Samakal:
2025-06-09@14:25:31 GMT

জামাল ভূঁইয়া: যে জীবন ফুটবলের

Published: 9th, June 2025 GMT

জামাল ভূঁইয়া: যে জীবন ফুটবলের

আচ্ছা জামাল ভূঁইয়াকে নিয়ে কখনো কি কোনো বায়োপিক বানানো হবে? বানানো হলে; কী হতে পারে সেই বায়োপিকের নাম?  “জামাল ভূঁইয়া: যে জীবন ফুটবলের” নামটাই বা কেমন হয়?

অনেকেই বুঝি এতোক্ষণে চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন। ১৮৩ নাম্বার ফিফা র‍্যাংকিংয়ের এক দেশ। যে দেশের অধিনায়কের হাতে নেই কোনো আন্তজার্তিক ট্রফি; তাকে নিয়েই আবার হবে কি না বায়োপিক! 

বাংলাদেশের ফুটবল র‍্যাংকিং, শিরোপা কিংবা ব্যক্তিগত অর্জন দিয়ে আপনি একজন জামাল ভূঁইয়াকে মাপতে পারবেন না। জামাল ভূঁইয়ার গল্পটা জানতে হলে ফিরতে হবে অনেক পিছনে। উঁকি দিতে হবে থ্রিলার উপন্যাসের মতো রীতিমতো রোমাঞ্চে ঠাসা জামাল ভূঁইয়ার জীবনের গল্পে। যে গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে গভীর এক জীবনবোধ আর নিদারুণ দায়িত্ববোধের গল্প। 

জামালের বাবা-মা ষাটের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে বসবাস শুরু করেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। ১৯৯০ সালের ১০ এপ্রিল ডেনমার্কে জন্ম নিলেন জামাল ভূঁইয়া। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে হবে চিকিৎসক। আর মায়ের পছন্দ আইনপেশা। কিন্তু জামালের ধ্যানজ্ঞান ফুটবলকে ঘিরেই। শুনলেন নিজের মনের কথা। হলেন প্রফেশনাল ফুটবলার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে যোগ দিলেন এফসি কোপেনহেগেনের বয়সভিত্তিক দলে। হ্যাঁ, সেই এফসি কোপেনহেগেন- যাদের আমরা নিয়মিত চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ইউরোপা লিগে খেলতে দেখি। 

এফসি কোপেনহেগেনের সেই বয়সভিত্তিক দলের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন জামাল ভূঁইয়া। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে কোপেনহেগেনের সিনিয়র দলে ভেড়াতে আলোচনা চলছিলো। এমনকি ডেনমার্ক জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ মিডফিল্ডার হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছিলেন জামাল ভূঁইয়া। কিন্তু তখনই ঘটে যায় জামাল ভূঁইয়ার জীবনের বাঁক বদলে সেই ঘটনা।

২০০৭ সাল। জামাল ভূঁইয়ার বয়স তখন ১৭ বছর। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোপেনহেগেনের রাস্তায় দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে জামাল। চোখের নিমিষেই শরীরে এসে বিঁধে পরপর চারটি বুলেট। একটা লাগল কনুইয়ে, একটা পেটের নিচের দিকে, দুই শরীরের দুই পাশে। দ্রুত নেয়া হলো হাসপাতালে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সঙ্গাহীন অবস্থায় জামাল ভূঁইয়া তখন কোমায়। কোমা থেকে ফিরলেন দুই দিন পর। চার মাস কাটলো হাসপাতালে। সাত মাস পর ফিরলেন ফুটবলে। কিন্তু কোমা পরবর্তী আরও অনেক জটিলতা— জামালের ফুটবল ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেই জামালের কয়েক মাস পর এফসি কোপেনহেগেনের মূল দলে অভিষেক হওয়ার কথা, সে কি না ফুটবলটাই ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিলেন। সেই সময়টার কথা মনে করে এক সাক্ষাৎকারে জামাল ভূঁইয়া বলেন, “ভেবেছিলাম ফুটবল ছেড়ে দিব। ডেনমার্কের ফুটবল খুব উঁচু পর্যায়ের। মনে হয়েছিল আমাকে দিয়ে আর হবে না, ভেবেছিলাম লেখাপড়াটা ভালোভাবে চালাব। বিষয়টি নিয়ে আমার যুব দলের কোচ জনি লারসনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি পরামর্শ দিলেন চেষ্টা (ফুটবল) করার।”

জীবন নিয়ে ভাবতে বসলেন জামাল। জামালের বাবা সবসময় চাইতেন ছেলে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলুক। জামালও ভাবলেন সৃষ্টিকর্তা যখন তাকে কোমা থেকে ফিরিয়ে এনেছে নিশ্চয়ই তারও কোনো পরিকল্পনা আছে। ডেনমার্কে খেলার আশা ছেড়ে, জামাল সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ ফুটবল দলে পাড়ি জমানোর। ২০১১ সালে এলেন বাংলাদেশে ট্রায়াল দিতে। তখনও এদেশের ফুটবলে প্রবাসী ফুটবলার কেন্দ্রিক হাইপ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের প্রবাসী বাবা-মার সন্তান ইউরোপ ছেড়ে এখানে খেলতে এসেছেন, খবরের রসদ ছিল এইটুকুতেই। কিন্তু ডেনমার্কের ঠাণ্ডা-শীতল আবহাওয়া থেকে বাংলাদেশের এই তপ্ত গরম আবহাওয়ার মানিয়ে নেয়া ছিলো যারপরনাই কঠিন। দেশের কন্ডিশন ও ফুটবল মাঠের সঙ্গে কোনোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না জামাল। ভুগছিলেন পানিশূন্যতায়। ট্রায়াল ম্যাচে মাঠেই বার কয়েক বমি করলেন। হলেন সতীর্থ, স্থানীয় কোচ এবং গণমাধ্যমের হাসির খোরাক। অভিমান করে জামাল ফেরত গেলেন ডেনমার্কে।

কিন্তু অই যে, জামাল ভূঁইয়াকে সৃষ্টিকর্তার যে ভিন্ন এক পরিকল্পনা ছিলো। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ ফুটবল দলের তৎকালীন ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ পুনরায় জামালকে ঢাকায় ডেকে পাঠালেন। পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জামালও এবারও তৈরি। আরাধ্য বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তোলার ইচ্ছেটা পূরণ হলো অবশেষে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে প্রথম প্রবাসী ফুটবলার হিসেবে অভিষেক হলো জামাল ভূঁইয়ার। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ এক যুগ। ১২ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৮৮টি আন্তজার্তিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড জামাল ভূঁইয়ার দখলে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন্সির আর্মব্যান্ডটাও তার হাতেই।
 

অথচ এই পথচলা কতটাই না কঠিন ছিল! বাংলাদেশের গরম আর ঢাকার দূষণের সঙ্গে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে জামালকে। অনেক কষ্টে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। এখানকার মসলাদার খাবার খেতে পারতেন না। এ দেশের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে লেপটে থাকা ‘ভাত’ও খেতে পারেন না অনভ্যস্ততার কারণে। অথচ কখনোই কিছু নিয়ে অভিযোগ বা অনুযোগ করেননি। হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন সব। দলের প্রয়োজনে, খেলোয়াড় সমর্থকদের সাথে যোগাযোগের খাতিরে শিখেছেন বাংলা। ২০১৮ সাল থেকে একটু একটু করে গুছিয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল দলটাকে। ২০১৩ সালের জামাল ভূঁইয়ার দেখানো পথ ধরে আজ বাংলাদেশ দলে এসেছেন — ফিনল্যান্ড প্রবাসী তারিক কাজী, কানাডা প্রবাসী কাজেম শাহ ও সামিত সোম, ইংল্যান্ড থেকে হামজা চৌধুরী। দরজায় কড়া নাড়ছেন আরেক তরুণ তুর্কি কিউবা মিচেল।

নিজ চোখে জামাল দেশের ফুটবলের মুদ্রার দুটো পিঠই দেখে ফেললেন। যখন এসেছিলেন তখন দেশের ফুটবলে বলতে গেলে ছিলো না কিছুই। প্র্যাকটিস কিট বলতে কিছু ছিলো না। ছিলো চরম আবাসন সংকট। পর্যাপ্ত ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ ছিলো না। ছিলো শুধুই চারদিকে নেই নেই আর নেই-এর হাহাকার। এরপরেও জামাল হাল ছাড়েননি। লেগে ছিলেন। হামজা চৌধুরী আসায় বাংলাদেশের ফুটবল নিঃসন্দেহে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। মানুষের আগ্রহ বেড়েছে ফুটবলে।

সিঙ্গাপুর ম্যাচের আগে দেশের ফুটবল দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন যুগসন্ধিক্ষণে। হামজা-সামিতদের ঘিরে বাড়ছে ফুটবল উন্মাদনা। স্টেডিয়ামমুখী হচ্ছে মানুষ। ফিরতে শুরু করেছে বাংলাদেশের হারানো ফুটবল জোয়ারও। আর এই সবের পিছনে আড়ালে থাকা মানুষটাই হলেন জামাল ভূঁইয়া। ভীষণ ঠাণ্ডা স্বভাবের প্রচারবিমুখ এই মানুষটি বাংলাদেশের ফুটবলে হাজির হয়েছিলেন ঘোর অমানিশায়। আলোকবর্তিকা হয়ে দেশের অন্ধকার ফুটবলে আলো ফিরিয়েছেন জামাল।

মেঘে-মেঘে বেলা গড়িয়েছে বেশ। ২৩ বছর বয়সে বাংলাদেশ ফুটবলে অভিষেক হওয়া জামাল ভূঁইয়ার বয়স এখন ৩৫। স্বভাবতই পুরো ৯০ মিনিট খেলার মতো শারীরিক সামর্থ্য এখন আর নেই। গত এক-দেড় বছর ধরে নিয়মিত বদলি হিসেবেই খেলে যাচ্ছেন। হামজা, সামিত, কাজেম শাহদের আবির্ভাবে জামাল তার প্রিয় পজিশন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের জায়গাটাও হারিয়েছেন। কোচের পছন্দে এখন জামালকে দেখা যায় বেশিরভাগ সময়ই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেই। আর এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে তো জায়গা মেলেনি একাদশেও। সিঙ্গাপুর ম্যাচে কোচ হ্যাভিয়ের কাবরেরার একাদশে জামাল জায়গা পাবেন কি না, তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। এসব নিয়েও জামালের কখনোই কোনো অভিযোগ নেই। দলের প্রয়োজনে যতোটুকু সময়ের জন্য যতোক্ষণই জামালকে মাঠে দেখা যাক না কেন, জামাল নিজেকে পুরোটা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত সবসময়ই। 

বাংলাদেশের ফুটবল দাঁড়িয়ে আছে এক বাঁক বদলের মুখে। হামজা-সামিত-কিউবাদের হাত ধরে দেশের ফুটবল বদলে যাবে। হয়তো এশিয়া থেকে বাংলাদেশও এক সময় বিশ্বকাপে জায়গা করে নিবে। সে সময়টায় দর্শক সারিতে বসে জামাল ভূঁইয়া ভীষণ গর্ব নিয়ে সবটা উপভোগ করবে। আর আমরা স্মরণ করবো আমাদের একজন ক্যাপ্টেন ছিলো। আমাদের একজন জামাল ভূঁইয়া ছিলো। যে কি না কোমা থেকে ফিরে এসে নিজে পুনর্জীবন পেয়েছে। সেই সাথে পুনর্জীবন দিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফ টবল ল দ শ র ফ টবল ল দ শ ফ টবল ফ টবল দল ফ টবল দ ফ টবল র ন ফ টবল প রব স জ ম লক র জ বন র বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

দেখে নিন রোনালদোর ট্রফি কেবিনেটে চ্যাম্পিয়নস লিগ-ইউরোসহ আরও যা আছে

২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চোখের জলে বিদায়ের পর অনেকেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শেষ ধরে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, জাতীয় দলের হয়ে রোনালদোর যাত্রাটা বোধ হয় অতটুকুই। কিন্তু গতানুগতিক ধারণার বিপরীতে দাঁড়াবেন বলেই তো তিনি রোনালদো।

ফলে বিদায় বলার পরিবর্তে রোনালদো আবার ফিরলেন পর্তুগালের জার্সিতে। শুধু ফিরলেনই না, পর্তুগালের হয়ে জিতলেন নিজের তৃতীয় আন্তর্জাতিক ট্রফিও। গতকাল রাতে স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে জেতা নেশনস লিগের ট্রফিটা আবার রোনালদোর ক্যারিয়ারের ৩৫তম ট্রফিও বটে।

পর্তুগালের হয়ে নেশনস লিগ জয়ের পথে এবারের আসরে ৯ ম্যাচে ৮ গোল করেছেন রোনালদো। প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল পেয়েছেন তিনি। নেশনস লিগ জয়ের পর রোনালদোর চোখ এখন ২০২৬ বিশ্বকাপের দিকে। এক বছর পর শুরু হতে যাওয়া এই টুর্নামেন্টেও জাতীয় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চান ‘সিআর সেভেন’। যেখানে তিনি দেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটিও উঁচিয়ে ধরতে চান।

বিশ্বকাপ অধরা থাকলেও ক্যারিয়ারে এরই মধ্যে অবশ্য ৩৫টি ট্রফি জিতেছেন রোনালদো। পর্তুগিজ মহাতারকার ট্রফি কেবিনেটে জাতীয় দলের হয়ে ইউরো ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ অসংখ্য নামীদামি ট্রফি রয়েছে। সেই ট্রফিগুলো একনজরে দেখে নেওয়া যাক।

পর্তুগাল—৩টি

নেশনস লিগ (২)—২০১৮-২০১৯, ২০২৪-২০২৫

ইউরো (১)—২০১৬

রিয়াল মাদ্রিদ—১৬টি

চ্যাম্পিয়নস লিগ (৪)—২০১৩-১৪, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭,২০১৭-১৮

ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ (৩)—২০১৪, ২০১৬, ২০১৭

উয়েফা সুপার কাপ (৩)—২০১৪, ২০১৬, ২০১৭

লা লিগা (২)—২০১১-১২, ২০১৬-১৭

কোপা দেল রে (২)—২০১০-১১, ২০১৩-১৪

স্প্যানিশ সুপার কাপ (২)—২০১২, ২০১৭

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড—৯টি

প্রিমিয়ার লিগ (৩)—২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯

লিগ কাপ (২)—২০০৫-০৬, ২০০৮-০৯

চ্যাম্পিয়নস লিগ (১)—২০০৭-০৮

এফএ কাপ (১)—২০০৩-০৪

ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ (১)—২০০৮

কমিউনিটি শিল্ড (১)—২০০৭

জুভেন্টাস—৫টি

সিরি ‘আ’ (২)—২০১৮-১৯, ২০১৯-২০

ইতালিয়ান সুপার কাপ (২)—২০১৮, ২০২০

ইতালিয়ান কাপ (১)—২০২০-২১

স্পোর্টিং লিসবন—১টি

পর্তুগিজ সুপার কাপ (১)—২০০২

আল নাসর—১টি

আরব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপ (১)—২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেখে নিন রোনালদোর ট্রফি কেবিনেটে চ্যাম্পিয়নস লিগ-ইউরোসহ আরও যা আছে
  • দেশে ফিরেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ