শরীয়তপুরে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জেলা শহরে এ সংঘর্ষে দুই পক্ষের সমর্থক, পুলিশ সদস্য, পথচারীসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন। জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা নিয়ে এ সংঘর্ষ হয়।

পুলিশ ও ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেলে কমিটির আহ্বায়ক এইচ এম জাকির ও সদস্যসচিব সোহেল তালুকদারের নেতৃত্বে শহরে একটি আনন্দমিছিল বের করেন তাঁদের সর্মথকেরা। এ সময় পাল্টা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন ওই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পান্থ তালুকদার, বাবু মাদবর, আফজাল খান, ইসহাক সরদারের সমর্থকেরা। মিছিলটি পালং মডেল থানা অতিক্রম করার সময় দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এরপর দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়।

আরও পড়ুনছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা, প্রতিবাদে এক পক্ষের বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ৩ ঘণ্টা আগে

এর আগে সকালে শরীয়তপুর জেলা আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। ৩৫ সদস্যের ওই কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এইচ এম জাকিরকে। তিনি শরীয়তপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী। সদস্যসচিব করা হয়েছে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল তালুকদারকে।

নতুন আহ্বায়ক কমিটির তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রদলের একটি পক্ষ বিক্ষোভ শুরু করে। তারা দুপুরে শরীয়তপুর সরকারি কলেজে ও মাদারীপুর-শরীয়তপুর সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলের সময় তাদের হাতে লাঠি, ঝাড়ু ও জুতা দেখা যায়। বিক্ষোভকারীরা কমিটি বাতিলের দাবি জানান। মিছিল শেষে আদালত এলাকায় সড়কের ওপর বসে অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে নতুন কমিটির আহ্বায়ক জাকির ও সদস্যসচিব সোহেলের নেতৃত্বে সদর উপজেলা পরিষদ থেকে আনন্দমিছিল বের করা হয়। একই সময় শহরের কোট এলাকা থেকে যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু মাদবর ও আফজাল খানের নেতৃত্বে তাঁদের সমর্থকেরা আরেকটি মিছিল বের করেন। মিছিল দুটি পালং মডেল থানার দুই প্রান্ত দিয়ে অতিক্রম করার সময় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ধাওয়া দেয়। তখন থানা ক্যাম্পাসের মধ্যে ও পালং বাজার সড়কে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়।

ওই সংঘর্ষের সময় সাকিব আল হাসান নামের এক পথচারীর মাথা ফেটে যায়। আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তির দোকানের কয়েকটি কাচ ভেঙে যায়। সংঘর্ষের সময় পুলিশের এক সদস্য, একজন পথচারীসহ দুই পক্ষের আরও ১৩ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল ও স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের সময় পালং বাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত তাঁরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।

সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পথচারী সাকিব আল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জামা কেনার জন্য বাজারে এসেছিলাম। এমন সময় দুই পক্ষের মারামারির মধ্যে পড়ে যাই। একটি ইট এসে আমার মাথায় লাগে। রক্তাক্ত হয়ে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। স্থানীয় লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।’

কমিটিতে পদবঞ্চিতরা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন উল্লেখ করে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব সোহেল তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষোভ নিবারণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের আনন্দমিছিলে হামলা করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনি পদক্ষেপ নেব।’

যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুপুর থেকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন। এর মধ্যেই জাকির ও সোহেলের সমর্থকেরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন নিয়ে আনন্দমিছিল করেছেন। ওই মিছিল থেকে তাঁরা আমাদের ওপর হামলা করেছেন। ঘোষণা করা কমিটি বাতিল না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’

বিকেলে সংঘর্ষের সময় হঠাৎ করে থানা চত্বরে দুই পক্ষ ঢুকে পড়ে জানিয়ে পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন জানান, উভয় পক্ষ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ঘটনায় এখনো থানায় কোনো মামলা হয়নি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ঘর ষ র সময় ম ছ ল ব র কর সদস যসচ ব ছ ত রদল র কম ট র সদস য পথচ র

এছাড়াও পড়ুন:

এখানেও প্রেম আছে

রোজ বিকেলে, যখন জানালার কাচে সূর্যের সোনালি আলো গড়িয়ে পড়ে, নীলা নিজের ভেতরের অন্য এক জানালার দিকে তাকায়। সেই জানালা কেউ দেখে না, কেউ জানেও না। বাইরে তখন পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে, রিকশার ঘণ্টা বাজছে, মানুষেরা ঘরে ফিরছে। কিন্তু নীলার চোখে সেই দৃশ্যগুলো যেন কোনো দূর নির্বাক সিনেমার পর্দা, চলছে ঠিকই, কিন্তু শব্দগুলো তার কানে পৌঁছায় না। সে চুপচাপ বসে থাকে বারান্দার কোণে, চায়ের কাপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিশে যায় চারপাশে। বিকেলের আলো তার গাল ছুঁয়ে যায়, কিন্তু সেই উষ্ণতা যেন অন্য কারও ত্বকে লাগে। চুলায় ভাত ফুটে ওঠে, হাঁড়ির ঢাকনা কাঁপে, পাশের বাড়ির বাচ্চারা খেলা থামিয়ে অকারণে হাসতে শুরু করে। আলমারিতে কাপড় ভাঁজ হয়ে থাকে, দেয়ালে ঘড়ির টিকটিক শব্দ বেজে চলে। বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে আসে, ছায়া লম্বা হয়, আর সেই ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে নীলা ধীরে ধীরে বাস্তবের দিকে ফিরে আসে, যেন পর্দার ভেতর থেকে কেউ ফিরে আসছে দর্শকদের ভিড়ে। তার মুখে তখন এক অদ্ভুত স্থিরতা, না পুরো সুখ, না পুরো শোক। শুধু এক টানটান নীরবতা, যেখানে বাস্তব আর কল্পনা—দুটোই দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি, একটা অন্যটার কাঁধ ছুঁয়ে।

নীলার যত্নে গড়া ভুবনে বাজারের ঝাঁজালো গন্ধ নেই, নেই ঘরের অনন্ত কাজের চাপ। নেই ভাত, মসলা, কড়া দুধের ঘ্রাণ। এই জগতে নীলা হাঁটে, তার যেন পা মাটিতে পড়ে না, তবু মনে হয় সে এগিয়ে যাচ্ছে, এক অনির্দিষ্ট মুক্তির দিকে। বাস্তবের পৃথিবীতে সে সংসারী, এখানে প্রতিটি সম্পর্কের মানে নির্দিষ্ট, যেমন মা, স্ত্রী, বউমা।

বাস্তবে সকালে চায়ের কাপে যত্ন ঝরে পড়ে, বিকেলে কাপড়ের ভাঁজে সে তার সময় গোনে। তবু প্রতিদিন কিছু মুহূর্তে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সে আছে এখানেই, কিন্তু আসলে নেই। কোথাও ভেসে গেছে নিজেরই বানানো এক পৃথিবীতে। সেই পৃথিবীতে সে কবিতা লেখে, সমুদ্র দেখে, বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। সেখানে কেউ তাকে ডাকে না, কেউ প্রশ্ন করে না। এমনকি নিজের প্রতিফলনও সেখানে নরম আর শান্ত, যেন কেউ জীবনের সব হিসাব মিটিয়ে দিয়েছে অনেক আগে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ভেতরের পৃথিবী তার বাইরের জীবনকে খেয়ে ফেলতে শুরু করল। বাস্তবের মানুষগুলো যেন দূরে সরে গেল। নীলার স্বামী যখন কিছু বলে, তার কণ্ঠস্বর নীলা ঠিক শুনতে পায় না। ছেলে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, তুমি আমার দিকে তাকাও না কেন?’ নীলা হাসে, কিন্তু সেই হাসি কাচের মতো ঠান্ডা, তার ভেতরের জানালায় তখন রোদ পড়ছে, বাইরেরটায় অন্ধকার।

নীলার যত্নে গড়া ভুবনে বাজারের ঝাঁজালো গন্ধ নেই, নেই ঘরের অনন্ত কাজের চাপ। নেই ভাত, মসলা, কড়া দুধের ঘ্রাণ। এই জগতে নীলা হাঁটে, তার যেন পা মাটিতে পড়ে না, তবু মনে হয় সে এগিয়ে যাচ্ছে, এক অনির্দিষ্ট মুক্তির দিকে। বাস্তবের পৃথিবীতে সে সংসারী, এখানে প্রতিটি সম্পর্কের মানে নির্দিষ্ট, যেমন মা, স্ত্রী, বউমা।

সেদিন এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিল নীলা আর তার স্বামী। ঘরভরা মানুষ, হাসির শব্দ, বাচ্চাদের চেঁচামেচি...সব মিলিয়ে উজ্জ্বল পরিবেশ। সবাই গল্প করছে, হাসছে, খাচ্ছে। কিন্তু নীলা যেন কোথাও দূরের কোনো মেঘের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে এসব দৃশ্যের দিকে। হঠাৎ কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘নীলা, শুনেছি, তুমি খুব ভালো রান্না করো, আজ কী রান্না করলে?’ নীলা হেসে বলল, ‘আজ কিছুই রান্না করিনি, আমি আজ আকাশে বৃষ্টি মাপছিলাম।’ সবাই প্রথমে ভেবেছিল মজা করছে, কেউ কেউ হেসেও ফেলল। কিন্তু তার স্বামী দেখল, নীলার চোখে সেই অচেনা নরম আলো, যেটা সে জানে, সেই আলো বাস্তবের নয়। নীলা কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখ যেন অন্য কোনো দৃশ্য দেখছে। হয়তো তার ভেতরের জানালার ওপারে নরম মানুষগুলো হাঁটছে, হয়তো সে মনে মনে বাতাসের সঙ্গে কথা বলছে, অথচ চারপাশে সবাই শুধু হাসছে, খাচ্ছে, কথা বলছে। একসময় সে টেবিলের ফুলদানি থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে সেটার পাপড়ি ছিঁড়তে লাগল। বলল, ‘দেখো, প্রতিটা পাপড়ির মধ্যে ছোট ছোট নদী আছে। কেউ দেখছ?’ ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নীলার স্বামী তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে বলল, ‘চলো, অনেক রাত হয়েছে।’ কিন্তু নীলা তখনো হেসে যাচ্ছিল, সেই ঠান্ডা, কাচের মতো হাসি, যেন সে একসাথে দুটো পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে, একটা টলমল করছে অন্যটার ওপর।

আরেক দিন বিকেলে নীলা থমকে গিয়েছিল। সেদিন ঘরের বাতাসে ছিল একধরনের ধোঁয়ার গন্ধ, আর দূরে কারও হাসির মৃদু প্রতিধ্বনি। জানালার কাচে বিকেলের আলো। নীলা চায়ের কাপ হাতে নিয়েছিল, যান্ত্রিক ভঙ্গিতে, যেমন প্রতিদিন নেয়। কিন্তু সেদিন কেমন যেন এক অচেনা কম্পন ছড়িয়ে গেল তার আঙুলের ডগায়। কাপটা গরম, তবু তার হাত ঠান্ডা। সে অনুভব করল, কাপের উষ্ণতা তার ত্বক ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই কাপটা সত্যি, কিন্তু যে হাত এটি ধরে আছে, সেটাই অবাস্তব। এক অদ্ভুত ফাঁকা অনুভূতি ভর করল তার মধ্যে। যেন সে নিজের শরীরের ভেতরে নেই। সে তাকিয়ে দেখল নিজের হাত পাতলা শিরা ওঠা, নিস্তেজ। মনে হলো, এই হাত তো তার নয়। এই হাত এক নারীর, যে বছরের পর বছর বাসন মাজে, ভাত বেড়ে দেয়, চুল বাঁধে, মুখে কিছু না বলেও সংসার চালায়। কিন্তু তার নিজের হাত কেমন ছিল?

কোথায় সেই হাত, যে একসময় কবিতা লিখত, আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল? একমুহূর্তের ভেতর নীলা যেন তার সব চেতনা হারিয়ে ফেলল। চায়ের ধোঁয়া তার চোখের সামনে মিশে এক ধূসর পর্দা তৈরি করল। যেন তার ভেতরের জানালা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাতাস থেমে আসছে। সে নিজের হাত শক্ত করে চেপে ধরল, যেন শরীরের ভেতরে নিজের অস্তিত্বের উষ্ণতা টেনে আনতে পারে। কিন্তু হাতের ভেতরে কেবল ঠান্ডা, নিস্তেজতা আর এক ভয়ানক শূন্যতা। চায়ের কাপ কাঁপতে কাঁপতে ফসকে পড়ল মেঝেতে। একচিলতে ধোঁয়া উঠে মিলিয়ে গেল বাতাসে। চায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বাস্তব, তীব্র, জ্বলন্ত। আর সেই গন্ধের ভেতরেই নীলা প্রথমবার অনুভব করল সে আছে। সে এই ঘরে আছে, এই মেঝেতে, এই কাপের ভাঙা কণার পাশে। তার ভেতরের জানালা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। যে জানালা দিয়ে সে প্রতিদিন পালিয়ে যেত, আজ তার ভেতর থেকে তালা পড়ে গেল নরম শব্দে। আর সেই শব্দের ভেতরেই এক নিঃশব্দ উপলব্ধি বাজল, ‘জীবন কল্পনা নয়। বাস্তব।’

সেদিন বিকেলের পর থেকে নীলা আর কখনো জানালার ওপারে তাকায়নি। কারণ সে বুঝে গিয়েছিল, যে পৃথিবীতে ব্যথা আছে, উষ্ণতা আছে, ভাঙা কাপের টুকরোয় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, সেই পৃথিবীই সত্য। সেদিন প্রথম নীলা বুঝল, যে পৃথিবী সে বানিয়ে নিয়েছিল, সেখানে কোনো গন্ধ নেই, কোনো উষ্ণতা নেই, কোনো ব্যথাও নেই। আর ব্যথাহীন জীবন আসলে কোনো জীবন নয়।

কোথায় সেই হাত, যে একসময় কবিতা লিখত, আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল? একমুহূর্তের ভেতর নীলা যেন তার সব চেতনা হারিয়ে ফেলল। চায়ের ধোঁয়া তার চোখের সামনে মিশে এক ধূসর পর্দা তৈরি করল। যেন তার ভেতরের জানালা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাতাস থেমে আসছে।

নীলা দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে বসে রইল ভাঙা কাপের পাশে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা চায়ের দাগ শুকিয়ে বাদামি ছোপ হয়ে গেছে। সে সেই দাগে আঙুল ছোঁয়ায়, চায়ের হালকা গন্ধ এখনো আছে, গরম নেই, কিন্তু গন্ধ আছে। তার মনে হলো, এই গন্ধটাই বাস্তব; এই ছোপটাই সময়ের ছায়া। এই ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলোই তাকে বাঁচিয়ে রাখে, বারবার। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। চুলের সামনে এলোমেলো কয়েকটা গোছা সিঁথির ওপরে পড়েছে। সে আয়নার দিকে তাকাল। দীর্ঘদিন পর নিজের মুখ চিনতে পারল। চোখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু সেই ক্লান্তির ভেতরেই এখন এক আলোকিত স্থিরতা। চুলে সিঁদুর, চায়ের কাপের ধোঁয়া সব একই আছে, শুধু বদলে গেছে তার দৃষ্টির ভঙ্গি। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আগে যেই জানালায় তাকিয়ে সে পালিয়ে যেত, আজ সে সেই জানালা দিয়ে বাইরের আলোয় তাকাল।

দূরে ছেলেটা হাসছে, উঠানে বাতাসে কাপড় উড়ছে, পাশের বাড়ি থেকে ভাজা পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। সবই এমন বাস্তব, এমন জীবন্ত যে তার বুকের ভেতর হালকা ব্যথা টের পেল। আর সেই ব্যথাই ছিল জীবনের স্পন্দন, তার ফিরে আসার চিহ্ন। তার চোখে এখন অন্য এক বোধ জ্বলে, জীবন কল্পনা নয়। বাস্তব। আর বাস্তব যত কষ্টের হোক, এটাই একমাত্র সত্য। কারণ, কল্পনার জগতে সময় থেমে যায়, কিন্তু বাস্তবে সময় চলে, মানুষ বাঁচে, হারে, ভালোবাসে। নীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যালোকের নিচে চুপ করে চোখ বুজল। তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক শান্ত হাসি ফুটল। একটা হাসি যেখানে ব্যথা আছে, তবু শান্তি আছে।

নীলার বিয়ের অনেক আগে একটা ছেলেকে ভালোবাসত। তার নাম অরুণ। অরুণ ছিল স্বপ্নবিলাসী, কবিতা লিখত, নদীর পাড়ে বসে বাতাসের সঙ্গে কথা বলত, ঠিক যেমন আজকের নীলাও করে। কিন্তু অরুণের চাকরি ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত, নীলার বাবা ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বলেছিলেন, ‘ভালোবাসায় সংসার চলে না।’ তাই একদিন হঠাৎ সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, নীলার বিয়ে হবে অন্য কারও সঙ্গে, এক প্রতিষ্ঠিত, শান্ত, বাস্তব মানুষের সঙ্গে। বিয়ের দিন অরুণ আসেনি। তবে নীলা জানত, সে দূর থেকে দেখেছে, নীলা আরেকজনের সঙ্গে সাত পাক ঘুরছে। সে দেখাশোনা ছিল কল্পনায়, যে কল্পনার জগতে নীলা ঘুরে বেড়ায়।

অনেক বছর কেটে গেছে। এখন নীলা ঘোর সংসারী। কিন্তু অরুণ যেন হারায়নি। সে ফিরে আসে, অন্য রূপে, অন্য সময়ে। সে নীলার কল্পনায় বাসা বেঁধে নিয়েছে, নীলার মনের জানালার ওপারে, যেখানে আলো একটু ম্লান, আর সময় থেমে থাকে। প্রথমে নীলা নিজেই টের পায়নি কখনো বিকেলের ছায়ায়, কখনো ঘুমের আগের নিস্তব্ধতায় অরুণের মুখ দেখা যায়, সে মৃদু হাসে, বলে, ‘তুমি সুখী তো, নীলা?’

ধীরে ধীরে নীলা সেই মুখকে বাস্তবের মধ্যে টেনে আনে। কখনো স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘এই তো অরুণ, শুধু চুলে সাদা রেখা পড়েছে।’ স্বামী কোনো কথা বললে নীলা কখনো অরুণের নামে ডাকে, ‘অরুণ, তুমি একটু জল দেবে?’ নীলার স্বামী স্তব্ধ হয়ে তাকায়; নীলা বুঝতে পারে না ভুলটা কোথায়।

ধীরে ধীরে নীলা সেই মুখকে বাস্তবের মধ্যে টেনে আনে। কখনো স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘এই তো অরুণ, শুধু চুলে সাদা রেখা পড়েছে।’ স্বামী কোনো কথা বললে নীলা কখনো অরুণের নামে ডাকে, ‘অরুণ, তুমি একটু জল দেবে?’ নীলার স্বামী স্তব্ধ হয়ে তাকায়; নীলা বুঝতে পারে না ভুলটা কোথায়। তার মনে হয়, সময়টা হয়তো গুলিয়ে গেছে, এটা হয়তো সেই পুরোনো দুপুর, যেখানে অরুণ চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে।

একদিন নীলার স্বামী রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘তুমি কাকে অরুণ বলছ?’ নীলা থেমে গিয়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর মৃদু হেসে বলেছিল, ‘আমি তো তোমাকেই বলেছি।’ কিন্তু তার চোখের গভীরে যে বিস্ময়, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে জানে না আসলে কাকে বলেছে। সেই দিনগুলোতে নীলার ভেতরের জগৎ আরও উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। বাস্তবের আলো-ছায়া, মুখ, গন্ধ সব মিশে গেল কল্পনার মায়ার সঙ্গে। সে কখনো ভাবত, অরুণ এখনো আসে তার জানালার পাশে, কখনো সে স্বামীর মুখে অরুণের ছায়া দেখে। আর ধীরে ধীরে এই দুই পুরুষ একজন বাস্তবের, আরেকজন কল্পনার হয়ে ভেসে যেতে থাকল নীলার ভুবনে। নীলার স্বামী যখন তার চোখের দিকে তাকায়, তখন নীলা জানে না সে আসলে কাকে দেখছে। এই বিভ্রমই তার ভেতরের জানালাকে আরও গভীর করে তোলে, যেখানে অতীতের প্রেম, বর্তমানের সংসার আর অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা এক হয়ে যায় এক নিঃশব্দ স্রোতে।

সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে নীলা বুঝতে পারল, তার ভেতরের মানুষটি এখন আর কেবল কল্পনা নয়, সে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার চোখের ভেতর, তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণে। বাস্তব আর কল্পনা একে অপরের জায়গা বদলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন আয়নায় প্রতিফলন নিজের জায়গা থেকে নড়ে গিয়ে মুখের ওপর উঠে এসেছে। সে বুঝল, তার ভেতরের জানালা এখন ভয়ংকরভাবে খোলা, যেখানে আলো মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে, আর সে নিজেই জানে না, আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।

সেদিন রাত নীরব ছিল, কিন্তু নীলা ঘুমাতে পারছিল না। চায়ের কাপের ধোঁয়া এখনো চোখের সামনে ভেসে আছে। কল্পনার অরুণ তার মনের কোণে বসে আছে। কিন্তু পাশে শুয়ে নীলার স্বামী, নীলার বুকে ধকধক আওয়াজ করতে লাগল। নীলা বুঝল, সে কতটা দূরে চলে গেছে। হাত বাড়িয়ে সে নিজের হাতে হাত রাখল। হঠাৎ ঠান্ডা, বাস্তবের অনুভূতি বুঝিয়ে দিল এই হাতই সত্য। এই স্পর্শই তার। বাকি সবকিছু—অরুণের হাসি, কল্পনার কোলাহল, বাতাসের মৃদু কথোপকথন সব মিথ্যে।

তার মনে ভয় ছিল, অপরাধবোধ ঝরে পড়ছিল। সে তার স্বামীর দিকে তাকাল, সেই বাস্তব মানুষ, যার চোখে উদ্বেগ আর ভালোবাসা মিশে আছে। নীলা বুঝল, কতবার সে অচেনা–অজানা জগতে হারিয়ে গেছে, কতবার স্বামীকে অদৃশ্য করে দিয়েছে নিজের ভেতরের জানালার ভেতর। নীলা উঠে দাঁড়াল, কাঁধ সোজা করল, চুলে সিঁদুর লাগাল ভালো করে। তার সামনে সবকিছু সত্য, স্পর্শযোগ্য। কল্পনার জগৎ থেকে আসা ব্যথা, আনন্দ—সবই এখন শুধুই স্মৃতি। নীলা তার স্বামীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তার চোখে শান্তি, অপেক্ষা আর ভালোবাসা সবকিছু সচল। নীলা বুঝল, ঘাড়ের ওপর গভীর নিশ্বাস, স্পর্শ সবই সত্য। এবার নীলা প্রথমবার পুরোপুরি অনুভব করল, এখানেও প্রেম আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ