ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড এলাকায় গতকাল শনিবার রাতে দুই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাত পৌনে ১০টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত পৌরসদরের সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড এলকায় সড়ক অবরোধ করা হয়। অবরোধের কারণে সড়কে প্রায় ৪০ কিলোমিটার যানজট তৈরি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন চালক ও যাত্রীরা।

হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, রাতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগান দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কিছু নেতা–কর্মী সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আসেন। এরপর তাঁরা মহাসড়ক অবরোধ করে মহাসড়কে অবস্থান নেন। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল পুনরায় শুরু হয়।
সীতাকুণ্ড পৌর সদরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি রাত সোয়া ১০টার দিকে তাঁর মোটরসাইকেল নিয়ে শুকলালহাট এলাকায় যানজটে আটকা পড়েন। দুই মিনিটের পথ অতিক্রম করতে তাঁর ২৫ মিনিট সময় লেগেছে।

যানজটে আটকা পড়া সীতাকুণ্ডের ছোটদারোগাহাট এলাকার বাসিন্দা মাসুম পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতে গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। এর মধ্যে অবরোধের কারণে যানজটে পড়ে গাড়ির ভেতরে যাত্রীদের হাঁসফাঁস অবস্থা দেখা দেয়।
বার আউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.

আবদুল মোমিন প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়ক অবরোধের ফলে মহাসড়কের উভয় দিকে অন্তত ৪০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। তীব্র গরমের মধ্যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন যাত্রীরা। রাত পৌনে ১২টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করায় যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সড়ক অবর ধ ক অবর ধ য নজট

এছাড়াও পড়ুন:

চলনবিলে পুকুর, পার্ক, রেস্তোরাঁ—সবই আছে , বয়ে চলে না পানি

‘যত দূর দেখা যায়, বিলের অবারিত উদারতা, চোখের দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না, ছুটতে ছুটতে অবশেষে ধোঁয়া আর কুয়াশা আর মেঘ মিলিয়ে যেখানে দিগন্তের মতো রচনা করেছে।’

সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫) চলনবিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমন বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেই বর্ণনার সঙ্গে এখন আর চলনবিলের মিল পাওয়া যায় না। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিলে দৃষ্টি ঢেকে দেয় সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প, খামার, সারি সারি পুকুর ও পুকুরপাড়ের কলাগাছ। অন্যদিকে বিলের পানিপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পুকুরের পার কিংবা অপরিকল্পিত সড়ক, বাঁধ ও স্লুইসগেটে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলে থাকেন, এই বিলে সব সময় পানি বয়ে চলার কারণেই নাম হয়েছে চলনবিল। কিন্তু বাস্তবে চলনবিলের শ্বাসরোধের মতো অবস্থা। নদী ও খালের পানির প্রবাহ বাধা পেয়ে এখন বিলে পর্যাপ্ত পানি আসতে পারে না।

নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিস্তৃত এই বিল একসময় ৪৭টি নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে গত পাঁচ দশকে নদী-খাল ভরাট, অপরিকল্পিত পোল্ডার ও সড়ক নির্মাণে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে মার্চে (শুষ্ক মৌসুম) চলনবিলে ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি ছিল। ২০২৫ সালে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬ বর্গকিলোমিটারে—অর্থাৎ ৯২ শতাংশ কমে গেছে।

পানি আইসপি কী কইরি। আসার জো নাই। নটাবাড়িয়ার সুইস গেট যে বন্ধ। দেখতেচেন না বিলডা একেবারে শুকনা। একমাজা পানিও নাই। গেট যখন খুইলে দেয়, তখন ভালো পানি আসে।শহিদুল ইসলাম, শ্রমিকচলনবিলের চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে

চলনবিলের প্রধান প্রধান অংশ গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই ঘুরে দেখেছি। ২৬ জুলাই চাটমোহর উপজেলার ছাইখোলা ইউনিয়নের বোয়ালমারী ব্রিজের নিচে রামনগর গ্রামের চাষিদের পাট নামাতে দেখলাম। এখনো বিলে পর্যাপ্ত পানি নেই দেখে পাটের মালিক রামনগর গ্রামের কৃষক তাজিম উদ্দিন (৬৫) বললেন, ‘পানি আইসপি কী কইরি। আসার জো নাই। নটাবাড়িয়ার সুইস গেট যে বন্ধ। দেখতেচেন না বিলডা একেবারে শুকনা। একমাজা পানিও নাই। গেট যখন খুইলে দেয়, তখন ভালো পানি আসে।’

সেতুর আরেকটু সামনে গিয়ে সড়কের উল্টো পাশে দেখা গেল আরেক দল লোক পাট ধুইছেন। বিলের পানির অবস্থা জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম (৪০) নামের একজন শ্রমিক বিদ্যুতের খুঁটির একটি কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘চলনবিলের পানি অত দূর পর্যন্ত ওঠে। এবার কেন হয়নি, তা আল্লাহ জানে।’

তাজিম উদ্দিনের কথামতো নটাবাড়িয়া স্লুইসগেটের কাছে গিয়ে দেখি, ১৪টি গেটের মধ্যে ২টি গেট খোলা হয়েছে। সেখানে কথা হলো নটাবাড়িয়া গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আজাদ হোসেনের (৫২) সঙ্গে। তিনি বলেন, গুমানী নদী হয়ে সব কটি নদীর পানি একযোগে এই কিনু সরকারের জোলা দিয়ে বিলে পানি যায়। এখন স্লুইসগেটের সব গেট খুলে দেওয়া দরকার। তাঁরা খোলার পক্ষে। কেন খোলে না, তাঁরা জানেন না।

আরও পড়ুনচলনবিলে কেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস২১ ঘণ্টা আগে

সিইজিআইএস চলনবিলের বর্তমান দুরবস্থার কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে। বলা হয়েছে, বিলে ১৫টি পোল্ডার (বেষ্টনী) নির্মাণ করা হয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ এবং স্লুইসগেটসহ ১৮০টি নিয়ন্ত্রণমূলক স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ১৮৮টি। ফলে পোল্ডারের ভেতরের এলাকাগুলো নদ-নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে; নদ-নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে; চলনবিলের চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে।

চাটমোহরের বওশা ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে গুমানী নদী। এই নদীতে আত্রাই ছাড়া যমুনার পানিও ঢোকে। একসঙ্গে সব পানি গুমানী নদী হয়ে কিনু সরকারের জোলা দিয়ে চলনবিলে পড়ে। ওই ব্রিজের ওপর কথা হয় করোকলা গ্রামের কৃষক শাহজামালের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর অ্যাদ্দিন বিলে পানি উইঠা যায়।’

সেখান থেকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে গিয়েও পানির একই অবস্থা দেখা যায়। তাড়াশ পশ্চিম ওয়াপদা বাঁধের ব্যবসায়ী সোলেমান প্রামাণিক (৬৫) বলেন, এরশাদের আমলে এই বাঁধ নির্মাণের পর তাড়াশের পূর্ব পাশে আর পানি নেই। ’৮৮-এর বন্যার সময় পশ্চিম পাশ প্লাবিত হলে তখন লোকজন বাঁধের দুই জায়গা কেটে দেন। সেই দুই জায়গায় তারপর স্লুইসগেট স্থাপন করা হয়। ওই বাজারেই কথা হয় মৎস্যজীবী আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। মাছের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘পানি নাই মাছ আসপি কোত্থাকে। এখন সব পুকুর হইছে। তাতে বড় বড় মাছ হচ্ছে। তাড়াশ থাইকে পুবের দিক যত যাবেন, দেকবেন সার সার পুকুর।’

সিইজিআইএসের গবেষণা বলছে, ২০১৪ সালের আগে চলনবিলে মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এখন তা কমেছে ১১ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ উৎপাদন কমেছে ৫৫ শতাংশ। দেশীয় মাছ ছিল ১০৫ প্রজাতির, এখন কমে হয়েছে ৬০ প্রজাতির। কমার হার ৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য দিন দিন চলনবিল এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানির স্তর নিচে নামছে, সেই পরিমাণ আর রিচার্জ হচ্ছে না।

পানি নাই মাছ আসপি কোত্থাকে। এখন সব পুকুর হইছে। তাতে বড় বড় মাছ হচ্ছে। তাড়াশ থাইকে পুবের দিক যত যাবেন, দেকবেন সার সার পুকুর।মৎস্যজীবী আমিরুল ইসলামবেহাত বড়াল নদ

বড়াল নদের উৎসমুখ রাজশাহীর চারঘাটে ও ভাটিতে নাটোরের আটঘরিতে ১৯৮৫ সালে স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। এরপর আটঘরি থেকে বড়াইগ্রামের বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটার বড়ালের মৃত্যু হয়েছে। ভাটিতে বড়াইগ্রামের জোয়ারি গ্রাম, যেখানে সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশীর বাড়ি ছিল।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিফাত করিম প্রথম আলোকে বলেন, বড়াল নদের দখলকৃত অংশ উদ্ধারের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছিল। সেটা সম্প্রতি ফেরত এসেছে। এটা আবার পুনর্মূল্যায়ন করে পাঠানো হবে।

গত ২৬ জুলাই পাবনার চাটমোহরে গিয়ে চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এই বড়াল নদের অন্তত ১০০টি খাল দিয়ে চাটমোহরের পাঁচটি বিলে পানি ঢুকত। এখন সব খাল বেদখল হয়ে গেছে। বিলগুলো মরে যাচ্ছে। বড়ালের ১৮ কিলোমিটার এলাকা উদ্ধার করতে না পারলে পদ্মার পানি বড়ালের মাধ্যমে সরাসরি চলনবিলে আসার উপায় নেই। নন্দকুঁজা নদী হয়ে যতটুকু আসছে, তাই।

একটি খালের অবস্থা দেখানোর জন্য মিজানুর রহমান চাটমোহর পাইলট হাইস্কুলের পাশের বেতুয়াপাড়া খালের মুখে নিয়ে যান। ওই খালের ওপর একটি চায়ের দোকান করেছেন মুকুল সরকার। ছবি তোলা দেখেই তিনি ছুটে এলেন। জানতে চাইলেন, ‘এই খাল কি আবার খনন করা হবে?’ খাল বরাবর সামনে দিকে গিয়ে দেখা গেল সাড়ারার বিলের কাছাকাছি একটি জায়গায় মাটি দিয়ে খালের পুরোটাই ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

১২টি পোল্ডার সৃষ্টির জন্য ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আর ১ হাজার ১৮৮ কিলোমিটার সড়ক, ১১৩টি সেতু এবং ৮৫৫টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।চলনবিল ধ্বংসের শুরু যেভাবে

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার চলনবিলের সংকট ততটা প্রকট হয়নি। তখন পর্যন্ত শুধু রেললাইন, রাজশাহী-নওগাঁ ও বগুড়া-নাটোর সড়ক হয়েছে। তারপরও ১৯৭৫ সালের মার্চে চলনবিল এলাকার ৮০০ বর্গকিলোমিটারে পানি ছিল।

সিইজিআইএসের গবেষণা বলছে, ১৯৮৫ সালের মধ্যে গোটা পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। এই এক দশকে চলনবিল এলাকায় ৫টি পোল্ডার এবং ৯১টি নিয়ন্ত্রণমূলক স্থাপনা নির্মিত হয়। ফলে ’৮৫ সালের মার্চে চলনবিলের মাত্র ২৮০ বর্গকিলোমিটারে পানি থাকতে দেখা যায়। এ থেকে পরিষ্কার, চলনবিলের ভূপ্রকৃতি বিনষ্ট করা হয়েছে এবং এই বিলকে জলশূন্য করার পেছনে মূল দায়ী হলো পোল্ডার এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বহু নিয়ন্ত্রণমূলক স্থাপনার নির্মাণ।

১৯৯৫ সাল নাগাদ চলনবিলে পোল্ডারের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ১৪–তে দাঁড়ায়। পানি নিয়ন্ত্রণের স্থাপনার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৮০–তে পৌঁছে। এর ফলাফলও স্পষ্ট। সে বছরের মার্চে (শুষ্ক মৌসুম) চলনবিলের মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটারে দশমিক ১৫ শতাংশে পানি ছিল। এভাবে চলনবিলকে মৃতপ্রায় অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়।

তার পর থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ পোল্ডারের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হয় এবং নিয়ন্ত্রণমূলক স্থাপনার সংখ্যা ২১৫–তে বৃদ্ধি পায়। তবে এ সময়কালে চলনবিল এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন ঘটে, তা হলো বদ্ধ পদ্ধতির মাছ চাষের বিস্তার। এ জন্য বহু বদ্ধ পুকুর খনন করা হয়। এর ফলে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে চলনবিলে পানিসম্পন্ন এলাকার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার।

দেখা যায়, ১২টি পোল্ডার সৃষ্টির জন্য ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আর ১ হাজার ১৮৮ কিলোমিটার সড়ক, ১১৩টি সেতু এবং ৮৫৫টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।

পুকুরের কাছে যাওয়ার জন্য একটি নৌকা ঠিক করা হলো। কিন্তু মাঝি বললেন, ‘পানি নাই স্যার। ঘাসের ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে।’সবই আছে চলনবিলে

সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া, ইতালি, চৌগ্রাম আর তাজপুর ইউনিয়ন চলনবিলের অংশ। গত ২৮ জুলাই বিকেলে সিংড়ার চলনবিল গেট দিয়ে যেতে যেতে ডান পাশে পড়ল তাজপুর ইউনিয়ন, বাঁ পাশে চৌগ্রাম। রাস্তার দুই পাশেই দেখা গেল, বিলের ভেতরে সারি সারি পুকুর। আর তার পাড়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কলাগাছ। কবিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি পার্ক। নাম ‘চলনবিল পর্যটন পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র’।

এর বিপরীত পাশেই তাজপুর ইউনিয়নের কয়রাবাড়ি বিলের চলনবিল পয়েন্টে ভাসমান একটি রেস্তোরাঁ। বর্ষায় পানি এলে রেস্তোরাঁটি জমজমাট চলে। কিন্তু এখন পানি নেই। কাছে গিয়ে দেখা গেল, রেস্তোরাঁকে ঘিরে কচুরিপনা আর ঘাস গজিয়ে উঠেছে। সেখান থেকে একটু দূরেই দেখা যাচ্ছিল সারি সারি পুকুর।

পুকুরের কাছে যাওয়ার জন্য একটি নৌকা ঠিক করা হলো। কিন্তু মাঝি বললেন, ‘পানি নাই স্যার। ঘাসের ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে।’ সেখানে বিলতাজপুর গ্রামের যুবক তাজুল ইসলাম বলেন, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। কার্তিক মাস থেকে এলাকার লোকজন বিলের শামুক তোলাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। প্রতিদিন ট্রাক ট্রাক শামুক দিনাজপুরের দিকে যায়। তিনি বলেন, একসময় বিলে কত পাখি দেখেছেন। এখন একটা বক পর্যন্ত নেই। মাছও নেই আগের মতো। নির্বিচার কীটনাশক ব্যবহার এ জন্য দায়ী বলে তিনি মনে করেন।

চলনবিল উদ্ধার, সংরক্ষণ ও রক্ষায় একটি ‘চলনবিল কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইসগেট অপসারণ এবং সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, চলনবিল এলাকার সব নদী, খাল ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দখল ও দূষণমুক্ত করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল

রেস্তোরাঁর ওপর দাঁড়িয়েই কথা হলো এর মালিক মোহাম্মদ শামীম হোসেনের (৪৫) সঙ্গে। বললেন, চলনবিলের পানি সব সময় প্রবাহমান, এ জন্য বিলের নাম হয়েছে চলন। তিনি দেখালেন, পানিতে এখনো খুব হালকা হলেও স্রোত আছে। তার মানে পানি চলছে। নদীর পানির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গুড় নদের পানি তিনটি খালের মাধ্যমে বিলে আসে। তিনটি খালের মধ্যে প্রধান দুটি—মহেশচন্দ্রপুর ও বলিয়াবাড়ি (কিষ্টপুর) খালের মুখ বন্ধ করে দোকানপাট, হাটবাজার, বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। আর ফকিরপাড়ার যে খালটা চালু আছে, সেটা অনেক ভাটিতে। স্থানীয়ভাবে এই খালগুলোকে জোলা বলা হয়।

শামীমের কথা অনুযায়ী, সিংড়ার কলম ইউনিয়নের মহেশচন্দ্রপুর গ্রামে গিয়ে দেখি, কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গুড় নদ ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু খাল দিয়ে সেই পানি বিলে নামার উপায় নেই। তিন বছর আগে মহেশচন্দ্রপুর মদিনাতুল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ খালের মুখ ভরাট করে ফুটবল মাঠ ও মার্কেট করেছে। মার্কেটের ৯টি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মুদিখানার একটি দোকান চালান মজনু মোল্লা। তিনি বলেন, তাঁর দোকানের ভাড়া দেন এক হাজার টাকা।

গুড় নদ আর খালের মুখে গিয়ে দেখা যায় দুটি বাড়ি। একটির মালিক আমিরুল প্রামাণিক। অন্যটির মালিক তাঁর চাচাতো ভাই জাকির প্রামাণিক। ছবি তুলতে গেলে জাকির প্রামাণিক ও তাঁর পরিবারের লোকজন পেছন–পেছন ছুটে যান। খালের মুখে কেন বাড়ি করেছেন, জানতে চাইলে জাকির প্রামাণিক বলেন, ‘মাদ্রাসার ফুটবল মাঠ আর মার্কেট করার পর এই জায়গাটায় পানি জমে ছিল। আমরা ভরাট করে বাড়ি করেছি। এটা পৈতৃক সম্পত্তি।’

চলনবিলের পানি সব সময় প্রবাহমান, এ জন্য বিলের নাম হয়েছে চলন। তিনি দেখালেন, পানিতে এখনো খুব হালকা হলেও স্রোত আছে। তার মানে পানি চলছে।

ফুটবল মাঠের অপর প্রান্তেই খাল এখনো বহাল রয়েছে। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মাদ্রাসার সেক্রেটারি আবু তালেব বলেন, ‘১০-১৫ বছর আগেই এলাকাবাসী জোলার মুখে বাঁধ দিয়েছিল। আমরা মন্ত্রী ও মেয়রের সঙ্গে কথা বলে বাকি জায়গাটা ভরাট করে নিয়েছি। সেখানে মার্কেট করেছি।’

জানতে চাইলে নাটোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিফাত করিম বলেন, তিনি গত ডিসেম্বরে নাটোরে যোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি অবগত নন। এখন জানলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

চলনবিলকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে তা সংরক্ষণে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চলনবিল উদ্ধার, সংরক্ষণ ও রক্ষায় একটি ‘চলনবিল কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইসগেট অপসারণ এবং সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, চলনবিল এলাকার সব নদী, খাল ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দখল ও দূষণমুক্ত করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। চলনবিলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ