী লীগ নেত্রীর মেয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন জেলার এনসিপি কমিটি গঠনে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব সোহেল রানা বলেন, ‘তার (সৈয়দা নীলিমা) পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড আওয়ামী লীগ। আমরা দেখেছি, গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে তার মামা গোলাম নাসির কিভাবে আমাদের ওপর নির্বিচার গুলি ছুড়েছিল। তার মায়ের কর্মকাণ্ডও আমাদের অজানা নয়।’ 

সৈয়দা নীলিমা দোলার সঙ্গে আমাদের পরিচয় পর্যন্ত নেই মন্তব্য করে সোহেল রানা বলেন, ‘আসলে দায়িত্ব দেওয়ার আগে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হলে ভাল হতো। যাচাই-বাছাই করা হলে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বগুড়ায় সারজিসের উপস্থিতিতে মারামারির ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ৪ নেতা হাসপাতালে
  • অমিতাভের চিরকুট কিংবা ফ্যাশন নিয়ে রাধিকার ১০ প্রশ্নের জবাব, ১০ ছবি
  • মাঠ নিয়ে শ্রাবণের আফসোস
  • একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
  • বড় বন্দরে ভারী কাজ করেও চলে না সংসার 
  • নাটোরে ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল একজনের
  • ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতির মেয়ে
  • ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতি মেয়ে
  • দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত নিতে হতো: নাহিদ ইসলাম
  • স্পেন ও পর্তুগালে ভয়াবহ বিদ্যুৎবিভ্রাট, সব ধরনের গণপরিবহনে বিপর্যয়