পারভেজ সাজ্জাদের সন্তান আকাইদ সাজ্জাদ, মা–বাবা তাঁকে শ্রেষ্ঠ নামে ডাকতেন। গত জুনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শ্রেষ্ঠর মা অভিনয়শিল্পী সীমানা। এর পর থেকে বাবা পারভেজের অধিকাংশ সময় সন্তানের সঙ্গে কাটে। স্টেজ শো, গানের রেকর্ডিং বা বিশেষ কোনো কাজ ছাড়া বাসার বাইরে যান না। মাঝেমধ্যে ছেলেকে সঙ্গে নিয়েও রেকর্ডিং স্টুডিওতে যান। ছেলে তার দাদি এবং দুই ফুফুর ‘জানের জান’, ‘কলিজার টুকরা’ উল্লেখ করে পারভেজ বলেন, ‘আমার ছেলেটা মা হারানোর দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়াবে। আমি মনে করি, বাবার না থাকা কিছুটা হলেও পূরণ করা যায়; কিন্তু মায়ের অপূর্ণতা কোনোভাবেই পূরণ হয় না।’
ছেলের মায়ের মৃত্যুর পর জীবন অনেকটাই বদলে গেছে, জানালেন এই গায়ক। পারভেজ বলেন, ‘জীবন চলবে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। যেখানে পছন্দের কোনো অপশন নেই। এই জীবনও ভালো। ২৪ ঘণ্টা ছেলেটা আমার চোখের সামনে আছে, এটা খুবই স্বস্তির বিষয়। তবে ওর কষ্টটা যখন দেখি, তখন তা আমাকে হার্ট করে। ভাবতে থাকি, ও তো এ রকম জীবন প্রাপ্য ছিল না। এই বয়সেও আমার মা আছে। কোনো কষ্ট বা অন্য কোনো অনুভূতি, আনন্দের কথা শেয়ার করার জন্য মায়ের নম্বরে প্রথম ডায়াল করি। কিন্তু আমার ছেলেটার চিন্তার জায়গাটাই শেষ হয়ে গেল। মা না থাকাটা কত বড় অভাব, কল্পনাও করতে পারি না। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই বন্ধুর মতো। আমরা একসঙ্গে স্কুল থেকে যাওয়া–আসার সময় নানা বিষয়ে কথা বলি। বন্ধুত্বের জায়গা ডেভেলপ করে নিয়েছি। ওর মা বেঁচে থাকার সময়েও করেছি।
সবকিছুর পরও বিরাট শূন্যতার জায়গা রয়েছে। একটা বাচ্চাকে যখন তার মা আদর করে, তখন দেখি সে তাকিয়ে থাকে। আনমনা হয়ে যায়। বেশির ভাগ সময় আমাকে বলে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই বয়সে কষ্ট লুকানো শিখে গেছে, যেটা একজন বাবা হয়ে সহ্য করা যায় না।’
১৫০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে
বিজয় সরকারের ‘তুমি জানো না রে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা’, হাসন রাজার ‘সোনা বন্দে আমারে দিওয়ানা বানাইল’, ‘লোকে বলে’, শাহ আবদুল করিমের ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’, ‘কেমনে ভুলিব আমি’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘আছেন আমার মোক্তার’, মুজিব পরদেশীর ‘আমার সোনা বন্ধু রে’, ‘সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর’, নজরুল ইসলাম খানের ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা’, আলাউদ্দিন বয়াতির ‘মন আমার দেহ ঘড়ি’—এই ১০টি গানের সংকলনে বাংলা ফোক ম্যাশআপ করেছিলেন ডিজে রাহাত, যেটিতে কণ্ঠ দেন পারভেজ সাজ্জাদ। পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত সে গানটি সম্প্রতি দেড় শ মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়েছে। ১০ লাখ লাইক পড়েছে এবং মন্তব্য জমা পড়েছে ৪৪ হাজারের মতো। এটাকে অনেক বড় অর্জন মনে করছেন পারভেজ। কেননা বাংলা লোকগানের কোনো ম্যাশআপে এত বেশি সাড়া পড়েনি।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, প্রথমত গানগুলো খুবই চেনা। সংগীতায়োজনে একেবারে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। গায়কিতে ঐতিহ্যের ছাপ ছিল। প্রচলিত গায়কির সঙ্গে সংগীতের আধুনিকতা চমৎকারভাবে ব্লেন্ড হওয়ার কারণে ট্র্যাকটাকে সবাই এভাবে ভালোবেসেছে। তা ছাড়া লোকগানের আবেদন সর্বজনীন। এ গানটি আমি বাজতে শুনেছি ইউকে, থাইল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবে। গানটিতে নতুন ধরনের সাউন্ড ডিজাইন পেয়েছেন মানুষ।’
পারভেজ সাজ্জাদ.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করাই লক্ষ্য
১.
ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের নয়জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই বিরোধীদলীয়, যা একধরনের ‘ভারসাম্যহীনতা’ সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর লেখা থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে উচ্চকক্ষের স্পিকার বিরোধী দল থেকেই মনোনীত হবেন। এই ধারণার পক্ষে তাঁর যুক্তি হচ্ছে, ‘যেসব দেশে উচ্চকক্ষ আছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ দেশেই কোনো দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না’ এবং ‘এর ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে পদগুলো (স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপ) ভাগাভাগির বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।’
নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, উচ্চকক্ষে এ ধরনের নিয়োগ মূলত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক সংলাপ ও ঐকমত্যের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর এই বক্তব্য সঠিক হলে উচ্চকক্ষের স্পিকার আবশ্যিকভাবে বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন, এমন কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা রাজনৈতিক সংলাপ ও ঐকমত্য নির্ভর করে দলগুলোর আলোচনা-দর-কষাকষির সক্ষমতার ওপর, যা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল একটি বিষয়। উপরন্তু নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলগুলোর শক্তি বা প্রভাব কতটুকু হবে, তা সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন। তাই উচ্চকক্ষের স্পিকার অবশ্যই বিরোধী দল থেকে হবেন—এ ধরনের পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
আরও পড়ুনসংসদীয় গণতন্ত্র নাকি ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ অন্য রূপ০৯ এপ্রিল ২০২৫নিজাম উদ্দিন আহমেদ ‘অতীতের অভিজ্ঞতা’ থেকে ধারণা করছেন যে আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো সরকারি দলের চেয়ে বেশি ভোট পাবে এবং এর ফলে উচ্চকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করবে। তাঁর এই ধারণা সঠিক হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। অতীতের নির্বাচনী ফলাফল বা আগামী নির্বাচনের ফলাফলের পূর্বাভাসের ভিত্তিতে এনসিসির গঠনপদ্ধতি নির্ধারণ করা সমীচীন হবে না। অতএব, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদের (এনসিসি) নয়জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই বিরোধীদলীয় প্রতিনিধি হবেন—এ দাবি বিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয় না।
২.
নিজাম উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, উচ্চকক্ষের নিয়ন্ত্রণ পেতে সরকার যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা করে, তা সংসদীয় রাজনীতিতে ‘নৈতিক’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে তাঁর এই বক্তব্য সঠিক নয়। বাস্তবে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা আপস, আলোচনা, সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমেই কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতে উপরাষ্ট্রপতি, যিনি রাজ্যসভার স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, অনেক ক্ষেত্রেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ২০০২ সালে যখন বিজেপির সাবেক নেতা ভৈরন সিং শেখাওয়াত ভারতের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তখন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতায় ছিল। নির্বাচন ফলাফল থেকে প্রতীয়মান হয় যে শেখাওয়াত এনডিএ এবং তাঁর ঘোষিত মিত্রদের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে ৪০টির বেশি ভোট পেয়েছিলেন, যা বিরোধী দলগুলোর ‘ক্রস ভোটিং’-এর ইঙ্গিত দেয়।
আরও পড়ুনসংসদীয় গণতন্ত্র নাকি ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ পুনঃপ্রবর্তন১২ মার্চ ২০২৫যুক্তরাজ্যেও অনুরূপ প্রথার প্রচলন রয়েছে। ২০১৬ সালে সাবেক কনজারভেটিভ মন্ত্রী লর্ড ফাউলার হাউস অব লর্ডসের তৃতীয় লর্ড স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন। তাঁর নির্বাচনে ভোটাভুটির কোনো অফিশিয়াল রেকর্ড না থাকলেও লর্ডসের সদস্যদের বিবৃতি থেকে এটি অনুমেয় যে তিনি ক্রস-পার্টির সমর্থন পেয়েছিলেন। নির্বাচনের পর অভিনন্দন জানানোর সময় লেবার পার্টির ব্যারনেস স্মিথ অব ব্যাসিলডন মন্তব্য করেন যে লর্ড ফাউলারের পুরো হাউসেরই সমর্থন রয়েছে।
৩.
নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, কোনো সংসদ সদস্য সরকার বা প্রধান বিরোধী দলের বাইরের কেউ হলেও তিনি ‘নিরপেক্ষ’ হবেন না এবং সে ক্ষেত্রে এনসিসিতে তিনি বিরোধীদলীয় হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাঁর এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব অথবা ২০২৫ সালের ২৮ মার্চ প্রকাশিত আমার প্রবন্ধে কোথাও এমন সংসদ সদস্যকে ‘নিরপেক্ষ’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। মূল বিষয় হলো, এমন একজন সদস্য যিনি সরকারি দল বা প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনি উভয় দলের কোনোটিরই দলীয় অবস্থানের প্রতি দায়বদ্ধ নন। তিনি কাউন্সিলের আলোচিত বিষয়ে যেকোনো দিকে ভোট দিতে পারেন; কখনো হয়তো সরকারি দলের পক্ষে, কখনো বিরোধী দলের পক্ষে। এ ধরনের সদস্যের ভোটের পূর্বানুমান করা সম্ভব নয়। ভোটের এই অনিশ্চয়তাই নিজাম উদ্দিন আহমেদের দাবি খণ্ডন করে যে এনসিসির নয়জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজন সদস্য অবশ্যই বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
এখানে বলা প্রয়োজন, কাউন্সিলে ভোটের এই অনিশ্চয়তা একটি বড় রকমের সুবিধা বয়ে আনবে; গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে প্রার্থী নির্বাচনের মতো সিদ্ধান্ত দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে নেওয়া সম্ভব হবে। যেহেতু কোনো দলই কাউন্সিলকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায় দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে।
৪.
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের ব্যাপারে নিজাম উদ্দিন আহমেদ যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানেও ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ে’ বিধিনিষেধ রয়েছে। নিজাম উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘স্থিতিশীল সরকার’ গঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান অপরিহার্য। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব বিধান কতখানি নির্বাচিত সরকার পতন প্রতিরোধে কার্যকর, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
পাকিস্তানে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ইমরান খানের সরকারের পতন একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৩এ অনুযায়ী অনাস্থা প্রস্তাবসহ আরও কিছু বিষয়ে দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে একজন আইনপ্রণেতার সদস্যপদ বাতিল হয়। এমন কঠোর বিধান থাকা সত্ত্বেও ইমরান খানের নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কেননা এ ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের বিদ্রোহীরা অনাস্থা প্রস্তাবের সময় নিজেদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি; বরং তাঁরা পদত্যাগ করেছেন বা ভোটদান থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে কৌশল অবলম্বন করে অনুচ্ছেদ ৬৩এ-এর আওতা এড়িয়ে গেছেন। যেহেতু এই বিধান শুধু তখনই প্রযোজ্য, যখন একজন আইনপ্রণেতা সক্রিয়ভাবে দলীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে ভোট দেন, বিদ্রোহীরা কোনো শাস্তির সম্মুখীন হননি।
ভারতেও অনুরূপ ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত বিধান থাকা সত্ত্বেও তা স্থিতিশীল সরকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। রাজনৈতিক দলত্যাগ রোধে প্রণীত ভারতের সংবিধানের দশম তফসিল বারবার আইনি ফাঁকফোকর ও রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে উপেক্ষিত হয়েছে। দলীয় হুইপকে অগ্রাহ্য করে অযোগ্য হওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার পরিবর্তে, বিধায়কেরা প্রায়ই দলবদ্ধভাবে পদত্যাগের পথ বেছে নিয়েছেন। ফলে উপনির্বাচন অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং ক্ষমতার পালাবদল সম্ভব হয়েছে।
ঠিক এভাবেই ২০১৯ সালে কর্ণাটকে কংগ্রেস-জেডি (এস) জোটের ১৭ জন বিধায়ক পদত্যাগ করেন, যার ফলে সরকার পতন হয় এবং উপনির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। একই রকম কৌশল ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে কংগ্রেসের ২২ জন বিধায়ক পদত্যাগ করেন, যাঁদের অনেকেই পরে বিজেপিতে যোগ দেন, ফলে কমল নাথের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে।
অতএব এটি পরিষ্কার, ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে না। কৌশলী পদত্যাগ, সংগঠিত দলত্যাগ বা রাজনৈতিক দর-কষাকষির মাধ্যমে খুব সহজেই ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত বিধান অকার্যকর করা সম্ভব। ফলে এ ধরনের বিধান সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অপরিহার্য বলে নিজাম উদ্দিন আহমেদের দাবি বাস্তব ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে টেকে না।
যুক্তরাজ্যের পপলার এবং লাইমহাউসের এমপি আপসানা বেগমের ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন যে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ায় তাঁকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। তবে তাঁর এই শাস্তি নিশ্চয়ই সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না; বরং দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। লেবার পার্টির সমর্থক তৃণমূল সংগঠন ‘মোমেন্টাম’-এর সহসভাপতি কেট ডোভ লেবার পার্টির নেতৃত্বের এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এটা স্পষ্ট, স্টারমারের নেতৃত্ব দলীয় হুইপ ওই প্রক্রিয়াকে গোষ্ঠীগত লাভের জন্য অপব্যবহার করছে।’
বাস্তবে ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে না। বরং এসব বিধান সংসদ সদস্যদের বিবেক অনুযায়ী ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা সীমিত করে, প্রকৃত মতবিরোধ ও বিতর্ককে দমন করে এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে খর্ব করে। ফলে এ ধরনের বিধানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
৫.
নিজাম উদ্দিন আহমেদ কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনব্যবস্থা সঠিকভাবে উপস্থাপন করেননি। তিনি দাবি করেছেন, ‘কয়েক হাজার স্থানীয় প্রতিনিধির পক্ষ থেকে মাত্র ৭৬ জন স্থানীয় প্রতিনিধি (সমন্বয়ক) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন’ এবং ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা থাকবে না’—যা তাঁর মতে ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ আরেক রূপ। তাঁর এ বক্তব্যে কমিশনের প্রস্তাব সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ (ডিসিসি) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট প্রদান করবে [অনুচ্ছেদ ৩.২.১(আ)]। দেশে মোট ৬৪টি জেলা থাকায়, প্রতিটি জেলায় ডিসিসি গঠিত হলে ভোটের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৪। অনুরূপভাবে অনুচ্ছেদ ৩.২.১(ই) এ বলা হয়েছে, প্রতিটি সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিলও (সিসিসি) একটি করে সামষ্টিকভাবে ভোট প্রদান করবে, ফলে সব সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত হলে মোট ভোট হবে ১২টি।
কমিশনের প্রতিবেদনে কোথাও বলা হয়নি, প্রতিটি ডিসিসি বা সিসিসি থেকে একজন ব্যক্তিই পুরো কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ভোট প্রদান করবেন। বরং অনুচ্ছেদ ৩.২.২, ৬.৩.১ এবং ৬.৩.২ একত্রে পাঠ করলে এটা সুস্পষ্ট যে ডিসিসি এবং সিসিসির প্রত্যেক সদস্য স্বাধীনভাবে ভোট প্রদান করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে প্রার্থী ডিসিসি বা সিসিসির সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভ করবেন, তিনি সেই পরিষদের একটি ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য হবেন।
সুতরাং ভোট গ্রহণে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা ৭৬-এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। অর্থাৎ শুধু ৭৬ জন সমন্বয়ক হাজার হাজার লোকের পক্ষে ভোট প্রদান করছেন বলে নিজাম উদ্দিন আহমেদ যে দাবি করেছেন, তা ঠিক নয়। কাজেই স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উপেক্ষিত হচ্ছেন না, বরং তাঁরা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকছেন।
৬.
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো নিজাম উদ্দিন আহমেদ খুব সহজেই কমিশনের প্রস্তাবিত ব্যবস্থাকে আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে মাত্র ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’—যাঁরা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করতেন—জাতীয় নেতাদের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল একটি পরোক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভূমিকা ছিল না। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতা আরও দৃঢ় করেছিলেন।
এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত, আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ছিল মূলত একধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত’ বা ‘প্রতারণামূলক’ গণতন্ত্র। অন্যদিকে কমিশনের প্রস্তাব স্পষ্টভাবে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে, যেখানে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যেক নাগরিক সরাসরি তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। এ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি। তাই কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ তুলনা করা একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়।
উপরন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বকে আরও সম্প্রসারিত করা, সংসদীয় প্রক্রিয়াকে বিলুপ্ত বা দুর্বল করা নয়। এখানে স্পষ্ট করে বলা জরুরি, স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্পৃক্তি সংসদ সদস্যদের ভোটাধিকারের বিকল্প নয়; এটি সংসদীয় ভোটাধিকারের পাশাপাশি বিদ্যমান থাকবে।
নিজাম উদ্দিন আহমেদের আশঙ্কা, এ ব্যবস্থায় ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত রয়েছে, তা একেবারেই অমূলক। কমিশনের কোনো প্রস্তাবই আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর সঙ্গে দূরতম সাদৃশ্যও বহন করে না। এ ধরনের তুলনা শুধু সংবিধান সংস্কারের প্রকৃত প্রচেষ্টাকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
নিজাম উদ্দিন আহমেদের প্রবন্ধের শিরোনাম ‘সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি “মৌলিক গণতন্ত্রের” অন্য রূপ’ মূলত বিভ্রান্তিকর। বাস্তবে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য কোনো হুমকি নয়; বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করারই একটি প্রচেষ্টা।
ইমরান সিদ্দিক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।