২৮ বছর ধরে পত্রিকা নিয়ে ছুটছেন, স্বল্প আয়ে আর সংসার চলছে না বৃদ্ধ সেলিম উদ্দিনের
Published: 19th, April 2025 GMT
ষাটোর্ধ্ব মো. সেলিম উদ্দিন। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় যার জীবন যুদ্ধ। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, গরম কিংবা শীত উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, অফিসে-আদালতসহ গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন এই বয়োজ্যেষ্ঠ। এ পেশা দিয়ে আগে কোনোমতে সংসার চললেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। একদিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অন্যদিকে নানান অসুখ-বিসুখে শরীর সায় না দিলেও জীবন যুদ্ধে থেমে নেই সেলিম দেশ-বিদেশের খবরাখবর সবার ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিলেও এই মানুষটা যেন রয়ে যান খবরের অন্তরালেই।
সেলিমের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার চরনিখলা গ্রামে। সংসারে স্ত্রী ছাড়াও আছেন দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে দু'জন বিয়ে করে যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। সম্পদ বলতে বাড়ির ভিটে টুকুই আছে তার। নিজে কষ্টে দিনাতিপাত করলেও 'হকারি' পেশায় ভিড়তে দেননি দুই ছেলেকে। বড় ছেলেটা অটোরিকশাচালক, আর ছোট ছেলেটা হাফেজি শেষ করে টঙ্গী একটা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন।
শুক্রবার পৌরসভার দত্তপাড়া এলাকায় পুরোনো বাইসাইকেল থামিয়ে একটি বাসায় পত্রিকা দিতে যাবেন এমন সময় কথা হয় তার সঙ্গে। আলাপকালে সেলিম উদ্দিন সমকালকে জানান, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আয়-ব্যয়ের পাল্লার হিসেব মেলে না। অসুস্থ শরীর নিয়েও কাকডাকা ভোরে উঠে গ্রাহকদের পত্রিকা পৌঁছাতে হয়। আগে কোনোমতে জীবন চললেও মাস শেষে এখন যে টাকা কমিশন পায় তা দিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হয়। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। আমরাও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমাদেরও সংসার আছে। অসুখবিসুখ আছে। দুদিন বিছানায় পড়ে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।’
তিনি জানান, তার কোনো নির্দিষ্ট দোকান কিংবা ঘর নেই। প্রতিদিন সকালে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পত্রিকাগুলো আসে। পরে সেখান থেকে নিয়ে তিনি বাইসাইকেল দিয়ে সবার কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন।
এদিকে পত্রিকা বিক্রিতে না পোষানোর কারণে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ ৫৫ বছর পত্রিকা বিক্রির দোকানটি। দোকানের মালিক পীযুষ কান্তি শীল বাপ্পি বলেন, ছাপা পত্রিকার চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। একজন লোক রেখে মাসশেষে তার বেতনই দিতে পারি না। দিন দিন লসের পাল্লা ভারি হচ্ছিল। যে কারণে বাধ্য হয়েই ব্যবসা বন্ধ করতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো.
তিনি বলেন, অনেক হকার আছেন তিনবেলা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে এই পেশায় এসেছিলেন। শেষ বয়সে এসে অন্যকিছু করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করবে সেটারও তো উপায় নেই। স্থানীয় প্রশাসন অথবা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো।
ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর রহমান বলেন, সমাজের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অসংগতিগুলো আমরা পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরি। আর সেগুলো পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয় হকার। আমাদের কাছে এই মানুষগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে পূর্বেও তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও করা হবে। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদুল আহমেদ বলেন, সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন পত্রিকার হকার। তাদের বিপদ-আপদে আমাদের অবশ্যই পাশে থাকা উচিৎ। আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
৫ কোটি টাকার সেতুতে যানবাহন চলবে কবে
ঈশ্বরগঞ্জ-আঠারবাড়ী আঞ্চলিক সড়কটির দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। ১১৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালে এর সংস্কার কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ অংশের কাজ সম্পন্ন হলেও অধিগ্রহণ জটিলতায় পৌর এলাকার প্রায় তিন কিলোমিটার এবং সোহাগী ইউনিয়নের কিছু অংশে কাজ আটকে আছে। ২০২২ সালে ইউনিয়নের বগাপুতা খালের ওপর সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১ দশমিক ৮২৮ মিটার একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।
এর পর পার হয়েছে আড়াই বছর। কিন্তু সেতুতে যানবাহন চলাচলই শুরু হয়নি। কারণ সংযোগ সড়কই যে নেই। তাহের ব্রাদার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। অবকাঠামোর কাজ শেষ হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় সংযোগ সড়ক নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বগাপুতা খালের ওপর সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার সেতুটি কোনো কাজেই আসছে না। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন মানুষ।
সংযোগ সড়কের কাজ কবে সম্পন্ন হবে, সেটিও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহাগ বলেন, চোখের সামনে সেতু নির্মাণ হয়ে আছে, অথচ কোনো কাজেই আসছে না। তাঁর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা নিরসন হয়নি। মানুষের ভোগান্তি লাগবে দ্রুত জমির মালিকদের মূল্য বুঝিয়ে দিয়ে এটি সচল করতে হবে। পুরোনো সেতুর ওপর দিয়ে বড় যানবাহন পার হওয়ার সময় অন্যগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, আঠারবাড়ী-ঈশ্বরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের একপাশে খালের ওপর রয়েছে নতুন সেতুটি। দুই পাশে সড়ক নেই। পাশের পুরোনো নড়বড়ে সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারী যানবাহন। এ সময় ট্রাকচালক ওয়াদুদ মিয়া বলেন, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন শহর থেকে নানান ধরনের পণ্য আঠারবাড়ী (রায়ের বাজার) সরবরাহে এটিই একমাত্র পথ। পুরো সড়ক ঠিকমতো এলেও পুরোনো সেতুর ওপর উঠতেই কাঁপাকাঁপি শুরু হয়। মনে হয়, ‘এই বুঝি ভেঙে ট্রাকসহ নিচে পড়ে গেলাম’। নতুন সেতু চালু হলে নির্বিঘ্নে চলাচল করা যেত।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেতুর দুই পাশে ১০ থেকে ১২ জনের জমি রয়েছে। আড়াই বছর আগেই সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও অধিগ্রহণের টাকা ছাড়া জমি ছাড়তে চাইছেন না মালিকরা। ফলে সংযোগ সড়কের অভাবে অচল অবস্থায় পড়ে আছে সেতুটি। অটোরিকশার যাত্রী ইফরাত তানজীম তাবাসসুমকে বিরক্ত নিয়ে বিড় বিড় কিছু বলতে শোনা যায়। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘মরার একটা সেতু শুধু শুধু বানিয়ে ফেলে রাখছে। মানুষের উপকারে আসবে তো দূরের কথা, আরও ভোগান্তি পোহাতে হয়।’
বগাপুতা গ্রামের বাসিন্দা ও জমির একাধিক মালিকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। আবদুল গফুর, আবদুস ছাত্তার, লতিফ মিয়া, আবদুর রশিদ, মজিবুর রহমান ও আজিজুল হকের ভাষ্য, কর্তৃপক্ষ তাদের জমির সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। টাকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তারা সংযোগ সড়ক হতে দেবেন না।
সেতুটির দুই পাশের ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় সংযোগ সড়ক হচ্ছে না বলে জানান সওজের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুস ছালাম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জমির মালিকদের সাত ধারা নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রাক্কলন তৈরির কার্যক্রম চলছে। এটি পাসের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রাক্কলন পাস হয়ে এলে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। এ জন্য কতদিন সময় লাগবে, তা বলা যাচ্ছে না।