গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি থাকে, বাইরের পরিবেশও থাকে উত্তপ্ত। যা আমাদের ত্বককে প্রভাবিত করে। ত্বকে অবস্থিত ঘামগ্রন্থিগুলোর নিঃসরণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত গরম ও ঘামের কারণে ত্বকে চুলকানিসহ ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। এর বাইরে গ্রীষ্মকালের প্রখর রোদ ত্বকে নতুন রোগ তৈরি করার পাশাপাশি বিদ্যমান রোগগুলোকেও অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলে।

১.

অতিরিক্ত ঘাম

আমাদের শরীরে অনেক ঘর্মগ্রন্থি ও তৈলগ্রন্থি থাকে। অতিরিক্ত গরমের কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ঘাম হয়। মুখমণ্ডল, বগল, হাত ও পায়ে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়।

২. ঘামে দুর্গন্ধ

মানুষের ত্বকে ঘর্মগ্রন্থি ও তৈলগ্রন্থি থেকে তৈরি হওয়া ঘাম ও তেলের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া মিলে ঘামে দুর্গন্ধ তৈরি করে। সাধারণত বগলে ও কোমর থেকে রানের ভাঁজ পর্যন্ত আবৃত অংশের ঘামে এ দুর্গন্ধ বেশি তৈরি হয়। কারণ, এসব এলাকার ত্বকে জীবাণু বেশি থাকে।

৩. ঘামাচি

গরমকালে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে কখনো কখনো ঘর্মগ্রন্থিনালির মুখ আটকে যায়। তখন লাল লাল ফুসকুড়ির মতো দানা সারা শরীরে দৃশ্যমান হয়। সাধারণত মুখমণ্ডলসহ শরীরের সব জায়গাতেই ঘামাচি দেখা যায়। দৃশ্যমান লাল দানাগুলো কাঁটা ফোটানোর মতো চুলকায়। তাই একে ‘প্রিকলি হিট র‍৵াশ’ বলা হয়।

৪. ত্বকে ছত্রাকের সংক্রমণ

মানুষের ত্বকে পরজীবী হিসেবে স্বাভাবিকভাবে কিছু ছত্রাক বসবাস করে। অধিকাংশ সময়ে এরা মানুষের ক্ষতি করে না, কিন্তু অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, আর্দ্রতার কারণে এসব ছত্রাক অতিমাত্রায় বংশবিস্তার করে ত্বকের ক্ষতি করে। আমাদের দেশে এ সমস্যাগুলো ছুলি বা দাদ হিসেবেই পরিচিত। শরীরের যেসব অংশে ঘাম জমে থাকে সেখানে দাদ বেশি দেখা যায়। যেমন কোমর, বগল, পায়ের ভাঁজে, বুকের ভাঁজে, গলা, মুখমণ্ডল এবং শিশুদের ক্ষেত্রে মাথায়। দাদ প্রচণ্ড চুলকায়। এটি লাল বা বাদামি বর্ণ ধারণ করে পয়সার মতো গোলাকৃতি হয়। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে এই ছত্রাক পরিবারের অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হয়।

৫. ত্বকে ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ

ত্বকের এ রোগ সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে বড়দেরও হতে পারে। শিশুদের নাক ও মুখের চারপাশে লাল ছোট পানি ফুসকুড়ি দেখা যায়। পরবর্তীকালে ফুসকুড়িগুলো ফেটে স্যাঁতসেঁতে ঘা তৈরি হয়। অনেকটা সোনালি-বাদামি অথবা মধুর মতো রং হয়। ক্ষতস্থানটি চুলকানোর ফলে ফুসকুড়িগুলো শরীরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংক্রমিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘাগুলোতে ব্যথা অনুভূত হয়।

৬. ফলিকুলাইটিস

অতিরিক্ত গরমে আমাদের লোমকূপ ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হলে এ রোগের উদ্ভব হয়। এটি প্রচণ্ড চুলকায় ও লোমকূপের গোড়ায় লাল লাল দানা হয়ে সেখানে পুঁজ হয়।

৭. খোসপাঁচড়া

গরম ও শীতকাল উভয় সময়ই আমাদের দেশে খোসপাঁচড়া হতে দেখা যায়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। তাই চিকিৎসা না নিলে শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে খুব দ্রুত ছড়ায়। পোশাক, ব্যবহার্য বস্তু ও বিছানাপত্রের মাধ্যমেও এ রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। ত্বকে প্রচণ্ড চুলকানিযুক্ত ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দেয়। সাধারণত আঙুলের মধ্যে, বগলে, কনুইয়ের ভাঁজে, কোমরের চারপাশে, কবজি, স্তনের চারপাশে, পুরুষের যৌনাঙ্গের চারপাশে, হাঁটুর ভাঁজে এ জীবাণুর আক্রমণ বেশি দেখা যায়। সারা দিন চুলকানি থাকলেও রাতে এর আধিক্য বাড়ে। স্ক্যাবিসে সৃষ্ট চুলকানি প্রথমে আরামদায়ক মনে হলেও ধীরে ধীরে তা জটিল আকার ধারণ করে। দ্রুত চিকিৎসা না করলে ক্ষতস্থানে আবার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘায়ের সৃষ্টি হয় এবং জ্বর চলে আসে।

আরও পড়ুনভাতের মাড় ত্বক ও চুলের জন্য এত উপকারী, জানতেন? ১৫ মে ২০২৫

৮. সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ত্বকের সমস্যা

রোদে পোড়া ত্বক: এ ক্ষেত্রে চামড়ার রং লাল, বাদামি বা তামাটে হয়ে যায়। শরীরের যে অংশগুলো সূর্যরশ্মির সংস্পর্শে আসে সেখানে জ্বালাপোড়া, চুলকানি বা ব্যথা হতে পারে। কিছুদিন পর ওই স্থানগুলো থেকে মরা চামড়া উঠতে থাকে।

সূর্য রশ্মির প্রতি ত্বকের সংবেদনশীলতা: সাধারণত ত্বকের যে অংশগুলো সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসে, যেমন মুখ, হাতের বাইরের অংশ, গলা ও বুকের ‘ভি’ অংশ, পায়ের অনাবৃত অংশে লাল, উঁচু ও খসখসে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ফুসকুড়িগুলো চুলকায় এবং ফুলে যায়। কখনো কখনো ফোসকা পড়তে পারে। সূর্যরশ্মির সংস্পর্শে আসার কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়।

মেছতা: আমাদের দেশে ৪০ বছর বয়সের পর ৯৫ শতাংশ মানুষের মুখমণ্ডলে মেছতার কালো বা বাদামি দাগ পরিলক্ষিত হয়। মুখমণ্ডলের গাল, নাক, কপাল ও থুতনিতে মেছতা বেশি দেখা যায়। এটা প্রধানত বংশানুক্রমিক হলেও সূর্যের আলোর প্রতিক্রিয়া মেছতাকে ত্বরান্বিত করে।

ত্বকের ক্যানসার: ত্বকের কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিকে ত্বকের ক্যানসার বলা হয়। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণের সঙ্গে ত্বকের দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শ ত্বক ক্যানসারের কারণ।

৯. ত্বকে বিদ্যমান যেসব রোগ গরমের সময় বাড়ে

ব্রণ: গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার ফলে ত্বকের ব্যাকটেরিয়া ও তেলের সঙ্গে ঘাম মিশে লোমকূপগুলো বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্রণ দেখা দেয়। সাধারণত মুখ, গলা, পিঠ ও বুকে এই ব্রেকআউট হতে পারে।

রোসেশিয়া: এটি দীর্ঘমেয়াদি ত্বকের রোগ। মুখের ত্বকে লালচে ভাব, ছোট ছোট ফুসকুড়ি বা রক্তনালির প্রসারণ ঘটে। গরমে এটি বৃদ্ধি পায়।

একজিমা: একজিমা ত্বকের প্রদাহজনিত অবস্থা। এখানে ত্বক শুষ্ক থাকে, ফলে চুলকায় এবং লাল ফুসকুড়ির মতো দানা বা র৵াশ দেখা যায়। যেকোনো বয়সে এ সমস্যা হয়ে থাকে। একজিমায় আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হাঁপানি বা এলার্জিজনিত সমস্যা থাকে। শুষ্ক ত্বক ও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা অস্বাভাবিক থাকায় অত্যধিক গরমে ত্বকে একজিমা রোগ বেড়ে যায়।

ত্বকে খুশকিজনিত প্রদাহ: মাথার ত্বক, দাড়ি, ভ্রু, পুরুষের বুক-পিঠ এমনকি চোখের পাপড়িতে খুশকিজনিত প্রদাহের ফলে চুলকানিসহ ফুসকুড়ি হতে পারে। তৈলাক্ত ত্বকে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। গরমে ঘাম ও তেলগ্রন্থির নিঃসরণ বেশি হয় বলে সমস্যাটির প্রকোপ বাড়ে।

লুপাস: লুপাস একটি বংশানুক্রমিক অটো ইমিউন রোগ। এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন কিডনি, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে ত্বককেও আক্রান্ত করে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এটি বেশি হয়। মুখমণ্ডলের কপাল, নাক এবং দুই পাশের গালে প্রজাপতি আকৃতির লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়। রোদে গেলে মুখে জ্বালাপোড়া হয়। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি এ রোগকে আরও বেশি প্রভাবিত করে।

আরও পড়ুনগরমেও ত্বক যেভাবে ঠান্ডা রাখবেন০৭ মে ২০২৫গরমে ত্বক সুস্থ রাখতে করণীয়

নিয়মিত ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।

অতিরিক্ত গরম স্থান এড়িয়ে চলুন।

অতিরিক্ত ঘাম হলে হাতের নিচে, পায়ের তলায় পাউডার ও অ্যান্টি–পারসপিরেন্ট ব্যবহার করুন।

ঘামে ভেজা কাপড় দ্রুত পরিবর্তন করুন।

শরীরের জন্য আরামদায়ক ঢিলেঢালা সুতি কাপড় পরুন।

সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাইরে রোদে অবস্থান করলে নিয়মিত সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করুন।

সুরক্ষামূলক পোশাক পরুন (ফুল হাতা জামা, ফুল প্যান্ট, মাথায় চওড়া হ্যাট)।

প্রখর রোদে ছায়াযুক্ত স্থানে অবস্থান করুন।

বাইরে থাকাকালীন ছাতা ব্যবহার করুন।

রোদচশমা ব্যবহার করুন।

ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে করণীয়

অন্যের ব্যবহৃত কাপড় পরা থেকে বিরত থাকুন।

নিয়মিত সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে শরীর পরিষ্কার করুন।

দিনে দু-তিনবার কাপড় পরিবর্তন করুন।

চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

চর্মরোগে মৃত্যুঝুঁকি কম থাকায় দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রতিকারের জন্য ওষুধের দোকানদার, ভুয়া চিকিৎসক, কবিরাজের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের মলম িকনে ব্যবহার করেন অথবা ওষুধ সেবন করেন। এত ত্বকের সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হয়।

তাই দ্রুত চিকিৎসার স্বার্থে ভুল চিকিৎসা থেকে বিরত থাকুন। ত্বকের দীর্ঘমেয়াদি রোগ গরমে বৃদ্ধি পেলে চর্মরোগবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।

ডা. লায়লা আফরোজ, কনসালট্যান্ট, লেজার অ্যাসথেটিকস (প্রা.) লিমিটেড, ঢাকা।

আরও পড়ুনশরীর ঠান্ডা রাখা, ত্বক উজ্জ্বল করাসহ আরও যেসব উপকার পাবেন কাঁচা আম খেলে২৪ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন ত বক র ক স স পর শ স ধ রণত ন কর ন র ত বক চ লক ন চ লক য় আম দ র সমস য একজ ম অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ