হিন্দি নিয়ে সহিংস হচ্ছে ভারতের মহারাষ্ট্র
Published: 11th, July 2025 GMT
ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রে ভাষা ও পরিচয় নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক বিবাদ চলছে। এপ্রিল মাসে মহারাষ্ট্র সরকার রাজ্য পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি এবং মারাঠি (রাজ্যের প্রধান ভাষা) ছাড়াও তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি শেখানো বাধ্যতামূলক করার পর এই বিরোধ শুরু হয়।
১৯৬৮ সালে প্রবর্তিত জাতীয় শিক্ষা নীতি (এনইপি) ভারতে শিক্ষার প্রচার ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কাজ করে এবং সরকার মাঝে মাঝে এটি আপডেট করে। পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রবর্তিত নীতির সর্বশেষ পুনরাবৃত্তিটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আগেও ভাষা নিয়ে মোদির শিক্ষানীতি বিতর্কিত হয়েছে।
মহারাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন নাগরিক সমাজের গোষ্ঠী, ভাষা কর্মী এবং বিরোধী নেতারা। তাদের অভিযোগ, রাজ্যে হিন্দি - যা মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলোর ভাষা-তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
ভাষা ভারতে একটি সংবেদনশীল বিষয়। স্বাধীনতার পর মহারাষ্ট্রসহ অনেক রাজ্য ভাষাগত ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। স্থানীয় ভাষা প্রায়শই আঞ্চলিক গর্ব এবং পরিচয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপারে যেকোনো পরিবর্তন রাজ্যগুলোতে হুমকি হিসেবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর, ভারতের সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিত বেঙ্গালুরুতে কন্নড় ভাষার কর্মীরা বিলবোর্ডগুলো কেবল ইংরেজি নয়, স্থানীয় ভাষায় লেখার দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।
কিন্তু ভারতের সর্বাধিক কথ্য ভাষা হিন্দির ক্ষেত্রে অস্বস্তি বিশেষভাবে বেশি। বছরের পর বছর ধরে হিন্দি প্রচারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপগুলো অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর মধ্যে এক আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে- হিন্দির প্রভাবে স্থানীয় সংস্কৃতি বিলীন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অভয় দেশপাণ্ডে জানান, ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর এই উদ্বেগগুলো আরো বেড়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা - হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে শক্তিশালী। তারা প্রায়শই হিন্দিকে বিশেষাধিকার দেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
মহারাষ্ট্রে উত্তেজনা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন জোট শাসিত রাজ্য সরকার তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে এবং তিন ভাষা নীতি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করে। কিন্তু বিতর্ক থামার নাম নেই।
ভারতের সবচেয়ে ধনী পৌর করপোরেশন মুম্বাই শহরসহ রাজ্যে দীর্ঘ বিলম্বিত পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তার কয়েক মাস আগে এই বিরোধ শুরু হয়েছে। এটি ক্ষমতাসীন জোট এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক লড়াইয়ের সূত্রপাত করেছে। প্রতিটি পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক খেলার অভিযোগ করছে।
রাজ্যে অ-মারাঠিভাষীদের বিরুদ্ধেও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
এপ্রিল মাসে মুম্বাইতে একজন নিরাপত্তারক্ষীকে বিরোধী দল মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস)-এর কর্মীরা মারধর করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কারণ ওই নিরাপত্তারক্ষী বলেছিলেন যে তিনি মারাঠি জানেন না।
মে মাসে, মুম্বাইয়ের এক দম্পতি মারাঠি ভাষায় কথা বলতে অস্বীকৃতি জানানোর পর একজন ডেলিভারি এজেন্টকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। গত সপ্তাহে, মারাঠি না বলার জন্য একজন দোকান মালিককে এমএনএস কর্মীরা লাঞ্ছিত করার একটি মর্মান্তিক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল।
যদিও এই বিষয়টি সামাজিক বিভাজন বৃদ্ধি করেছে বলে মনে হচ্ছে, তবুও বিচ্ছেদের প্রায় দুই দশক পর এটি দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে একত্রিত করেছে।
গত সপ্তাহে রাজ্যের বিরোধী দল শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে এবং এমএনএসের নেতা হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগের বিরোধিতা করার জন্য যৌথ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। হিন্দির বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য রাজ্যের দুই বিরোধী দল দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে জোট করেছে।
সাংবাদিক ও সাবেক রাজনীতিবিদ প্রশান্ত দীক্ষিত বলেন, “মারাঠি ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়টি জনগণের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। এটি একটি আবেগপ্রবণ বিষয়, বিশেষ করে মুম্বাইতে বসবাসকারী মানুষের জন্য।”
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন ত ক র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ