মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা ২১ বছর বয়সে হজ করার জন্য মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন জন্মভূমি তানজিয়ার থেকে। সেটা আজ থেকে ৭০০ বছর আগের কথা। ১৩২৫ সালের জুন মাসে সফর শুরু করেন হেঁটে। ফলে প্রায় এক বছর পর ১৩২৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর প্রথম হজ সম্পন্ন করেন। হজ সেরে তিনি মধ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেন। মোট আড়াই দশকের পথ পরিক্রমায় তিনি ১ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণকালে তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তাঁর সফরনামা ‘রিহলা’য় উঠে এসেছে বিশ্বভ্রমণের বৈচিত্র্যময় বিবরণ।
ইবনে বতুতা অন্তত তিনবার, আরেক বিবরণ অনুসারে পাঁচবার হজ করেছেন। দ্বিতীয়বার ১৩২৯ বা ১৩৩০ সালে আর তৃতীয়বার ১৩৪৭ বা ১৩৪৯ সালে। তৃতীয়বার হজ সেরে তিনি নিজ দেশে তানজিয়ারে ফিরে যান। এর মধ্য দিয়ে তাঁর পশ্চিম আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের সফর শেষ হয়। এরপর তিনি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আন্দালুসে (স্পেন) সফর করে আবার তানজিয়ারে আসেন। সেখান থেকে মরক্কোর ফেজ নগরীতে যান। সেখান সুলতান আবু ইনান ফারিজের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর ‘রিহলা’ রচনায় মনোনিবেশ করেন। প্রকৃতপক্ষে ইবনে বতুতার স্মৃতি থেকে বলে যাওয়া বিবরণের ভিত্তিতে সফরগাথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন ইবনে জুজাই।
ইবনে বতুতা অন্তত তিনবার, আরেক বিবরণ অনুসারে পাঁচবার হজ করেছেন। তৃতীয়বার হজ সেরে তিনি নিজ দেশে তানজিয়ারে ফিরে যান। এর মধ্য দিয়ে তাঁর পশ্চিম আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের সফর শেষ হয়।আরও পড়ুনকাবার গিলাফ ‘কিসওয়া’১৩ মে ২০২৫যাত্রা শুরু
ইবনে বতুতা জানাচ্ছেন, তিনি ৭২৫ হিজরির রজব মাসের ২ তারিখ বৃহস্পতিবার (১৩২৫ সালের ১৪ জুন) নিজ বাড়ি থেকে বের হন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার জন্মভূমি তানজিয়ার থেকে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় রজব আমি বের হই মক্কার পবিত্র কাবাঘর ও মদিনায় নবীজির রওজা জিয়ারত করার নিয়তে। কোনো সঙ্গী বা কোনো কাফেলা না পেয়ে একাকী সফর শুরু করি। কারণ, ভেতর থেকে প্রবল তাগিদ বোধ করছিলাম এই দুই বিখ্যাত পূণ্যস্থান দর্শন করার জন্য। তাই সব প্রিয়জনকে ত্যাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই যেভাবে পাখিরা তাদের নীড় ছেড়ে উড়ে যায়। আমার মা–বাবা তখন জীবিত। তাঁদের ছেড়ে যাওয়া আমার জন্য বড় ভারবাহী হয়ে ওঠে। যখন আলাদা হয়ে যাই, তখন আমরা সবাই বেদনাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমার বয়স তখন ২২ বছর।’
মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়
তানজিয়ার থেকে রওনা হওয়ার প্রায় ১০ মাসের মাথায় ইবনে বতুতা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তিনি প্রায় দুই মাস অবস্থান করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ফেরাউনের বাতিঘর দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, এক পাশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। বর্গাকৃতির এই ভবন ছিল আকাশচুম্বী। এতে প্রবেশের একমাত্র দরজাটিও সমতল থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। .
ইবনে বতুতা আলেকজান্দ্রিয়ায় আল-মুরশিদি নামের এক পুণ্যবান ও জ্ঞানী ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান। তিনি একটি গ্রামে জাগতিক সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করতেন। অলৌকিকভাবে তাঁর খাবার আসত। তবে তাঁর কাছে লোকজনের ভিড় লেগেই থাকত। ইবনে বতুতা নিজের সাক্ষাতের ঘটনা লিখেছেন এভাবে, ‘যখন আমি শায়খের কাছে গেলাম, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গন করলেন এবং তাঁর সঙ্গে খেতে বললেন। তাঁর পরনে ছিল কালো উলের কুর্তা। নামাজের সময় হলে তিনি আমাকে ইমামতি করতে বললেন। এরপর যে কয় দিন ওখানে ছিলাম, আমি তা-ই করেছি। রাতে যখন ঘুমানোর সময় হলো, তিনি আমাকে বললেন, ছাদে গিয়ে ঘুমাও। তখন গরমকালের প্রচণ্ড তাপে সবাই ওষ্ঠাগত। তাই তিনি আমাকে একটু আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন কর্মকর্তাও তখন তাঁর অতিথি ছিলেন। আমি প্রথমে সুলতানের সেই কর্মকর্তার জন্য ছাদে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে বললেন, সবারই নির্ধারিত জায়গা আছে। আমি ছাদে গিয়ে দেখি, একটা খড়ের বিছানা, একটি চামড়ার পাটি আর হাতমুখ ধোয়া ও পান করার জন্য পানির একাধিক জগ। আমি ওখানে শুয়ে পড়লাম। সে রাতেই স্বপ্ন দেখলাম যে বিরাটাকায় একটি পাখির ডানায় আমি চেপে বসেছি আর পাখিটা আমাকে মক্কার দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাখিটি দক্ষিণে ইয়েমেনের চলে পূর্বমুখী হয়ে আবার দক্ষিণমুখী হয়। তারপর আবার পূর্বমুখী হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সবুজ দেশে আলো জ্বেলে নামিয়ে দেয়।’
ঘুম থেকে জেগে ইবনে বতুতা স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি নিজেকে বলেন, ‘শেখ যদি আমাকে দেখে বলেন, আমি কী স্বপ্ন দেখেছি, তাহলে বুঝব যে লোকজন তাঁর সম্পর্কে যা বলে, তা সত্যি।’ পরে যা হলো তা ইবনে বতুতার ভাষায়, ‘ভোরে আমি ফজরের নামাজের ইমামতি করলাম। এরপর সুলতানের কর্মকর্তা তাঁর কাজে চলে গেলেন। শেখ আল-মুরশিদি অন্য দর্শানার্থীদের ছোট ছোট পিঠা দিলেন। তাঁরা চলে গেলেন। ইশরাকের নামাজের পর তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি রাতে কী স্বপ্ন দেখেছি। আমি যা দেখেছি, তা বললাম। শুনে তিনি বললেন, তুমি মক্কায় হজ করতে ও মদিনায় রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করতে যাচ্ছ। এরপর তুমি ইয়েমেন, ইরাক, তুরস্ক ও হিন্দুস্তান সফর করবে। হিন্দুস্তানে তুমি অনেক দিক থাকবে, যেখানে আমার ভাই দিলশাদের সঙ্গে তোমার দেখা হবে। তিনি তোমাকে একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।’
সে রাতেই স্বপ্ন দেখলাম যে বিরাটাকায় একটি পাখির ডানায় আমি চেপে বসেছি আর পাখিটা আমাকে মক্কার দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।ইবনে বতুতা, বিখ্যাত মুসলিম পর্যটকআরও পড়ুনহজযাত্রীদের স্বাস্থ্যসতর্কতা১৪ মে ২০২৫দামেস্ক হয়ে মদিনা
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বিভিন্ন শহর ও বন্দর পাড়ি দিয়ে ১৩২৬ সালের আগস্ট মাসে ইবনে বতুতা দামেস্কে হাজির হন। তখন ছিল রমজান মাস। তিনি ওখানকার মালিকি (মাজহাব পরিচালিত) কলেজে ছিলেন। দামেস্ক থেকে এক মাসের মাথায় রওনা দেন মক্কার উদ্দেশে। তিনি লিখেছেন, ‘শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখা যাওয়ার পর হিজাজের একটি কাফেলা শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করল। প্রথমে কাফেলাটি কিসউই গ্রামে তাঁবু গাড়ল। আমি এ কাফেলার সঙ্গে যোগ দিলাম। কিসউই থেকে আমরা সামামাইন গ্রাম পাড়ি দিয়ে হাওরান জেলার ছোট্ট শহর জু’রায় থামলাম। ওখান বিশ্রাম নিয়ে থেকে আরেকটি ছোট শহর বসরার দিকে অগ্রসর হলাম। কাফেলাগুলো সাধারণ এখাতে চার রাত যাত্রাবিরতি দেয় যেন কেউ পথে দলছুট হয়ে পড়লে এখানে এসে যেন যোগ দিতে পারে। মুহাম্মদ (সা.) যখন তরুণ ও খাদিজার ব্যবসায় নিযুক্ত কারবারি, তখন তিনি একবার এখানে এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের (বুহাইরা) সাক্ষাৎ পান। বুহাইরা তাঁকে নবী হওয়ার আগাম আভাস দিয়েছিলেন। [প্রকৃতপক্ষে বুহাইরার সঙ্গে নবীর (সা.) সাক্ষাৎ হয়েছিল যখন তাঁর বয়স ১১ বা ১২ বছর। তিনি চাচা আবু তালিবের সওদাগরের কাফেলায় সিরিয়ায় যাওয়ার সময় এ সাক্ষাৎ হয়।
ইবনে বতুতার বর্ণনানুসারে, যে স্থানে মুহাম্মদ (সা.) উট বেঁধেছিলেন, সেখানে এখন একটি বড় মসজিদ আছে। হাওরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এখানে ছুটে আসেন হজযাত্রীদের কাছে সওদা বিক্রির জন্য। দীর্ঘ সফরে ইবনে বতুতা সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে তাবুক, তাহামুদ, উলা ও ইতাস উপত্যকা পেরিয়ে মদিনায় পৌঁছান। সেখানো কয়েক দিন থেকে তাঁরা মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। ইবনে বতুতার ভাষায়, ‘যখন মদিনা ছেড়ে মক্কার দিকে যাত্রা শুরু হলো, তখন আমরা জুলহুলাইফা মসজিদের কাছে এসে থামলাম। এখানেই নবীজি (সা.) তাঁর বিদায়ী হজের জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন। মদিনা থেকে পাঁচ মাইল দূরে আকিক উপত্যকার পাশে। এটা পবিত্র মদিনা নগরীর অন্যতম সীমানা নির্দেশক। এখানে এসে আমি আমার সেলাই করা জামা-কাপড় খুলে ফেললাম। তারপর গোসল করে সেলাইবিহীন দুই খণ্ড সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নিয়মমাফিক নামাজ আদায় করলাম। এভাবেই আমি ইহরাম বেঁধে হজ আদায়ের নিয়ত করলাম, যা ওমরাহ থেকে আলাদা। আমি এতটা উদ্বেল হয়ে পড়েছিলাম যে কাফেলার সবার তালবিয়া পড়ার নেতৃত্ব দিতে থাকলাম। তালবিয়া পড়তে পড়তে পাহাড় ও উপত্যকা পেরিয়ে গিরি আলীতে এসে আমরা রাতের বিশ্রামের জন্য থামলাম।’
ইবনে বতুতার বর্ণনানুসারে, যে স্থানে মুহাম্মদ (সা.) উট বেঁধেছিলেন, সেখানে এখন একটি বড় মসজিদ আছে। হাওরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এখানে ছুটে আসেন হজযাত্রীদের কাছে সওদা বিক্রির জন্য।আরও পড়ুনবাঙালির হজযাত্রা: একাল-সেকাল১৪ মে ২০২৫মক্কায় আগমন
ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘আমি যখন মক্কায় আসি, তখন মক্কার আমির [শরিফ হিসেবেই বেশি পরিচিত] ছিলেন দুই ভাই—রুমাইসা ও আতাইফা। তাঁরা ছিলেন আবু নাইম কিতাদার দুই পুত্র। তাঁরা সবাই মহানবী (সা.)-এর নাতি হাসানের বংশধর। বয়সে বড় হলেও রুমাইসা শুক্রবার জুমার খুতবায় তাঁর নিজের নামের আগে ছোট ভাই আতাইফার নাম উচ্চারণের জন্য বলেছিলেন। কারণ, ন্যায় বিচারক হিসেবে আতাইফার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। মারওয়া পাহাড়ের ডান দিক ছিল আতাইফার বাড়ি। আর রুমাইসা বাস করতেন বনি শায়েবা ফটকের কাছে আল-শারাবি নির্জনাবাসে। প্রতিদিন সকালে তাঁদের বাসভবনের দরজার বাইরে ঢাক পেটানো হতো।’
মক্কায় গিয়ে ইবনে বতুতা প্রথম যখন পবিত্র কাবাঘর দেখলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে নববধূর মতো ভীরু-কম্পিত অথচ গর্বিত পা ফেলে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, ‘…আমরা সাতবার কাবা প্রদক্ষিণ করলাম এবং পবিত্র পাথরে (হাজরে আসওয়াদ) চুম্বন করলাম। এরপর মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। …আমরা অনেকক্ষণ কাবার গিলাফ আঁকড়ে ধরে ছিলাম...যেখানে দোয়া কবুল হয়। ...জমজমের পানি পান করার পর সাফা-মারাওয়ায় দৌড়ালাম [সাঈ]।’
মক্কায় গিয়ে ইবনে বতুতা প্রথম যখন পবিত্র কাবাঘর দেখলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে নববধূর মতো ভীরু-কম্পিত অথচ গর্বিত পা ফেলে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন।আরও পড়ুনঈদুল আজহা ও হজ যখন প্রতিবাদের ক্ষেত্র১২ মে ২০২৫ইবনে বতুতা ওই সময়ের হজের আচার-অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায় যে জিলহজ মাসের প্রথম দিন সকাল ও সন্ধ্যায় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রাক্কালে ঢাক ও দামামা বাজানো হয়। আরাফার দিন [৯ জিলহজ] শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিদিনই এমনটা করা হয় হজের মৌসুম পালনের জন্য। তিনি লিখেছেন, ‘৭ জিলহজ জোহরের নামাজের পর ইমাম সাহেব চমৎকার এক ভাষণ দিলেন। এতে তিনি হজ পালনের নিয়ম-কানুনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা তুলে ধরেন ও আরাফার দিন সম্পর্কে অবহিত করেন। ৮ জিলহজ সকাল থেকেই লোকজন মিনার দিকে যাত্রা করে। সিরিয়া, মিসর ও ইরাকের আমিররা বেশ বড় বহর নিয়ে এসেছিলেন। মিনায় রাতযাপনকালে তাঁদের মধ্যে জাঁকজমকের প্রতিযোগিতা শুরু হয় মোমবাতির আলো জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। অবশ্য বরাবর এ ক্ষেত্রে সিরীয়রা সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে।’
নিজের হজের সময়টা তুলে ধরতে চেয়ে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘আরাফাতে আমার প্রথম অবস্থানের দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, ৭২৬ হিজরি [নভেম্বর ৬, ১৩২৬]।…সূর্যাস্তের পর ভিড় ঠেলে আমরা মুজদালিফায় গিয়ে পৌঁছালাম। ওখানে আমরা একত্রে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করলাম। এটাই রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ। পরদিন ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে মিনার উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে আমরা মাশআর আল-হারামে থেমে দোয়া করলাম। পুরা মুজদালিফাতেই থামা যায়, শুধু ওয়াদি মুহাসসির ছাড়া। হাজিরা এ স্থানটুকু দ্রুত হেঁটে অতিক্রম করেন। বেশির ভাগ হাজিই মুজদালিফা থেকে পাথর সংগ্রহ করেন জামারায় ছোড়ার জন্য। এটাই বলা হয়েছে। তবে কেউ কেউ আল-খায়েফ মসজিদের আশপাশ থেকে পাথর সংগ্রহ করেন।’
আরও পড়ুনহজের ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনাচক্র২৩ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ র র জন য ন কর র মসজ দ সফর শ জ লহজ ব বরণ করল ম প রথম র সময় বলল ন ল কজন তখন ত
এছাড়াও পড়ুন:
প্রিয় মদিনা, মসজিদে নববি এবং অন্যান্য
মক্কা থেকে ২৯০ মাইল উত্তরে মদিনা। শহরটি লোহিত সাগরের পাড় থেকে ৯০ মাইল পূর্বে। ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম শহর মদিনা। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর এটি। মদিনা প্রদেশের রাজধানী মদিনা আল মুনাওয়ারাহ, যার অর্থ আলোকিত শহর।
মদিনায় ৬২২ সালে মুহাম্মদ (সা.) মসজিদে নববি নির্মাণকাজ শুরু করেন। নবীজি (সা.) চেয়েছিলেন এমন একটি মসজিদ বানাতে, যার সংলগ্ন জায়গায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকতে পারবেন। স্থানীয় সব গোত্রই তখন জমি দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু তিনি কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করতে চাইলেন না।
মুহাম্মদ (সা.) বললেন, তিনি যে উটের পিঠে চড়ে আসবেন, সেই উটটি যেখানে থামবে, সেখানেই হবে মসজিদ। দেখা গেল, উট যেখানে বসল, সেটি দুইজন এতিমের জায়গা। তখন নবী (সা.) আবু বকর (রা.)-কে বললেন, তাদের জমির মূল্য পরিশোধ করে দিতে। এরপর তিনি মসজিদের নকশা করেন এবং অন্য মুসলিমদের সহায়তা নিয়ে তা বানানো শুরু করলেন। মসজিদটি
বানাতে যতদিন লেগেছিল, ততদিন তিনি সাহাবি আবু আইয়ুব আল-আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে ছিলেন।
পবিত্র কোরআনের প্রায় অর্ধেক মদিনায় নাজিল হয়েছে। মদিনা আরও কয়েকটি নামে পরিচিত– ইয়াসরিব, তায়বা, আল-আজরা, আল-মুবারাকাহ, আল-মুখতারাহ ইত্যাদি।
মসজিদে নববি-সম্পর্কিত তথ্য
পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা দরজা ও নামাজের জায়গা রয়েছে। মসজিদে প্রবেশের প্রতিটি গেটে নিরাপত্তাকর্মী থাকেন। তারা কারও সঙ্গে বড় আকারের ব্যাগ থাকলে তা চেক করে থাকেন। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে ২২৯টি দরজা, ১৯৬টি স্থির ও চলমান গম্বুজ ও ১০টি মিনার রয়েছে। মসজিদের প্রতিটি বড় প্রবেশ দরজার ফটকে নামাজের সময়সূচি টাঙানো আছে।
মসজিদের চত্বরের চারপাশে ২৬২টি সানশেড বৈদ্যুতিক ছাতা রয়েছে। এসব ছাতা দিনের বেলায় খোলা থাকে এবং রাতে বন্ধ থাকে। মসজিদের ভেতরে সব জায়গায় জমজম কূপের পানির কনটেইনার পাওয়া যায়। মসজিদের ভেতরে জুতা-স্যান্ডেল রাখার জন্য অসংখ্য শেলফ রয়েছে। পর্যাপ্ত চেয়ার, বুকশেলফ ও রেহাল আছে।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মসজিদের ভেতরে কাজ করেন। তাদের অধিকাংশই পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিক। মসজিদের মধ্যে অনেক তাক রয়েছে। সেখান থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে পড়তে পারেন।
ঋতুভেদে এখানে সময় কিছুটা পরিবর্তন হয়। মসজিদে নববির চারপাশে কিছু মিউজিয়াম ও এক্সিবিশন হল আছে। এগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। কবরস্থান ফজরের নামাজের পরে, বিকেলে আসরের নামাজের পরে জিয়ারতের জন্য খোলা থাকে।
মদিনার ঐতিহাসিক স্থান
মদিনার ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখা যায়। ফজর নামাজের পর বের হলে সবকিছু ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। মসজিদে নববির সামনে ও শহরের অন্যান্য রাস্তায় চালকেরা ‘জিয়ারা, জিয়ারা’ বলে যাত্রীদের ডাকাডাকি করেন। জিয়ারা মানে ভ্রমণ।
কয়েকজন মিলে গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। এই জিয়ারা প্যাকেজে ওহুদ পাহাড়, মসজিদে কুবা ও মসজিদে কিবলাতাঈন ঘুরে দেখা যায়। এতে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ রিয়াল খরচ পড়ে। অবশ্য এই প্যাকেজে খন্দক নেই। খন্দক আলাদাভাবে যেতে হয়।
মসজিদে কিবলাতাঈন
কিবলাতাঈন শব্দের অর্থ হলো দুটি কিবলা। মসজিদে কিবলাতাঈন হলো দুই কিবলার মসজিদ। রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে এখানে নামাজ আদায়ের সময় কিবলা পরিবর্তনের ওহি নাজিল হয়। ওহি পাওয়ার পর নামাজের মধ্যে আল-আকসা থেকে মুখ ঘুরিয়ে কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন তিনি। এ জন্য এই মসজিদের নাম কিবলাতাঈন। ভেতরে মূল অংশ অক্ষত রেখে চারদিকে দালান করে মসজিদটি বাড়ানো হয়েছে।
ওহুদ পাহাড়
ওহুদ পাহাড় মদিনার সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। পাথরের এই পাহাড়ের উচ্চতা ৩৫০ মিটার। পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পাহাড়টির প্রস্থ ১০০ থেকে ৩০০ মিটার। ওহুদ শব্দের অর্থ এক বা একক। এটি অন্যান্য পাহাড় থেকে স্বতন্ত্র ও একক বলে ওহুদ নামকরণ করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় যুদ্ধ হয় এই পাহাড় ঘিরে। দুই মাথাওয়ালা একটি পাহাড়, মাঝখানে কিছুটা নিচু। তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে ওহুদ যুদ্ধ হয়। পাহাড়টি মূল্যবান পাথরে সমৃদ্ধ। পাহাড়ের পূর্বে বিমানবন্দর রোড ও পশ্চিমে আল-উজুন গ্রাম।
মসজিদে গামামাহ
গামামাহ শব্দের অর্থ বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.) এখানে নামাজ আদায় করেছেন। তাই মসজিদটির নাম রাখা হয় গামামাহ মসজিদ। রাসুল (সা.) এখানে প্রথম ঈদের নামাজ আদায় করেন। একে ঈদগাহের মসজিদও বলে।
খন্দক
আরব ও ইহুদি গোত্রগুলো একবার সম্মিলিতভাবে মদিনা অবরোধ করেছিল। একে আজহাবের যুদ্ধও বলা হয়। তবে এটি খন্দকের যুদ্ধ নামে বেশি পরিচিত। খন্দক অর্থ পরিখা। পরিখা খননের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে কাবু করার নতুন রণকৌশল ব্যবহার হয়েছিল এই যুদ্ধে।
মুসলমানরা আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধের ময়দানে দীর্ঘ পরিখা খনন করেন। হজরত সালমান
ফারসি (রা.)-এর পরামর্শে মদিনার সব প্রবেশপথে পরিখা খনন করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন মুসলমানরা।
বাদশাহ ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স
মদিনা শহরে তাবুক সড়কে বাদশাহ ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স। হজ শেষে হাজিরা বিমানবন্দর ও হজ টার্মিনাল দিয়ে দেশে ফেরার সময় তাদের হাতে উপহার হিসেবে পবিত্র কোরআন দেওয়া হয়। এখান থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ কপি কোরআন শরিফ ছাপা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কোরআনের অর্থ ও তাফসির মুদ্রণ, ভিডিও, সিডি, ক্যাসেট আকারে প্রকাশ করা হয় এখান থেকে। রয়েছে কোরআন গবেষণাকেন্দ্র, পাঠাগার। এখানে পবিত্র কোরআন বিনামূল্যে বিলি করা হয়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারকে সালাম
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মসজিদ সম্প্রসারণ করার পর বর্তমানে তাঁর কবর মোবারক মসজিদে নববির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
রাসুলে করিম (সা.)-এর রওজা মোবারকের পাশে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর কবর রয়েছে।
হজরত আবু বকর (রা.)-এর রওজার কাছে দাঁড়িয়ে পাঠ করুন: আসসালামু আলাইকা ইয়া খলিফাতা রাসুলিল্লাহি আবু বকর (রা.)।
এবার ডান দিকে সরে গিয়ে হজরত ওমর (রা.)-এর রওজা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে পাঠ করুন: আসসালামু আলাইকা ইয়া আমিরাল মুমিনিন ওমর ফারুক (রা.)।
তারপর সালাম পাঠ করুন
এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদার কথা স্মরণ করে সালাম পেশ করতে হয়। এভাবে সালাম পাঠ করতে পারেন—
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবি ওয়া রহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া নাবিয়াল্লাহ।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া শাফিয়াল মুজনিবিন।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া খায়রা খালকিল্লাহ।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া সায়্যিদাল মুরসালিন।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া খাতামান নাবিয়্যিন।
আসসালাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামিন।
দোয়া কবুলের স্থান
বায়তুল্লাহয় যখন নজর পড়ে
মাকামে ইবরাহিম
হাজরে আসওয়াদ
মাতাফ, মুলতাজাম
জমজম কূপ, সাফা ও মারওয়া
হাতিমের মধ্যে, মিনা, মসজিদে খায়েফ
কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানে
মসজিদে নামিরাহ
আরাফাতে, মুজদালিফায়