রাজনৈতিক উপন্যাসের স্মরণীয় কণ্ঠস্বর
Published: 17th, April 2025 GMT
৭ মার্চ ২০১০। নিউ ইয়র্কের আকাশে ভোরের আলো কেবল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আজ ঘুম থেকে আগেই উঠে পড়েছেন অধ্যাপক; ম্যানহ্যাট্টানের সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দূরে কুয়াশার মধ্যে হাডসন নদীর অপর তীরে স্ট্যাচু অব লিবার্টির ছায়া দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে লেখার টেবিলে ফিরে এলেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফল সেমিস্টারের ক্লাস নিচ্ছেন। সপ্তাহে সোম আর বৃহস্পতিবার দুটো ক্লাস। আজ বৃহস্পতিবার, ক্লাস দেড়টা থেকে ৪টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। আজকের বিষয় আলেহো কার্পেন্তিয়ারের উপন্যাস, বিশেষ করে কার্পেন্তিয়ারের উপন্যাসের রচনা-কৌশল। প্রথম পর্যায়ের ম্যাজিক রিয়ালিস্ট আলেহো কার্পেন্তিয়ার তাঁর প্রিয় লেখকদের একজন। কার্পেন্তিয়ারের মতোই তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা গভীর। তবু কিছুটা প্রস্তুতি নেবার আছে। গত দশ-পনেরো বছরে তিনি কথাসাহিত্যের কাঠামো ও শৈলী নিয়ে অনেক কিছু নতুন করে ভেবেছেন।
কিন্তু আজ সুইডেনের নোবেল একাডেমি নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করবে। তাঁর কৌতূহল আছে কে পাবে এ পুরস্কার তা নিয়ে। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো পেলে তিনি অখুশি হবেন না। তাঁর ভাগ্যে কি এ পুরস্কারের শিকে ছিঁড়বে কখনও? তাঁর নাম সৌভাগ্যবানদের তালিকায় থাকতে পারে এরকম কথা কখনও কারও মুখে উচ্চারিত হয়নি আজও। এ বছর তো নয়ই।
এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে উঠল। নোবেল একাডেমির সেক্রেটারি জেনারেল কথা বলবেন। ফোনে ভালো শোনা যাচ্ছিল না। সংযোগ কেটে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আবার ফোন বাজল। এবার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার। তিনি শুনলেন: ‘২০১০-এর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে আপনাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।’
মহানন্দের একটা খবর। তীব্র তীক্ষ্ণ নিবিড় গহন আনন্দ। তবু একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক শুনেছেন তো? কেউ কৌতুক করেনি তো? তবু খবরটা স্ত্রী প্যাট্রিসিয়াকে দিলেন। পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে খবরটা দেখতে পেলে নিশ্চিত বোধ করা যেত।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠল আবার: ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো, মারিয়ো বার্গাস য়োসা বলছেন?’
‘হ্যাঁ, বলছি।’
‘হ্যালো, আমার নাম অ্যাডাম স্মিথ। স্টকহোম থেকে বলছি, নোবেল পুরস্কার ওয়েবসাইটের প্রধান সম্পাদক। নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় আমার আন্তরিক অভিনন্দন।’
‘আচ্ছা, খবরটা তাহলে সত্য?’ বলে হা হা করে হেসে উঠলেন প্রাণ খোলে।
‘অবশ্যই সত্য।’
‘কিছুক্ষণ আগে একাডেমির সেক্রেটারি জেনারেলের ফোন পেয়েছি আমি। ভাবছিলাম কোনো বন্ধু-টন্ধু কৌতুক করল না তো?’
‘আমি নিশ্চিত করে বলছি একটু আগে জনসমক্ষে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’
‘আহ্। ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যে? আমি খুব, খুবই, কী বলব আলোড়িত, কৃতজ্ঞ। বড় আশ্চর্য লাগছে। কী বলব জানি না। আমি আপ্লুত বোধ করছি।’
অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে আরও কিছু কথা হলো। ফোন রেখে এবার একটু স্বস্তি বোধ করলেন বার্গাস য়োসা। অবশেষে নোবেলও জুটে গেল। গার্সিয়া মার্কেসের কথা মনে পড়ল তাঁর। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে এনে তিনিই ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যকে বিশ্বের মঞ্চে স্থায়ী আসনে তুলে দিয়েছিলেন।
২.
নোবেল পুরস্কার নিতে গেলে একটি বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বক্তৃতার খসড়া লিখতে গিয়ে শুরুতেই বার্গাস য়োসা লিখলেন: ‘পাঁচ বছর বয়সে আমি পড়তে শিখেছিলাম।’ লিখতে লিখতে মনে পড়ল তাঁর দেশ পেরুর কথা, জন্মস্থান আরেকিপার কথা, স্পেনীয়ভাষী পৃথিবীর বিশাল ভূখণ্ডের কথা, স্ত্রী প্যাট্রেসিয়ার কথা, যাদের সঙ্গে মিশেছেন তাদের কথা। সবার কথাই তিনি অল্পবিস্তর লিখবেন। তবে লেখালিখির কথা তো লিখতেই হবে।
তিনি লিখলেন: গল্প লেখাটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কাগজে লিখবার সময় মাথায় পুষ্ট ধারণাগুলি কীভাবে যেন নেতিয়ে যায়। পড়ে। ভেবে রাখা আইডিয়া এবং চিত্রকল্পগুলি মুখ থুবড়ে পড়ে। কীভাবে ওগুলিতে প্রাণসঞ্চার করা যায়? সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আমার অগ্রজদের মধ্যে অনেক ওস্তাদ লিখিয়ে রয়েছেন–তাদের কাছ থেকে শেখার মতো অনেক কিছু আছে; তাদের রচনাগুলি অনুসরণ করা যেতে পারে। ফ্লবেয়ারের কাছ থেকে আমি অবিচল শৃঙ্খলাবোধ ও দীর্ঘ সময় ধৈর্যধারণের দীক্ষা পেয়েছিলাম। উইলিয়াম ফোকনার শিখিয়েছিলেন রূপবন্ধ অর্থাৎ রচনাভঙ্গি ও কাঠামো একটি গল্পকে যেমন উচ্চাঙ্গ করে তুলতে পারে তেমনি চুপসেও দিতে পারে। জুয়ানদ মারতোরেল, সার্ভেন্তিস, চার্লস ডিকেন্স, বালজাক, তলস্তয়, কনরাড, টমাস মান শিখিয়েছেন উপন্যাসের জন্য রচনাশৈলীর ওস্তাদী ও বয়ানের কলাকৌশল গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কাহিনির অভিমুখ এবং অভীষ্ট লক্ষ্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সার্ত্রে শিখিয়েছেন শব্দই হলো ঘটক: একটি উপন্যাস কি নাটক এমনকি প্রবন্ধ সমসময়কেন্দ্রিক ও দিকদর্শী হলে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম। আলবেয়ার কামু এবং জর্জ অরওয়েল শিখিয়েছেন নীতিবোধ বিবর্জিত সাহিত্য শেষবিচারে অমানবিক। মারলো শিখিয়েছেন অডিসি এবং ইলিয়াদের মতো বীরগাথা এবং মহাকাব্য লেখার অবকাশ এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
বার্গাস য়োসা আরও লিখলেন: যে সকল মহাত্মার কাছে আমি কম-বেশি ঋণী তাদের সকলকে আমন্ত্রণ করা হলে আজ তাদেরই ছায়াপাতে আমরা নিষ্প্রভ হয়ে উঠতাম। সংখ্যায় তারা অগণন। তারা আমাকে কেবল গল্প বলার কৌশলই শিক্ষা দেননি, তারা আমাকে মানবতার অতলে ডুব দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন; সাহসী মানুষের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করতে অনুপ্রাণিত করেছেন; এবং মানুষের হিংস্র আচরণে আতঙ্কিত হয়ে শিউরে উঠতে শিখিয়েছেন। আমি বোরহেস, অক্তাবিও পাস, কোরতাসার, গার্সিয়া মার্কেস, কাবিরা ইনফান্তে, অনিত্তো, আরও আরও অনেকের লেখা পড়েছি, যারা গত একশ বছরে স্পেনীয় সাহিত্যের বাকভঙ্গি আমূল বদলে দিয়েছেন।
৩.
বিংশ শতাব্দীর স্পেনীয় ভাষার লেখকদের মধ্যে মারিয়ো বার্গাস য়োসা অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। স্পেনীয় সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বার্গাস য়োসার নাম অগ্রজ গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে সমমর্যাদায় উচ্চারিত হয়ে থাকে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তাঁর প্রভাব গভীরতর। তাঁর রচিত উপন্যাস, নাটক এবং গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫০-এর অধিক। গত ষাট বৎসরে পৃথিবীব্যাপী বায়ান্নটিরও অধিক ভাষায় তাঁর রচনাবলি অনূদিত হয়েছে।
পেরুভীয় এই কথাসাহিত্যিকের জন্ম ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। সাহিত্যজগতে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি ছোটগল্প গ্রন্থ লস হেফিস প্রকাশের মধ্য দিয়ে। মাদ্রিদের ইনিভার্সিতি কমপ্লুতেন্সে-তে পিএইচডি অধ্যয়নের সময় তিনি গল্পগুলো রচনা করেছিলেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত শহর এবং সারমেয়কুল (লা সিউদাদি লস পেরোস) নামীয় প্রথম উপন্যাসটিই বিতর্কের জন্ম দেয়। পেরুর মিলিটারি একাডেমিতে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে তিনি এ কাহিনি লিখেছিলেন। সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু গোপন কেচ্ছা ফাঁস করে দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ সামরিক বাহিনী এ বইটির হাজার কপি পুড়িয়ে দেয়।
প্রথম উপন্যাসের মধ্য দিয়েই তিনি ব্যাপক স্পেনীয়ভাষী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। উপন্যাসটির সাফল্য বার্গাস য়োসাকে অনুপ্রাণিত করে। একটি উপন্যাস যে শাসকগোষ্ঠীর ভিত সজোরে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম, নিপীড়িতকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম, এই শিক্ষা তাঁকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে। ফলে পরবর্তী সময়েও তিনি তাঁর উপন্যাসের জন্য মূলত রাজনৈতিক বিষয়াবলি বেছে নিতে থাকেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ষাটের দশক আন্দোলন ও আলোড়নের অধ্যায়। এ সময়েই আধুনিক মানুষ নিরঙ্কুশ বাকস্বাধীনতার জন্য–এমনকি অবাধ যৌনস্বাধীনতার জন্য–আকুলতা প্রকাশ করে। অন্যদিকে ষাটের দশক ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের ‘বিস্ফোরণ কাল’ হিসাবে পরিগণিত। গার্সিয়া মার্কেস, কালোর্স ফুয়েন্তেস, অক্তাবিও পাস, হুলিয়া কোর্তাসার প্রমুখ এ কাল পরিধিরই সন্তান। অভিন্ন কাল পরিধিতেই লা সিউদাদি লস পেরোস (দ্য টাইম অব হিরো), লা কাসা বারডি (দ্য গ্রিন হাউস) এবং কনবার্সেসিও এন লা ক্যাতেদ্রাল (কনভার্সেশান ইন দ্য ক্যাথিড্রাল) উপন্যাসত্রয় কেন্দ্র করে পাঠকরাজ্যে বার্গাস য়োসার আকর্ষণ বিস্তৃত হতে থাকে। তাঁর রচনায় দ্রোহের গভীর অনুপ্রাণনার সঙ্গে-সঙ্গে কখনও রয়েছে ব্যাপ্ত কৌতুকাবহ, কখনও যৌনতা।
পুরস্কার ঘোষণার সময় সুইডেনের নোবেল কমিটি বলেছিল: বার্গাস য়োসাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন করা হয়েছে ‘ক্ষমতার কাঠামো-বিন্যাস নিরূপণ এবং (ক্ষমতালাঞ্ছিত) ব্যক্তিমানুষের প্রতিরোধ, দ্রোহ এবং পরাভবের ক্ষুরধার চিত্রকল্প নির্মাণের জন্য।’ নোবেল কমিটির এই এক পঙ্ক্তির মূল্যায়ন অব্যর্থ। বার্গাস য়োসাকে যথার্থই বলা হয় লাতিন আমেরিকার ‘রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর’। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, সামরিক বাহিনীর দাপট, মুনাফালোভী বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শোষণ ইত্যাদি যুবক য়োসার চেতনায় যে দ্রোহ সৃষ্টি করেছিল, সে থেকেই তাঁর রাজনীতিকতার সূত্রপাত। তবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে। এক সময় ফিদেল কাস্ত্রো তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করলেও পরে তিনি কিউবায় দীর্ঘমেয়াদি একনায়কতন্ত্রী শাসনের ঘোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। যৌবনে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিলেও সোভিয়েত রাশিয়ার নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থাকে তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। তিনি পারফেক্ট ডিক্টেটরের শাসনে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাছে মানুষের সার্বত্রিক স্বাধীনতা সর্বোচ্চ বিষয়।
৪.
বার্গাস য়োসার সবচেয়ে রাজনীতিমুখী রচনা ১৯৬৯-এ প্রকাশিত কনবার্সেসিও এন লা ক্যাতেদ্রাল (গীর্জ্জায় কথোপকথন): উপন্যাসটির কাহিনি আধুনিক পেরুর প্রেক্ষাপটে বিস্তারিত। ম্যানুয়েল অদ্রিয়া ১৯৪৮-এ পেরুর ক্ষমতা দখল করে। তার স্বৈরাচারী শাসন ১৯৫৬ পর্যন্ত পেরুকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার উৎস, চারিত্র্য এবং পরিণতি এ উপন্যাসে বিশদ বিধৃত।
জগৎ বিলয়ের যুদ্ধ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট উনিশ শতাব্দীতে ব্রাযিলে ধর্মবিরোধী গণজাগরণ। ছাগলের মহাভোজ (ফিস্ট অব দ্য গোট) উপন্যাসে তিনি সরাসরি ডোমিনিক্যান রিপাবলিকে রাফায়েল ত্রুহিলোর নিপীড়নের বৃত্তান্ত চিত্রিত করেছেন। এ উপন্যাসের কাহিনিতে তিনি স্বৈরাচারী একনায়কের উত্থান এবং অদ্ভুত সমাজ-সম্পৃক্ততার বিশ্লেষণ করেছেন। দুর্নীতি কীভাবে শীর্ষ থেকে ক্রমশ সর্বস্তরে শেকড় ছাড়ে তার বিশ্বস্ত আলেখ্য এই উপন্যাস। ভ্রষ্ট গণতন্ত্রের নির্মোক তিনি উন্মোচিত করেছেন: তিনি দেখিয়েছেন গণতন্ত্র আজ ক্ষমতা দখলের আইনসিদ্ধ সোপানে পর্যবসিত হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতা অর্থগৃধ্নু মানুষের প্রধান হাতিয়ার। এই ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নয়, এই ক্ষমতার উৎস সকল প্রকার সামাজিক বৈষম্য। ফলে সমাজের স্তরে স্তরে নিপীড়ন ও শোষণের যন্ত্র তৈরি হয়েছে। বার্গাস য়োসা তাঁর উপন্যাসগুলিতে এই নির্মম সত্যগুলো অনবগুণ্ঠিত করেছেন।
প্রায়শ রাজনৈতিক উপন্যাস ইতিহাসের কাহিনীকরণ ব্যতিরেকে বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না। বার্গাস য়োসা এর ব্যতিক্রম। উপন্যাসের সকল শিল্পশর্ত পূরণ করেও তিনি একজন সমাজবিজ্ঞানীর প্রজ্ঞা নিয়ে ক্ষমতা, শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং শাসকের সমাজ-সম্পৃক্ততার সঠিক বয়ান নির্মাণ করেছেন। হাক্সলে’র ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড বা কোসলারের ডার্কনেস অ্যাট নুন–এই দুই মহৎ উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বার্গাস য়োসার সাহিত্যচিন্তার মূলে রয়েছে দ্রোহ। অধিকন্তু এই দ্রোহ পরিণত হয়েছে সমাজবদলের অভিপ্রায়ে। ফলত তাঁর উপন্যাস কেবল আলেখ্য নয়, নয় নিছক সমাজ ও জীবনের প্রতিফলন; বরং তা ধারণ করেছে সমাজবদলের সূত্র। এখানেই বার্গাস য়োসা সকলের থেকে বিশিষ্ট, এখানেই তাঁর সাহিত্যের মূল অর্জ্জন।
বার্গাস য়োসার রচনা রাজনীতিস্নাত হলেও তিনি কখনও সাহিত্যগুণ ও শিল্পমানের ব্যাপারে আপস করেন নি। তাঁর প্রতিটি রচনা শিল্পোত্তীর্ণ। প্রতিপাদ্য বিষয় যাই হোক না কেন, বার্গাস য়োসা তাঁর রচনাকে প্রথমত শিল্পীত উপন্যাসে উত্তীর্ণ করতে বিশেষভাবে সচেতন ও সচেষ্ট।
যদিও প্রায়শ ঐতিহাসিক ঘটনা বা কাহিনি বার্গাস য়োসার উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে বিশেষ স্থান দখল করে থাকে, তবু তাঁর রচনা আদৌ ইতিহাসমূলক নয়। ইতিহাসকে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রাসঙ্গিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না যে ছাগলের মহাভোজ উপন্যাসে তিনি ত্রুহিলোকে শুরুতেই মানবদানব হিসাবে উপস্থাপন করেন নি। বরং তিনি দেখিয়েছেন কী প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ দানবে পরিণত হতে পারে। আরও দেখিয়েছেন এই প্রক্রিয়ায় নিপীড়তদের সহায়তামূলক সম্পৃক্ততা। এখানেই বার্গাস য়োসা অনন্যসাধারণ।
২০২১ সালে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বার্গাস য়োসা লেখক হিসাবে সম্পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন। প্রায় দু’বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘আমার নিঃস্তব্ধতা তোমাকে দিলাম’ (Le dedico mi silencio)। গত ১৩ এপ্রিল তিনি আরেকিপাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর পৃথিবী হারাল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সফল একজন লেখককে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ব ল প রস ক র র উপন য স উপন য স র ত কর ছ ন অন প র ণ র জন ত ক র জন য এক ড ম ত হয় ছ র র জন র রচন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গান নিয়েই আমার সব ভাবনা
কর্নিয়া। তারকা কণ্ঠশিল্পী। অনলাইনে প্রকাশ পাচ্ছে বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া তাঁর দ্বৈত গান ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’। এ আয়োজন ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সঙ্গে–
‘ভাঙা ঘর’ ও ‘আদর’-এর পর প্রকাশ পাচ্ছে ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’। একনাগাড়ে দ্বৈত গান গেয়ে যাচ্ছেন, কারণ কী?
শ্রোতাদের চাওয়া আর নিজের ভালো লাগা থেকেই দ্বৈত গান গাওয়া, এর বাইরে আলাদা কোনো কারণ নেই। কারণ, সব সময় ভাবনায় এটাই থাকে, যে কাজটি করছি, তা শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ করবে কিনা। সেটি একক, না দ্বৈত গান– তা নিয়ে খুব একটা ভাবি না। তা ছাড়া রুবেল খন্দকারের সঙ্গে গাওয়া ‘ভাঙা ঘর’ ও অশোক সিংয়ের সঙ্গে গাওয়া ‘আদর’ গান দুটি যেমন ভিন্ন ধরনের, তেমনি বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’ অনেকটা আলাদা। আসল কথা হলো, যা কিছু করি, তার পেছনে শ্রোতার ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়টি প্রাধান্য পায়।
দ্বৈত গানের সহশিল্পী হিসেবে নতুনদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণ?
সহশিল্পীর কণ্ঠ ও গায়কি যদি শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মতো হয়, তাহলে সে তরুণ, নাকি তারকা– তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না। এমন তো নয় যে, নতুন শিল্পীরা ভালো গাইতে পারে না। তা ছাড়া তারকা শিল্পী ছাড়া দ্বৈত গান গাইব না– এই কথাও কখনও বলিনি। তাই দ্বৈত গানে তারকাদের পাশাপাশি নতুনদের সহশিল্পী হিসেবে বেছে নিতে কখনও আপত্তি করিনি।
প্রতিটি আয়োজনে নিজেকে নতুন রূপে তুলে ধরার যে চেষ্টা, তা কি ভার্সেটাইল শিল্পী প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য?
হ্যাঁ, শুরু থেকেই ভার্সেটাইল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি গড়ে তুলতে চেয়েছি। এ কারণে কখনও টেকনো, কখনও হার্ডরক, আবার কখনও ফোক ফিউশনের মতো মেলোডি গান কণ্ঠে তুলেছি। গায়কির মধ্য দিয়ে নিজেকে বারবার ভাঙার চেষ্টা করছি। সব সময়ই নিরীক্ষাধর্মী গান করতে ভালো লাগে। একই ধরনের কাজ বারবার করতে চাই না বলেই নানা ধরনের গান করছি। নিজেকে ভেঙে সব সময়ই নতুনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা জারি রাখছি।
প্রযোজক হিসেবে নিজের চ্যানেলের জন্য নতুন কী আয়োজন করছেন?
আয়োজন থেমে নেই। তবে কবে নতুন গান প্রকাশ করব– তা এখনই বলতে পারছি না। কারণ একটাই, অন্যান্য কাজের মতো গান তো ঘড়ি ধরে কিংবা সময় বেঁধে তৈরি করা যায় না। একেকটি গানের পেছনে অনেক সময় দিতে হয়। কোনো কোনো গানের কথা-সুর-সংগীতের কাটাছেঁড়া চলে দিনের পর দিন। এরপর যখন তা সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে হয়, তাখনই প্রকাশ করি।
গান গাওয়ার পাশাপাশি মডেলিং বা অভিনয় করার ইচ্ছা আছে?
সত্যি এটাই, গান নিয়েই আমার সব ভাবনা। তারপরও অনেকের অনুরোধে কয়েকটি পত্রিকার ফ্যাশন পাতার জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছি। তবে মডেল হব– এমন ইচ্ছা নিয়ে কাজ করিনি। অভিনয় নিয়েও কিছু ভাবি না। অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই না।