ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারে আলো দিয়ে লেখা হলো শান্তির বার্তা– ‘পিস’। এই প্রতীকী বার্তাটি গাজার জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও বিশ্বব্যাপী শান্তির আহ্বানের একটি শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

বৃহস্পতিবার আনাদোলু এজেন্সির প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে হাজারো মানুষ একত্রিত হয়েছেন। আস্তে আস্তে সন্ধ্যার আবরণ যখন শহরের ওপর নেমে আসছিল, তখনই টাওয়ারের গায়ে উজ্জ্বল আলোয় ভেসে ওঠে– ‘গাজাবাসীর জন্য শান্তির বার্তা’।

মুহূর্তটি উপস্থিত দর্শকের মধ্যে আবেগ ও সংবেদনশীলতার এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি করে। দর্শকের অনেকেই হাতে ধরে রেখেছিলেন প্ল্যাকার্ড, যাতে লেখা ছিল– ‘নিরাপত্তা চাই’, ‘গণহত্যা বন্ধ হোক’, ‘ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা চাই’– জাতীয় বিভিন্ন মানবিক ও প্রতিবাদী বার্তা।

এই আলোক বার্তাটি এমন একসময়ে প্রকাশ পায়, যখন গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বহু ফিলিস্তিনি, বিশেষত নারী ও শিশু প্রাণ হারাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা স্তর থেকে যুদ্ধবিরতির দাবি জানানো হলেও বাস্তব পরিস্থিতির তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

আইফেল টাওয়ার, যা ফ্রান্সের গর্ব ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক, সেই স্থানে এই ধরনের বার্তা প্রদর্শন বিশ্ববাসীর কাছে শান্তির একটি জোরালো আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শান্তিকামী মানবাধিকারকর্মীদের সমর্থনে এ আয়োজন করা হয়। বুধবারের এই আয়োজনে ফ্রান্সসহ বিশ্বের বহু মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, যারা গাজায় শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবিক সহায়তার স্বপ্ন দেখেন।

এ সময় ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শত শত সাংবাদিক। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় সহকর্মীদের নিহতের প্রতিবাদও জানান তারা। একই সঙ্গে গাজায় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও জানান বিক্ষোভকারীরা। নিহত সহকর্মীর ছবি বুকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন তারা। সহকর্মী হত্যার বিচারের দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে গর্জে ওঠেন বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে গাজার খবর বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার অধিকার চান তারা। গাজায় শিগগিরই গণহত্যা বন্ধের দাবিও তোলেন আন্দোলনরত সাংবাদিকরা।

বিক্ষোভকারী সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বলেন, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা যেন গাজায় নিরাপদে অবস্থান করতে পারেন, সেই দাবি জানাচ্ছি। গাজার খবর গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই। আরেকজন বলেন, গাজায় প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকদের হত্যা করছে ইসরায়েল। সহকর্মীদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়।

আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই গাজার সংবাদমাধ্যমগুলো বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েলি প্রশাসন। চিত্র সাংবাদিক, রিপোর্টারসহ এ পর্যন্ত দুই শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন আইডিএফের হামলায়। যাদের বেশির ভাগই ফিলিস্তিনের সাংবাদিক। দিনশেষে রাতেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আইফেল টাওয়ারে অবস্থান করেন কয়েকশ বিক্ষোভকারী। এ সময় আবেগঘন এক মুহূর্ত তৈরি হয় আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে। আনাদোলু এজেন্সি।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ন ত সম ব শ ইসর য় ল সহকর ম

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুই বন্ধু ও দুটি স্বপ্নের বিদায় 
  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • কানাডায় নৌকা উল্টে মারা যাওয়া ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • টিম গ্রুপের এমডি আবদুল্লাহ হিল রাকিবকে শেষ বিদায় জানালেন সহকর্মীরা
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
  • চার শতাধিক লেখক গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন