ভারতে যুদ্ধকালীন তৎপরতার মহড়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্যকে নির্দেশ
Published: 6th, May 2025 GMT
পুলওয়ামা–কাণ্ডের ঠিক ১২ দিনের মাথায়, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেছিল ভারতের বিমানবাহিনী। ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগাম–কাণ্ডের পর দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত। ভারত এখনো প্রত্যাঘাত করেনি। তবে দেশব্যাপী ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ আবহে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সেরে রাখার মহড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আগামীকাল বুধবার বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে এই মহড়া চালানোর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজ্যের মুখ্য সচিবদের এই বার্তা পাঠানো হয়েছে। যুদ্ধ বাধলে নাগরিকদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী কী করণীয়, সেসবই ওই বার্তায় বলা হয়েছে।
১৯৭১ সালের পর কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রথমবার এ ধরনের মহড়ার নির্দেশ দিল। নির্দেশ কার্যকর করতে হবে প্রধানত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে। কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী, দেশের ২৪৪ জেলায় এই মহড়া চালানো হবে। মহড়া দিতে হবে গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও।
এই মহড়ায় মূলত দেখা হবে শত্রুদেশের বিমান হামলার সময় সতর্কতামূলক সাইরেন–ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, কিংবা রাতে হামলার আশঙ্কা রুখতে ‘ব্ল্যাক আউট’–ব্যবস্থা কার্যকর অবস্থায় রয়েছে কি না। বিমান হামলা থেকে বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তৈরি বাংকারগুলো তৈরি রাখা হচ্ছে কি না ইত্যাদি।
বিমান হানা রুখতে ‘ব্ল্যাক আউট’ একটা কার্যকর ব্যবস্থা। শত্রুবিমানের আক্রমণের লক্ষ্য আড়াল করতে এলাকা নিষ্প্রদীপ রাখাই এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, যাতে বিমানচালককে বিভ্রান্ত করা যায়। পাঞ্জাব সীমান্তের ফিরোজপুরে গত রোববার রাতে আচমকাই এই ‘ব্ল্যাক আউট’ মহড়া চালানো হয়। প্রস্তুতি হিসেবে সেতু, বিমানবন্দর, জাহাজবন্দর, তেলের ডিপো, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা ঢেকে রাখার কর্মসূচিও নেওয়া হয়, যাতে আকাশ থেকে তা দৃশ্যমান না হয়। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে এসব কাজ দ্রুত সেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মহড়ার আরও এক উদ্দেশ্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় বেসামরিক নাগরিকদের শিক্ষিত করে তোলা। রাজ্যে রাজ্যে গঠিত সিভিল ডিফেন্স এই দায়িত্ব পালন করে। স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এনসিসি ক্যাডেটদেরও এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। লক্ষ্য, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সজাগ ও সচকিত রাখা। এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে রাজ্য সরকারকে বলা হয়েছে। শত্রু হানায় হতাহত ব্যক্তিদের কত দ্রুত উদ্ধার করা যায়, সেটাও এই মহড়ার একটা অঙ্গ। সেই কাজে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে সব সময় জম্মু–কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আগে থেকেই বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। ১০ দিন ধরেই জম্মু–কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অঞ্চলে তৈরি হওয়া বাংকারগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষত পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কৃষকদের দ্রুত ফসল কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুটি কাজই স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসন যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে করছে। সীমান্তবর্তী এলাকার সড়ক মেরামতের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর খাদ্য ও পানীয় মজুতের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরুর আগে গতকাল সোমবার রাতে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক যুদ্ধবিরোধী বার্তায় বলেন, ভুল করেও যুদ্ধের পথে এগনো ঠিক নয়। যেকোনো সময় তা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো ভুল নয়। সামরিক ব্যবস্থা সমাধানের উপায় নয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ম ন তবর ত ব যবস থ মহড় র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
উচ্চ প্রবৃদ্ধি, বৈষম্যবাদী বিকাশ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সমাজ অর্থনীতির পুঁজিবাদী রূপান্তর ঘটেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। প্রথাগত বিচারে ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’র অনেকগুলো দিকই চিহ্নিত করা যায়। যেমন অর্থনীতির আকার বেড়েছে অনেক, কংক্রিট অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে, জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, আমদানি-রপ্তানির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে, সড়কপথের বিস্তার ঘটেছে অনেক, পরিবহন ও যোগাযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে, বহুতল ভবন বেড়েছে দ্রুত, রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে পোশাকশিল্প বড় সাফল্য তৈরি করেছে, প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল মজুত তৈরি করেছে, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক তৎপরতায় ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও মডেল অনেক বিস্তৃত হয়েছে, নগরায়ণ বেড়েছে, দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও সচলতা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির গুণগত পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেক নতুন উপাদান যোগ করেছে। অনেক পেশা নাই হয়ে যাচ্ছে আবার অনেক পেশা নতুন যোগ হয়েছে।
অনলাইন যোগাযোগের উল্লম্ফনে গ্রাম-শহরের বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক তৎপরতায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। অসংখ্য মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখন মুঠোফোন, ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইউটিউব, ওটিটি, বিকাশ, নগদনির্ভর হয়ে গেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইন সেমিনার-আলোচনা-পড়াশোনা, অনলাইন কেনাবেচা ব্যবসা-বাণিজ্য, অনলাইন সাংগঠনিক তৎপরতা, অনলাইন ধর্মীয় প্রচার দিনে দিনে বেড়েছে বহুগুণ। অনলাইন-অফলাইন বেচাকেনায় কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট, টিভি ইত্যাদির ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, যার অনেকগুলোই আমদানি করা পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল। বেসরকারি ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ও হাসপাতাল, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, কনসালট্যান্সি ফার্ম ইত্যাদির বিস্তার ঘটেছে অনেক। এ সময়ে সিনেমা হল কমেছে, সিনেপ্লেক্স হয়েছে কিছু; পাঠাগার, থিয়েটার হল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সেভাবে বাড়েনি, কিন্তু বহুগুণ বেড়েছে দেশি-বিদেশি খাবারের দোকান, শপিং মল; পাবলিক বাস বেড়েছে কিছু, কিন্তু তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে প্রাইভেট গাড়ি। সমাজে ধর্মচর্চা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি।
তবে জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি বা কথিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেভাবে ঘটছে, তার সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্য অনেক বেশি। যেমন যে দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হারে ঘটেছে, সেই সময়ে বন বিনাশের হার দেখা গেছে সবচেয়ে উঁচু। নদী-নালা, খাল-বিল ও বনদূষণ, দখল ও বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এ সময়েই দেশে একটি অতি ধনিকগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে। তাদের বিত্তবৈভব যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন মাথা গণনায় দারিদ্র্যের প্রচলিত সংজ্ঞা বা কোনোভাবে টিকে থাকার আয়সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা চার কোটির বেশি। যদি দারিদ্র্যসীমায় শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন যুক্ত করা হয় তাহলে দেখা যাবে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই অমানবিক জীবনে আটকে আছেন। গত এক বছরেও দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে।
গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের বেশি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের যথেষ্ট পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান হয়নি। দেশে কৃষকদের জীবনও বহু দিক থেকে বিপন্ন। ফসলের দাম, অনিশ্চয়তা, বিষের মধ্যে বসবাস, দখল-দূষণ সবই তাদের অস্থির করে রাখে। টিকে থাকার জন্য তাদের খুঁজতে হয় নতুন নতুন অবলম্বন। শিক্ষা ও চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। দোকানদারি অর্থনীতির উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটছে, যেখানে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানচর্চা বাহুল্য জ্ঞান করা হয়। আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বাজার, ভোগবাদিতা ও নিয়তিবাদিতার প্রভাব বেড়েছে।
বৈষম্যের বিরোধিতা করে যে গণ–অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই বৈষম্য দূর করার পথে আমরা কতটুকু এগোলাম?