ভারতে ন্যাশনাল হেরাল্ডের বিপুল সম্পত্তির দখল নিতে নোটিশ দিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থা নোটিশ জারি করে জানিয়েছে, সব মিলিয়ে ৬৬১ কোটি রুপির অস্থাবর সম্পত্তির দখল তারা নিতে চলেছে। দিল্লি ও লক্ষ্ণৌয়ে ন্যাশনাল হেরাল্ড ও অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের (এজেএল) দপ্তর খালি করে দিতে বলা হয়েছে। মুম্বাইয়ের ভাড়াটেকে বলা হয়েছে, তারা যেন ভাড়ার টাকা ইডির কাছে জমা দেয়।

প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট বা বেআইনি আর্থিক লেনদেন প্রতিরোধ আইনের (পিএমএলএ) অষ্টম অনুচ্ছেদের ৫(১) ধারায় ইডি গতকাল শুক্রবার এই ব্যবস্থা নিয়েছে বলে পিটিআই জানিয়েছে। ২০২৩ সালে এই অস্থাবর সম্পত্তি ইডি বাজেয়াপ্ত করেছিল। ইডি ওই সম্পত্তি দখল করা নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার সম্পত্তি নিবন্ধকদেরও নির্দেশ পাঠিয়েছে।

ন্যাশনাল হেরাল্ড খবরের কাগজ স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। জওহরলাল নেহরু ১৯৩৮ সালে এই কাগজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিল এজেএল, যার শেয়ারহোল্ডার ছিলেন ৫ হাজার স্বাধীনতাসংগ্রামী। ওই সংস্থা ইংরেজিতে ন্যাশনাল হেলারল্ড ছাড়া হিন্দিতে প্রকাশ করত নবজীবন ও উর্দুতে কৌমি আওয়াজ।

কংগ্রেস দল ২০০৮ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকা ছাপিয়েছে। কিন্তু ওই বছর আর্থিক কারণে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে তা ডিজিটাল সংস্করণে ছাপা শুরু হয়।

ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা করেছিলেন বিজেপি নেতা সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামী। তাঁর অভিযোগ, গান্ধী পরিবার কংগ্রেস দলের তহবিল ব্যবহার করে এজেএলের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি দখল করেছে। ২০০৮ সালে কাগজটি বন্ধ হওয়ার সময় এজেএলের ঋণ ছিল ৯০ কোটি রুপি। এই দেনার প্রায় পুরোটাই ছিল কংগ্রেসের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ।

সেই সময় ইয়ং ইন্ডিয়ান নামে এক সংস্থা এজেএল অধিগ্রহণ করে মাত্র ৫০ লাখ টাকায়। ইয়ং ইন্ডিয়ান সংস্থার ৩৮ শতাংশ করে শেয়ার ছিল সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর। বাকি ২৪ শতাংশ ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মোতিলাল ভোরা, অস্কার ফার্নান্ডেজ, সুমন দুবে ও স্যাম পিত্রোদার। ওই অধিগ্রহণের ফলে এজেএলের ৯০ কোটির দেনাসহ সব সম্পত্তির মালিক হয় ইয়ং ইন্ডিয়ান। এরপরই কংগ্রেস জানায়, ন্যাশনাল হেরাল্ডকে দেওয়া ৯০ কোটির ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু তা ফেরত পাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই।

সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামীর অভিযোগ, রাজনৈতিক দল বলে কংগ্রেসকে আয়কর দিতে হয় না। কোনো বাণিজ্যিক সংস্থাকে কংগ্রেস এভাবে টাকাও দিতে পারে না। তাঁর দাবি, দিল্লি, মুম্বাই, পাটনা, লক্ষ্ণৌ, ভোপাল, ইন্দোরসহ বিভিন্ন শহরে ন্যাশনাল হেরাল্ডের স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা। তার কিছুটা বিক্রি করেই ইয়ং ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের ঋণ মেটাতে পারত। কিন্তু তা না করায় দলের আয়করমুক্ত অর্থ ঘুরপথে চলে গেল গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের কাছে।

স্বামী ২০১২ সালে সোনিয়া, রাহুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১৪ সালের জুনে আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। সেই মামলায় সোনিয়া ও রাহুল জামিনে রয়েছেন। মালিকানা হস্তান্তরে বেআইনি লেনদেন হয়েছিল কি না, ইডি সেই তদন্তই করছে। এবার শুরু হলো সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের প্রক্রিয়া।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন ড য় ন

এছাড়াও পড়ুন:

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে

ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।

হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।

মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।

ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।

আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫

কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।

টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।

হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ  আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।

আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪

আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।

এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।

আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫

কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।

সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।

তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাস্ট ওয়েট করুন, কিছু দিনের মধ্যে ঘোষণা শুনবেন: আসিফ নজরুল
  • মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে