সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে টানা ১০ বছর বেআইনিভাবে ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডের সভাপতি পদ ধরে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ক্লাবটির বর্তমান সভাপতি নাসির মাহমুদ। এই সময়ে বেনজীর ক্লাবের প্রায় ৩২ কোটি টাকা আর্থিক অনিয়ম করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ক্লাবের সাবেক সভাপতি বেনজীর আহমেদ ও সাবেক সম্পাদক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.

) তাহসিন আমিনের বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাৎ-এর প্রমাণ মেলায় তাদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান নাসির মাহমুদ। পাশাপাশি অন্যান্য শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার সাভারের বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাব লিমিডেটের রিভারভিউ লাউঞ্জে আয়োজিত ‘বিগত সভাপতি বেনজীর আহমেদের আর্থিক অনিয়ম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।

এই ৩২ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ কতখানি সঠিক, এর পরিমাণ বাড়বে নাকি কমবে- তা যাচাইয়ের জন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্ম হোদা ভাসিকে (হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং) নতুন করে আবার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান বোট ক্লাবের বর্তমান সভাপতি। তিনি বলেন, ‘এটা নিশ্চিত থাকেন ৩২ কোটি থেকে দুই-চার কোটি টাকা কমতে পারে। এর খুব বেশি কমবে না, বরং আরও বাড়তে পারে।’

বেনজীর আহমেদ সভাপতি থাকাকালে নাসির মাহমুদকে তিন বছর বোট ক্লাবে আসতে দেননি বলেও অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমি বোট ক্লাবে আসলে গুম করা হতো, আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হতো; তার বাহিনী দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারতেন। তার অনেক ক্ষমতা ছিল, আমি শুধুই সাধারণ একজন ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে ফাইট দেওয়ার মতো অবস্থান আমার ছিল না। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, আইনি লড়াই করে গেছি। আমি তিন বার তার (বেনজীর) নামে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি।’ নিজের অবস্থান বেআইনি বুঝতে পেরে বেনজীর একাধিকবার বৈঠকে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন বলেও জানান নাসির মাহমুদ।

ক্লাব কমিটি থেকে বহিষ্কার প্রসঙ্গে নাসির মাহমুদ বলেন, ‘ক্লাবের এক্সিকিউটিভ মেম্বার হিসেবে তিনি (বেনজীর) আমাকে বাদ দিতে পারেন না। বাদ দেওয়ার অধিকারও তার ছিল না। আমি তাকে (বেনজীর) ভয় পেয়েছিলাম। এখন তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা ক্লাবের প্রায় ৩ হাজার ১০০ সদস্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমরা আমাদের দায়িত্বে থেকে এই কাজটি করছি, ভয়ের কিছু নেই। যদিও উনি (বেনজীর) আমাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন, হয়তো করবেনও। এই দেশে তো অনেক কিছুই হয়। ভবিষ্যতে হবে কিনা আমি জানি না। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করবো, এ বিষয়ে আমরা নির্ভীক।’

বোট ক্লাবে চিত্রনায়িকা পরীমণিকে নিয়ে ঘটে যাওয়া প্রসঙ্গও আসে সংবাদ সম্মেলনে। পরীমণি-কাণ্ডের সঙ্গে বেনজীরের কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরীমণি-কাণ্ডের পরে আমি তিন বছর বোট ক্লাবে আসতে পারিনি। আমি যেভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছি, তা হওয়ার কথা ছিল না। পরীমণি এই ক্লাবের সদস্য না। তিনি কারও গেস্ট হয়ে ক্লাবে এসেছিলেন। ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনও সদস্য গেস্ট আনতে চান, তবে অনুমতি লাগে। তার (পরীমণি) কোনও অনুমতি ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী, ওই সদস্যের (পরীমণিকে যিনি এনেছেন) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল, কেন অনুমতি ছাড়া ক্লাবে আনা হলো। প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তার (পরীমণি) উচ্ছৃঙ্খলা আমি মানতে পারিনি।’

সাবেক আইজিপি যেই মুহূর্তে ক্লাবের সভাপতি পদে বসতে চেয়েছেন, তখন তার কাছে টাকা বড় বিষয় ছিল না উল্লেখ করে নাসির মাহমুদ বলেন, ‘তখন তার কাছে বড় ছিল সামাজিক সম্মান। একটি ক্লাবের সভাপতি, যা তা বিষয় নয়। পূর্ণাঙ্গ জাস্টিস (বিচারপতি), মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, সাবেক সচিব, সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, পুলিশের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এই ক্লাবের সদস্য। বোট ক্লাব, ঢাকা ক্লাব ও উত্তরা ক্লাবসহ এসব ক্লাবের সদস্যরা যাকে সভাপতি বানান, তিনি আসলেই সামাজিকভাবে অত্যন্ত স্বীকৃত ব্যক্তি। উনি (বেনজীর) বিনাভোটে বোট ক্লাবের মতো বড় ক্লাবের সভাপতি হয়ে সামাজিক সম্মান গেইন করতে পারেন। এটা তো হতেই পারে। তিনি (বেনজীর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ডিগ্রি বাতিল করেছে। ডক্টরেট ডিগ্রি উনি কেন কিনে নিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই সামাজিক সম্মানের জন্য।’

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ঢাকা বোট ক্লাব সভাপতি নাসির মাহমুদ বলেন, ‘বোট ক্লাবের ইতিহাসের এটাই সম্ভবত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন। ঢাকা বোট ক্লাবের জন্ম খুব বেশি দিন হয়নি। ২০১৪ সালের ৩০ জুন এটা প্রথম সরকারিভাবে অনুমোদন পায়। পরে সরকারি বিভিন্ন প্রক্রিয়া মেনে জমি কেনা এবং সরকারি বিভিন্ন দফতরের অনুমোদন নিয়ে নিজস্ব ভবন নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্লাব চালু হয়। এভাবে ক্লাব এগিয়ে যাচ্ছিল, যার মধ্যে আমরা সাত জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম।’ সে সময়ে বিভিন্ন ধরনের চাপে একজনের (বেনজীর) জন্য সভাপতি পদটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী।

বেনজীর আহমেদ ক্লাবের সভাপতি পদে বসার পর নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে কোনও নিয়মের ধার ধারেননি বলেও অভিযোগ করেন নাসির মাহমুদ। তিনি বলেন, উনি শুধু সময়ক্ষেপণ করেছেন।‘

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত ক্লাবটির বৈধতার জন্য প্রতি বছর যেসব ডকুমেন্ট নিতে হয়, বেনজীর আহমেদ সেসব নিয়মেরও বরখেলাপ করেন বলে অভিযোগ করেন ক্লাবটির বর্তমান সভাপতি। এর ফলে ক্লাবের অস্তিত্বও সংকটে পড়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমরা নির্বাচিত হয়ে আসলাম, সব ডকুমেন্ট আমরা নিয়েছি।’

নতুন কমিটির বৈধতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উনি পালিয়ে যাওয়ার পর ক্লাবে নির্বাচন হয়েছে তা নয়। উনি থাকতেই কিন্তু নির্বাচনের তারিখ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে একাধিকার নোটিশ দিই সংবিধান মতে প্রতিবছর নির্বাচন দেওয়ার জন্য। বিগত ২৪ জুন ওনাকে উল্লেখ করে আরেকটি নোটিশ দিয়েছিলাম যে, ২০ জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। তিনি ক্ষমতার চরম সময়ে থাকাকালেই নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য নকিব সরকার অপু, জেসমুল হুদা মেহেদী অপু, আসমা আজিজ, এ কে এম আইযাজ আলী (খোকন), আলীম আল কাজী (তুহিন), খালেদা আক্তার জাহান, মির্জা অনিক ইসলাম, আজাদ এম এ রহমান, মো. জাকির হোসাইন ও খন্দকার হাসান প্রমুখ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র সদস য র জন য সরক র ব যবস ক ষমত বছর ব

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ