ফিলিস্তিনের গাজা বহুদিন ধরেই এক মৃত্যু উপত্যকা। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না ইসরায়েলি মৃত্যুদানবের হাত থেকে। ইসরায়েলের বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছে গাজার হাজার হাজার শিশু। যেসব শিশু বেঁচে আছে; মৃত্যুভয়, অবর্ণনীয় দুর্দশা, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তারাও যেন জীবন্মৃত। ইসরায়েল এতটাই নির্দয় যে, ফিলিস্তিনে কোনো মানবিক সহায়তাও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কত শিশু বাবা হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে; কত শিশু মা, ভাইবোন হারিয়ে নির্বাক; ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে কত শিশু; কেউ জানে না। তাদের শৈশব বলে কিছু নেই। শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই জানুয়ারিতে বলেছিলেন, ইসরায়েল গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলা চালিয়েছে। ৯০ শতাংশের বেশি স্কুল ধ্বংস করেছে। এমনকি স্কুল ভবনে আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশুরাও হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো গাজাই যেখানে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; গাজাবাসীর জীবন বাঁচানোই যেখানে দায়; তাদের শিশুর শিক্ষার কথা চিন্তা করা অকল্পনীয়। 

গাজাস স্টোলেন চাইল্ডহুড বা গাজার চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব শিরোনামে আলজাজিরা ২৬ মার্চ একটি ‘লংফর্ম স্টোরি’ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ইসরায়েল প্রতি ৪৫ মিনিটে গাজার একটি শিশুকে হত্যা করছে। তার আগের প্রায় সাড়ে পাঁচশ দিনে প্রতিদিন প্রায় ৩০টি শিশু হত্যা করেছে। সে হিসাবে ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে সাড়ে ১৭ হাজার শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। যার মধ্যে সাড়ে ১৫ হাজার শিশুকে চিহ্নিত করা গেছে, বাকিদের কবর হয়তো হয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। এর মধ্যেও কেউ বেঁচে আছে কিনা, কে জানে! 
ইসরায়েলি বোমায় এমন হাজারো শিশু শহীদ হয়েছে, যারা প্রথম জন্মদিনও পালন করতে পারেনি। ১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর শহীদ হয়েছে মোহাম্মদ, যার গল্প তুলে ধরেছে আলজাজিরা। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ১৮ মার্চ যখন ইসরায়েল গাজায় পুনরায় বোমা হামলা শুরু করে, তার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ৩৩৬ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ১৮৩ শিশু, যেখানে ১ বছরের মোহাম্মদ তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সঙ্গে শহীদ হয়। আল মাওয়াসি ক্যাম্পে বিমান হামলায় তারা শহীদ হয়। এটি এমন ক্যাম্প, যাকে ইসরায়েল বলেছিল ‘সেফ জোন’। এমন আরও বহু কথিত নিরাপদ পরিসরে ফিলিস্তিনি শিশু ও নিরীহ নাগরিক প্রাণ হরিয়েছে। এভাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ৫০ সহস্রাধিক মানুষকে শহীদ করেছে ইসরায়েল। যেখানে এক-তৃতীয়াংশ শিশু ছাড়াও আছে নারী, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী, মানবিক সহায়তাকারী, শিক্ষক, চিকিৎসক। হামলা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতাল, এমনকি রোগীরাও।

দেড় বছরের অধিক সময় ধরে ইসরায়েল গাজায় এমন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট কাফন মোড়ানো কফিন নিয়ে হাজারো পিতা-মাতা-স্বজনের আর্তনাদ আমরা দেখছি। সাধারণ বিবেকসম্পন্ন মানুষ এমন একটি হত্যাকাণ্ডও মেনে নিতে পারে না। অথচ ইসরায়েল একটি প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে– কী করছে বিশ্ববিবেক। কেবল এই দেড় বছরই নয়; ইসরায়েল নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে যুগ যুগ ধরে। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে সেই ফিলিস্তিনিদের ওপরেই গণহত্যা চালানোর পর ইসরায়েলের কিছুই হচ্ছে না কেন? কারণ ইসরায়েলের খুঁটির জোর আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াও ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গাইছে। অথচ তারাই কিনা সারা পৃথিবীকে শান্তির সবক দিচ্ছে!
নিষ্পাপ, নিরীহ ইসরায়েলি শিশুরা প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে, তাতে এমনকি মুসলিম বিশ্বেরও টনক নড়ছে না। মুসলমানদের কয়েকটি দেশ নামকাওয়াস্তে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অথচ ইসরায়েল ঘিরে আছে মুসলিম বিশ্ব। মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরায়েলে এমন আগ্রাসন চালানো কি সম্ভব হতো?
আমরা জানি না, আরব বিশ্বের নেতাদের কবে ঘুম ভাঙবে। ইসরায়েলি বর্বরতার সরাসরি সম্প্রচার আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। গাজার প্রাণ হারানো মায়ের হাহাকার কি মুসলিম বিশ্বের নেতাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে না?

শিশু হত্যাসহ ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধের হাজারো দলিল বিশ্বের মিডিয়ায় বিরাজমান। মানবাধিকার ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলোও ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাও হয়েছে। তাতেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কিছুই হচ্ছে না। জাতিসংঘ মহাসচিবও বারবার নিন্দা জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ১৮ মার্চের পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যেন তাঁকে ফিলিস্তিনিদের হত্যার সব লাইসেন্স দিয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ কম হচ্ছে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছে। যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্ব-জনমত বোঝার চেষ্টা করছে না।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যখনই ভোট হয়; যুক্তরাষ্ট্রসহ ৪-৫টি দেশ বাদে প্রায় সবাই  ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোট দেয়। কয়েকটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। কিন্তু জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো শক্তির কাছে অসহায়। ভেটোধারী অন্য দেশগুলোও কার্যকর কিছু করছে না। এ বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়মভিত্তিক হয় কীভাবে? 
ইসরায়েলি হতভাগা শিশুরা আজ হয়তো ঐশ্বরিক শক্তির দিকেই তাকিয়ে আছে। বোমার আঘাতে মৃত্যুর আগে সিরিয়ার এক শিশু বলেছিল– আমি আল্লাহকে সব বলে দেব। ফিলিস্তিনি শিশুরাও কি বলে দেবে না? এত রক্ত, এত প্রাণহানি, এত জুলুম! প্রকৃতিইবা সইবে কীভাবে? আমরা অসহায় গাজার শিশুদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। আমরা হতাশ মুসলিম বিশ্ব নিয়ে। আমরা বিস্মিত পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকার নিয়ে। তবে এই জুলুমের শেষ হবে; হতেই হবে। না হলে এ যে আর মানুষের পৃথিবী থাকবে না।

মাহফুজুর রহমান মানিক: 
জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.

manik@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ব

এছাড়াও পড়ুন:

ইসলামবিরোধী প্রস্তাবনা রুখে দেওয়া হবে: মামুনুল হক

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কুরআন-সুন্নাহবিরোধী প্রতিবেদনসহ কমিশন বাতিল, সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, ফ্যাসিবাদের আমলে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যাসহ সব হত্যার বিচার এবং ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে ৩ মে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। মহাসমা‌বে‌শের জন‌্য প্রস্তু‌তি শেষ করা হ‌য়ে‌ছে। হেফাজত নেতা‌দের মামলা প্রত‌্যাহার কর‌তে হ‌বে এবং ইসলাম বি‌রোধী সব প্রস্তাবনা বা‌তিল কর‌তে হ‌বে। অন‌্যথায় দে‌শের জনগণ‌কে স‌ঙ্গে নি‌য়ে এসব প্রস্তবনা রু‌খে দেওয়া হ‌বে।

মঙ্গলবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে মাখজুনুল উলুম মাদরাসা প্রাঙ্গনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা এসব কথা ব‌লেন।

সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক বলেন, “নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা দেশের পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের টার্গেটে করা হয়েছে। ইসলাম বিরোধী এসব প্রস্তাবনা যেকোন মূল্যে রুখে দেওয়া হবে।”

আরো পড়ুন:

নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ৫ দাবি, হেফাজ‌তের মহাসমাবে‌শ ৩ মে

শহীদের রক্তের দায় ক্ষমা করা যায় না: ইউনুস আহমাদ

হেফাজতের নেতাদের নামে দায়ের করা মামলা এখনো প্রত্যাহার না করার ক্ষোভ প্রকাশ করে তি‌নি বলেন, “চার মাস আগে মামলার তালিকা আইন উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সাথেও এ বিষয়ে দেখা করে দাবি জানানো হয়েছে। তারপরও এখনো মামলা প্রত্যাহার না করা দুঃখজনক।”

মামলা না তোলায় হেফাজত নেতাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান বলেন, “৩ মে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশ সফলে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী, ড. আহমদ আব্দুল কাদের, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস কাসেমী, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী, মাওলানা জহুরুল ইসলাম, মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সোবহানী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্মমহাচিব মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা মীর ইদ্রিস, সহকারী মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা জসিম উদ্দিন, মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন মুফতি বশিরুল্লাহ, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার মাৌওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা মজিবুর রহমান, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী, মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী, মুফতি কামাল উদ্দিন, মুফতি মজিবুর রহমান চাটগামী, ড. শোয়াইব আহমদ, মুফতি ইলিয়াস হামিদী, মাওলানা রাশেদ বিন নুর, মাওলানা কবি মুহিব খান, মুফতি শরীফ উল্লাহ, মাওলানা আফসার মাহমুদ, মুফতি আব্দুল মালেক প্রমুখ।

এদিকে মহাসমাবেশ সফল কর‌তে মাদরাসায় বাস্তবায়ন কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। হেফাজতের মহাসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা মীর ইদ্রিস, সহকারী মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা জসিম উদ্দিন, মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী, মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা রাশেদ বিন নুর, মাওলানা আফসার মাহমুদ প্রমুখ।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘একদিন দেখি পশুরমতো ঘরের কোণে বসে কাঁপছে ববি’
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৫১ ফিলিস্তিনি নিহত
  • বিশ্বনেতাদের সতর্ক দৃষ্টির সামনেই ঘটছে গণহত্যা
  • ইসলামবিরোধী প্রস্তাবনা রুখে দেওয়া হবে: মামুনুল হক
  • প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিক খুলে ‘এমবিবিএস ডাক্তার’ পরিচয়ে চিকিৎসা, এক বছরের কারাদণ্ড
  • রাখাইনে করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হেফাজতের
  • ইয়েমেনে মার্কিন হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা ইরানের
  • ‘শি জিনপিং ফোন করেছিলেন’ ট্রাম্পের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান চীনের
  • শি জিনপিং ফোন করেছিলেন, ট্রাম্পের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান চীনের
  • ভুলে সীমানায় পা, বিএসএফ সদস্যকে আটক করল পাকিস্তান