ভারত ও চীনের মতো মেধাবী তরুণদের দেশে ফেরাতে আমরা কী করছি
Published: 21st, April 2025 GMT
আজ থেকে মাত্র চার দশক আগে চীনের গবেষণা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সংস্কৃতি এতটা অগ্রসর ছিল না। চীনের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তেন। তাঁদের বেশির ভাগই নিজ দেশে ফিরতে চাইতেন না। চীন সরকার এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছে। ফলে প্রতিটি প্রদেশে তারা গড়ে তুলেছে বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র (স্টেট কি ল্যাবরেটোরিজ-এসকেএল) এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে।
চীনে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক স্টেট ল্যাবরেটরি আছে। আমার অনেক চীনা সহকর্মী এই পরিবর্তনের জন্য টেং সিয়াওপিংকে কৃতিত্ব দেন। টেং সিয়াওপিংকে অনেকেই আধুনিক চীনের স্থপতি মনে করেন।
২০১৮ সালে চীনের সিয়ান জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। আমি তখন আমেরিকার আইভি লিগ প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করছিলাম। সিয়ান জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সুযোগ-সুবিধা দেখে আমি খুবই বিস্মিত হই।
আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সেখানে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা ছিল অনেক বেশি। অনেক ব্যয়বহুল অবকাঠামো ওরা তৈরি করে রেখেছে। আর সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করে সেরাদের সেরা তরুণ গবেষকদের সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে।
২০০৮ সাল থেকে চীন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প শুরু করে। সহস্র মেধাবী প্রকল্প বা থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্ল্যান নামে সেটি পরিচিত। এই প্রকল্পের অধীন, তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তরুণ গবেষকদের চীনে ফেরানো হয়। তাঁদের উচ্চ বেতন-ভাতা ও গবেষণার জন্য ফান্ড দেওয়া হয়।
পিএইচডি এবং পোস্ট ডক গবেষণার মান, পাবলিকেশন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ৩০-৩৫ বছর বয়সী তরুণ গবেষকদের সরাসরি প্রফেসরশিপও দেওয়া হতো। শুধু গত ১০ বছরেই চীনের গবেষণা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সংস্কৃতি আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। সহস্র মেধাবী প্রকল্প, সেই সমৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
অনুরূপ প্রভাব আমি ভারতেও লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে ভারতের আইআইটিগুলো বিশ্বমানের গবেষণা করে। প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন তরুণ তৈরি করছে। যেটি তাদের বিনিয়োগব্যবস্থাকে টেকসই করছে। স্থানীয় উদ্যেক্তা তৈরিতে সাহায্য করছে। ভারতের একাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গবেষণার সংস্কৃতিকে অনেক শক্তিশালী করছে।
মুম্বাই আইআইটির একজন অধ্যাপকের নাম দেবব্রত মাইতি, বাঙালি ও বয়সে তরুণ। দেবব্রত মাইতি, শুধু ভারতের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নামকরা অর্গানিক কেমিস্ট। অধ্যাপক মাইতি, জন হপকিন্সে পিএইচডি করেছেন। অধ্যাপক বাকওয়াল্ড নামের একজন নামকরা গবেষকের অধীন পোস্ট ডক করেছেন। দেবব্রত মাইতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১১-১২ বছর আগে। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে।
অধ্যাপক মাইতি, পোস্ট ডক শেষে আমেরিকা থেকে ফিরে ভারতে গিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর কাজের মান এবং গতি অভাবনীয়। তাঁর ল্যাবে তৈরি হচ্ছে সেরা অর্গানিক কেমিস্ট। ওষুধশিল্প, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিসহ বহু শিল্পে ভারত পৃথিবীতে এখন এগিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে এই মাইতির মতো অধ্যাপকেরা অনেক বড় ভূমিকা রাখছেন।
অধ্যাপক মাইতি পিএইচডি-পোস্টডকের সময় যে মানের পাবলিকেশন করেছেন, বাংলাদেশের অনেক তরুণ সে মানের পাবলিকেশন করেন। তিনি বিদেশে যে মানের অধ্যাপকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, বাংলাদেশের অনেক তরুণ সেই মানের অধ্যাপকদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি ভারতে ফিরে যত কাজ করেছেন, বাংলাদেশি কোনো মেধাবী তরুণ দেশে ফিরে গেলে, তাঁর অন্তত ৫ ভাগ কাজও করতে পারতেন; কিন্তু বাংলাদেশি একজন তরুণের বেলায় বিষয়টা অধ্যাপক মাইতির মতো সহজ নয়!
বাংলাদেশি একজন তরুণ, দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথটাই আজও সুগম হয়নি। দেশের কোনো ভিসি কি কখনো ট্যালেন্ট হান্টের উদ্যোগ নিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো একজন প্রভাষক কিংবা সহকারী অধ্যাপককে বিদেশে পাঠায় পিএইচডি ডিগ্রির জন্য। অথচ যথারীতি পিএইচডি-পোস্ট ডক আছে এমন কাউকে নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানায় না। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই নিয়ম। ৫৪ বছর ধরে চলে আসা এই রীতির পরিবর্তন তো কখনো না কখনো করতেই হবে।কারণ, অধ্যাপক মাইতি ফিরে যাওয়ার মতো একটি পরিবেশ পেয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছেন কাজ করার একটি সেটআপ। তাঁদের মতো মানুষদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য আইআইটিগুলো ট্যালেন্ট হান্ট করে। তরুণেরা ফিরে গিয়ে ফান্ডের জন্য আবেদন করেন। সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী ফান্ড দেয়। একটা ইকো সিস্টেম দাঁড়িয়েছে। দেবব্রত মাইতি জানতেন, আমেরিকায় না থেকে ভারত ফিরে গেলে, তাঁর দেশকে অনেক কিছু দিতে পারবেন। কারণ, আমেরিকা থেকে ১০ জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও যদি অন্যত্র চলে যান, আমেরিকার তেমন কিছুই হবে না। আমেরিকার গবেষণা ও উদ্ভাবনের সংস্কৃতি এত সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশি একজন তরুণ, দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথটাই আজও সুগম হয়নি। দেশের কোনো ভিসি কি কখনো ট্যালেন্ট হান্টের উদ্যোগ নিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো একজন প্রভাষক কিংবা সহকারী অধ্যাপককে বিদেশে পাঠায় পিএইচডি ডিগ্রির জন্য। অথচ যথারীতি পিএইচডি-পোস্ট ডক আছে এমন কাউকে নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানায় না। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই নিয়ম। ৫৪ বছর ধরে চলে আসা এই রীতির পরিবর্তন তো কখনো না কখনো করতেই হবে।
আজ ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ প্রবাসী তরুণদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরাকে বাছাই করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর সুফল ওরা পাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলেও স্থানীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা অনিবার্য। দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে দুর্বল করে রেখে দুনিয়ার কোনো দেশ বিশ্বমানের পর্যাপ্ত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারেনি। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারেনি। টেকসই বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের অনেক গবেষক, উদ্ভাবক, শিক্ষক, উদ্যেক্তা পৃথিবীর বহু দেশে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। যাঁদের অনেকেই দেশে ফিরে অবদান রাখতে চান। দেশের জন্য কিছু করতে চান। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে সেরা মানুষদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিজ্ঞান গবেষণাগারে নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতিতে সুফল আসবে। ভবিষ্যতে অনেক মেধারী তরুণেরা দেশে ফেরার আগ্রহ পাবেন। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে ট্যালেন্ট হান্ট করতে হবে এখনই! বর্তমান সরকার কি এমন একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প দ্রুত শুরু করবেন?
● ড.
রউফুল আলম যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখক ও গবেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক র প রকল প প এইচড ক জ কর প বল ক কর ছ ন র জন য র অন ক র একট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নারীবাদের ছদ্মবেশে ভারত যখন যুদ্ধ চালায়
ভারতের সেনাবাহিনীর যে দুই নারী অফিসার ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান। তাঁদের দিয়ে অভিযানের ঘোষণা দেওয়ানোর ঘটনাকে ভারত জাতীয় কর্মযজ্ঞে নারীর অন্তর্ভুক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।
খাকি পোশাক পরা এই দুই নারী যখন যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন থেকে সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলছিলেন; যখন তাঁরা ভারতের ২৬ জন সাধারণ পুরুষ মানুষকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছিলেন এবং যখন তাঁরা প্রতীকীভাবে বিধবাদের সিঁদুরের সম্মান রক্ষার বার্তা দিচ্ছিলেন, তখন অনেকেই এই দৃশ্যকে দেশের সেবায় নিয়োজিত একটি নারীবাদী চিত্র বলে প্রশংসা করেছিলেন।
দুই নারী অফিসারের ঘোষণাপর্ব শেষ হওয়ার পর ভারত সরকার এটিকে নারী ক্ষমতায়নের এক বিরাট উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করল। তাঁদের ছবি সবখানে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলল, ‘দেখো, নারীরাও আজ সম্মুখসমরে লড়াই করছে!’
এই ঘটনা ইতিহাসের আরেকটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেটি হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যখন ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনেকেই হিন্দুদের যুদ্ধদেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। দুর্গা দেবীকে নারী শক্তি ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। দুর্গার সঙ্গে ইন্দিরার তুলনা দেওয়া হয়েছিল কারণ, ইন্দিরা সে সময় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। দুর্গার সঙ্গে ইন্দিরার এই তুলনা থেকে বোঝা যায়, ভারতে রাজনীতি অনেক সময়ই নারীর পরিচয় ও ধর্মীয় কল্পনার সঙ্গে মিশিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি ধর্মীয় প্রতীকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
কিন্তু কোনো নারী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেই কি সেটিকে নারীবাদের অগ্রগতি বলা যায়?
অনেক দিন ধরেই নারীবাদী গবেষকেরা বলে আসছেন, ‘নেশন বিল্ডিং’ বা ‘দেশ গড়ার’ মতো বড় কাজ আসলে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই চলে। সেখানে নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখা হয় না। বরং, নারীদের এমন সব ভূমিকা দেওয়া হয়, যেখানে তারা দেশের জন্য কিছু ত্যাগ করে। যেমন নারী মা হিসেবে সন্তান উৎসর্গ করে, বিধবা হিসেবে শোক করে—ইত্যাদি।
নীরা ইউভাল-ডেভিস নামের একজন গবেষক বলছেন, নারীদের অনেক সময় দেশের সম্মান আর সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের হাতে খুব কমই থাকে।
সামিতা সেন ও মৈত্রেয়ী চৌধুরীর মতো কয়েকজন ভারতীয় গবেষক বলছেন, ‘আমাদের দেশে নারীরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিলেও তাঁদের সেই অংশগ্রহণ সর্বার্থে স্বাধীন থাকে না। বরং সমাজের নিয়মকানুন, মানে পুরুষদের বানানো নিয়ম মেনে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।’
তাই শুধু নারীরা সামনে এসেছে মানেই সব ঠিক হয়ে গেছে, এমন ভাবাটা ঠিক হবে না। আমাদের দেখতে হবে নারীদের সত্যিকার অর্থে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, নাকি শুধু লোকদেখানোর জন্য দেখানো হচ্ছে যে তাঁরাও অংশ নিচ্ছেন।
আজকের যেসব নারী যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করছেন বা সামরিক বাহিনীতে সামনে আসছেন, সেটিকে অনেক সময় একধরনের নারীবাদ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর মধ্য দিয়ে নারীদের এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন তাঁরা ‘পুরুষদের মতো’ হতে পারছেন। অথচ সামরিক বাহিনীর যে পুরুষতান্ত্রিক মূল কাঠামো, সেটিকে কিন্তু আগের মতোই রেখে দেওয়া হয়।
এই বিষয়টি আমরা পরিষ্কারভাবে অপারেশন সিঁদুরের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। এখানে ইউনিফর্ম পরা দুই নারী অফিসারকে সামনে এনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এটি নারীদের অগ্রগতির একটি ছবি। কিন্তু তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ওপর তৈরি। এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় নারীদের দেশের জন্য লড়াই করে এবং পুরুষদের মতো জাতীয়তাবাদ দেখিয়ে নিজেদের ‘বীরত্ব’ প্রমাণ করতে হয়।
এই ধরনের নারীবাদের ছবিগুলো ভারতের এক বিশেষ আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। সেটি হলো আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) চিন্তাধারা। ১৯২৫ সালে গঠিত এই সংগঠন হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে কাজ করে। সংগঠনটি ভারতের শাসক দল বিজেপির আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরএসএস মনে করে, ভারতের একটি হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া উচিত, যেখানে হিন্দুধর্মের রীতিনীতিই থাকবে সবার ওপরে। গবেষক ক্রিস্টোফ জ্যাফরেলো বলছেন, এই সংগঠন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রাধান্য দেয় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে দুর্বল করে।
আরএসএসের যে কাঠামো, সেখানে নিয়মশৃঙ্খলা আর জাতীয়তাবাদের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে পুরুষদের নেতৃত্বকেই বেশি জায়গা দেওয়া হয়। তাই এটা আসলে সমাজের ভেতরে পুরুষের আধিপত্য আর স্তরভিত্তিক বৈষম্যকে আরও পোক্ত করে।
আরএসএসের নারী শাখা (যেমন ‘রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি’ ও ‘দুর্গা বাহিনী’) আসলে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনারই প্রতিফলন। এই সংগঠনগুলো অনেক বছর ধরে নারীদের মার্শাল আর্ট শেখাচ্ছে আর আদর্শগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এসব নারীর মুক্তির জন্য করা হচ্ছে না, করা হচ্ছে ‘হিন্দুরাষ্ট্রকে রক্ষা করার’ জন্য।
অপারেশন সিঁদুরের চেহারাও এই ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। গেরুয়া রঙের ছাপ, যুদ্ধজয়ী নারীর চেহারা আর সাজানো-গোছানো সাহসিকতার প্রদর্শন—এর সবই এই পুরোনো চিন্তার ধারাবাহিকতা।
দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ ও লিঙ্গবিষয়ক প্রখ্যাত গবেষক বিনা ডি’কস্টা দেখিয়েছেন, কীভাবে নারীর দেহকে অনেক সময় জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এই অপারেশন সিঁদুরের মধ্যে এক মুসলমান নারী অফিসারকে রাখা হয়েছে। এটি দেখে মনে হতে পারে, এটি ধর্মনিরপেক্ষতার ইঙ্গিত। কিন্তু ডি’কস্টা বলছেন, এটি আসলে একধরনের ওপর-চালাকি। কারণ, এই একজন মুসলমান নারীকে দেখিয়ে বলা হয়, ‘দেখো, আমরা সবাইকে সুযোগ দিচ্ছি।’ অথচ বাস্তবে ভারতে অনেক মুসলমানের প্রতি বৈষম্য দেখানো হচ্ছে, অনেককে অপমান করা হচ্ছে বা ভয় দেখানো হচ্ছে।
এই একজন মুসলমান নারীকে সামনে আনা হচ্ছে যেন এটা প্রমাণ করতে যে সবাইকেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চিন্তাভাবনাকেই আরও পোক্ত করা হচ্ছে আর মুসলমানদের বঞ্চনাকে ঢেকে রাখা হচ্ছে।
সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীরা মাথার মাঝখানে সিঁথিতে লাগান। এটি সাধারণভাবে বিবাহিত অবস্থার চিহ্ন, স্বামীর প্রতি ভক্তি এবং ‘ভালো স্ত্রী’ হওয়ার প্রতীক। সিঁদুরের সঙ্গে দেবী দুর্গার ভাবনাও জড়িয়ে থাকে।
ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার তাঁর ‘হিন্দু ওয়াইফ, হিন্দু নেশন’ বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে জাতীয়তাবাদী কথা বা ভাবনা স্ত্রীর পবিত্রতা আর মাতৃভূমির পবিত্রতাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।
অপারেশন সিঁদুর নামটাই সিঁদুরের প্রতীককে একধরনের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। এই নামের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলার মাধ্যমে বিধবাদের ভেঙে যাওয়া বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতিশোধ নেওয়া হবে, তার মধ্য দিয়ে হিন্দু বিধবাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
এই পুরো অপারেশন একধরনের ছবি তৈরি করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে কিছু নারী বিধবা হয়ে গেছেন (মানে তাঁরা সিঁথির সিঁদুর হারিয়েছেন) আর তাঁদের কষ্টকে প্রতিশোধের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারীবাদী ইতিহাসবিদ উর্বশী বুতালিয়া বলেছেন, যুদ্ধের সময় নারীর দেহ, অনুভূতি আর প্রতীকগুলোকে (যেমন সিঁদুর, শোক, মাতৃত্ব ইত্যাদি) ‘যুদ্ধের চিহ্ন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ যখন হয়, তখন তা কেবল গোলাবারুদ দিয়ে হয় না। তার জন্য একটি ‘গল্প’ বা ‘ব্যাখ্যা’ দাঁড় করানো হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কেন যুদ্ধটা জরুরি। সেই গল্প বানাতে নারীদের দুঃখ, কষ্ট, চোখের জল—এসব ব্যবহার করা হয়।
যখন কোনো নারীর স্বামী মারা যান, তাঁকে বলা হয় বিধবা। তখন তাঁর মাথা থেকে সিঁদুর মুছে যায়। এই বিধবার কান্না, তাঁর হারানো সিঁদুর, তাঁর দুঃখ এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার করে বলা হয়, ‘দেখো, কত কষ্ট। এর প্রতিশোধ নেওয়া দরকার।’
অর্থাৎ, নারীর কষ্টকে একটা জাতীয়তাবাদী অনুভূতির জ্বালানি বানিয়ে ফেলা হয় যেন দেশের জন্য যুদ্ধ করাটা ন্যায্য প্রমাণিত হয়।
উর্বশী বুতালিয়া বলছেন, অপারেশন সিঁদুরের সিঁদুর আসলে নারীদের কাছে এখন আর কোনো ভালো কিছুর প্রতীক নয়; এটি সেই কষ্টের স্মৃতি, যা তাঁরা হারিয়েছেন। সিঁদুর বলতে এখানে সম্মান হারানো, সামাজিক মর্যাদা হারানো ও নিরাপত্তা হারানোকে বোঝানো হয়েছে। বুতালিয়া মনে করেন, নারীর দুঃখকে সম্মান দিতেই তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে, তাঁর দুঃখকে ব্যবহার করতে নয়।
এই দুই নারী অফিসারকে এখানে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়নি; বরং এক কল্পনার ‘মাতৃভূমির’ সৈনিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাঁদের দেখানো হয়েছে সেই পুরোনো চিন্তার ধারাবাহিকতায়, যেখানে নারীদের মূলত ঘর আর পূজার আসনের মধ্যেই আটকে রাখা হতো।
এখানে আসলে যেটা উদ্যাপন করা হচ্ছে, সেটা নারীদের মুক্তি নয়। বরং তাদের এমন একটি ভূমিকার মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়কে উদ্যাপন করা হচ্ছে, যা কিনা পুরুষদের মতো যুদ্ধকেন্দ্রিক এবং আক্রমণাত্মক।
নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা যুদ্ধ করতে পারে, অস্ত্র ধরতে পারে এবং সেটাকেই নারীর অগ্রগতি বলে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে মূলত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ও সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, নারীবাদকে নয়।
এই প্রতীকগুলো (যেমন নারী অফিসার, সিঁদুর, যুদ্ধ) আসলে পুরোনো ক্ষমতার কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে। তাই আমাদের দরকার এই প্রতীকগুলোর মানে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এসবের মাধ্যমে সরকার কী বোঝাতে চায়, কাকে সুবিধা দিতে চায়, সেই প্রশ্ন তোলা দরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে যখন নারী অফিসাররা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, তখন মানুষ কী উদ্যাপন করে? যুদ্ধকে? নাকি মানুষ কেবল এই কারণে খুশি হয় যে নারীরাও এতে অংশ নিচ্ছে?
এই দৃশ্যপটের ভেতরে যে বার্তাটি সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হচ্ছে, সেটি হলো নারীরা ‘পুরুষদের মতো’ না হলে তাঁদের যোগ্যতা প্রমাণিত হয় না। তাঁরা পুরুষের মতো শক্তিশালী না হলে তাঁদের নেতৃত্বকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এই দুই নারী অফিসারকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র আসলে নারী নেতৃত্বকে ব্যবহার করছে, যেন যুদ্ধ ও সহিংসতাকে আরও জোরালোভাবে বৈধতা দেওয়া যায়। কিন্তু যে কাঠামো নারীদের প্রতি সহিংসতা চালায়, সেটাকে ভাঙার কোনো চেষ্টাই এখানে নেই।
প্রকৃত নারীবাদ চায় নারীরা নিজেরা ঠিক করুক তাঁরা কোথায়, কীভাবে অংশ নেবেন। কিন্তু এখানে সেই সিদ্ধান্তও নারীদের নয়। বরং এখানে আরএসএসের মতো পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ঠিক করে দিচ্ছে তাঁদের ভূমিকা কী হবে।
এই দুই অফিসার আসলে পুরোনো সেই চিত্রনাট্যে অভিনয় করেছেন, যেখানে নারী মানেই দেশের জন্য স্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল হওয়া।
এখানে একজন মুসলমান নারী অফিসারকেও রাখা হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত; যেন বলা যায়, ‘আমরা সবাইকে সমান সুযোগ দিচ্ছি।’ কিন্তু এর মধ্য দিয়ে দুর্গা বাহিনীর চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে। সেই চিন্তাধারা হলো হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে চাইলে ‘অহিন্দু’ নারীদেরও ব্যবহার করা যায়।
শুধু এই কারণেই একজন মুসলমান নারীকে সামনে আনা হয়েছে। এটি লোকদেখানো বহুত্ববাদ। বাস্তবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা সমাজে ঠিকই চলছে।
নারীবাদী আন্দোলন শুধু দেখে না যে কারা যুদ্ধ করছে, বরং যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, কারণ এবং পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তোলে। যদি আমরা মেনে নিই দেশ গড়ার পুরো কাজটাই পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে চলে, তাহলে শুধু নারীদের সেই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর ঢুকিয়ে দিলেই সমাধান হয় না। বরং আমাদের সেই চিন্তাকেই বদলাতে হবে, যেখানে নারীর সম্মান শুধু স্ত্রীসুলভ আচরণ বা যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মোৎসর্গের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়।
নারীর সত্যিকারের নেতৃত্ব হওয়া উচিত শান্তি প্রতিষ্ঠা, সাধারণ মানুষের সুরক্ষা, পুনর্বাসন এবং নীতিনির্ধারণের জায়গায়—যেখানে সিঁদুর বা বাহাদুরি দিয়ে নারীর মূল্য যাচাই করা হয় না। নারী যুদ্ধ করছেন কি না তার ওপর তাঁর মর্যাদা নির্ভর করে না; বরং তিনি নিজের শর্তে সমাজে কীভাবে অবদান রাখছেন, তার ওপর তাঁর মর্যাদা নির্ভর করে।
সত্যিকারের লিঙ্গসমতা মানে হলো সেই নারীদের মূল্য দেওয়া, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিক প্রতীকের ভেতরে ঢুকতে চান না। সত্যিকারের লিঙ্গসমতা মানে হলো সেই নারীদের মূল্য দেওয়া, যাঁরা যুদ্ধের বদলে শান্তির পক্ষে কথা বলেন, যাঁরা বিধবাদের পাশে থাকেন এবং যাঁরা মনে করেন, ‘স্ত্রী’ বা ‘সিঁদুর’ দিয়ে নারীর সম্মান মাপা উচিত নয়।
অমৃতা দত্ত বিলফেল্ড ইউনিভার্সিটির বিলফেল্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড সোশিওলজির প্রভাষক
অরণি বসু হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির হাইডেলবার্গ সেন্টার ফর ট্রান্সকালচারাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ