ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ধ্বংস করার প্রাথমিক লক্ষ্যের বাইরেও এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ইরানের জনগণকে তাদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নেতানিয়াহুর লক্ষ্যের সমর্থনে সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করছেন।
 
যদি যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপায়ে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য এটিই প্রথম চেষ্টা হবে না। ২০০৩ সালে দেশটি ইরাক আক্রমণ এবং ২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটো অভিযানে সমর্থন দিয়ে সাদ্দাম হোসেন ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটায়। এ হস্তক্ষেপ উভয় দেশ এবং বৃহত্তর অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল। যদি সরকার উৎখাত হয়, তবে ইরানেও কি একই ঘটনা ঘটতে পারে? 

শাহের উৎখাত 
১৯৭৮-৭৯ সালের অভ্যুত্থানে ইরানের ইসলামী শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওই অভ্যুত্থানে মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির পশ্চিমাপন্থি রাজতন্ত্র উৎখাত হয়। এর আগ পর্যন্ত ইরানে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো রাজতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাস ছিল। শেষ শাহ মোহাম্মদ রেজা ছিলেন পাহলভি রাজবংশের প্রধান, যা ১৯২৫ সালে ক্ষমতায় আসে। 
১৯৫৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সংস্কারবাদী প্ররোচনায় শাহকে নির্বাসনে বাধ্য করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে শিগগিরই সিংহাসনে ফিরিয়ে আনে। সব জাতীয়তাবাদী, পশ্চিমাপন্থি ও আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শাহ তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারেননি। 

২৫ বছর পর তাঁর বিরুদ্ধে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল গণতন্ত্রপন্থি উপাদানগুলো। শাহের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শিয়া ধর্মীয় নেতাদের দল বিপ্লবের নেতৃত্ব পর্যায়ে সবচেয়ে সুসংগঠিত ছিল। খোমেনি ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে (প্রথমে ইরাকে এবং পরে ফ্রান্সে) নির্বাসনে ছিলেন। তবুও তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রশাসন বুঝতে পারে, তারা আর শাহকে সমর্থন করতে পারবে না, তখন তিনি দেশত্যাগ করেন এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে নির্বাসনে চলে যান। ফলে খোমেনি ইরানে ফিরে আসেন এবং বিপুল জনস্রোত তাঁকে স্বাগত জানায়। 

ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্ম
অভ্যুত্থানের পর খোমেনি এবং তাঁর সমর্থকরা রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন এবং ইরানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেন। সরকারে তীব্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ছিল। খোমেনি কেবল ইরানকেই পরিবর্তন করেননি, বরং আঞ্চলিক শৃঙ্খলা গঠনে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এতে তেলসমৃদ্ধ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা তার প্রভাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হারিয়ে ফেলে। এরপর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আমেরিকান বা ইসরায়েলি পদক্ষেপের আশঙ্কা ইরানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। 

নতুন সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা গ্রহণ 
১৯৮৯ সালে খোমেনি মারা যান। তাঁর উত্তরসূরি আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি একই লড়াইকারী ও বাস্তববাদী পদ্ধতিতে ইরান শাসন করেছেন। খামেনি স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা এবং রাশিয়া ও চীন বলয়ের দিকে ঝুঁকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের মোকাবিলা করার জন্য শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেন। শাসন ব্যবস্থার টিকে থাকা এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে তিনি নমনীয়তাও দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে খামেনির বিশাল সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব রয়েছে। 

তিনি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস এবং এর আধা সামরিক শাখা ও শিয়া ধর্মীয় নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই অনুমেয় যে, খামেনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহজে আত্মসমর্পণ করবেন না। 

তবে, সম্মিলিত অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বহিরাগত চাপের ভারে শাসন ব্যবস্থার পতন হলে বিকল্প কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইরান ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার বিস্তারের পরিবর্তে কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একত্রিত হয়েছে। যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তাহলে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার মসৃণ হস্তান্তর আশা করা ভুল হবে। 

তাছাড়া ইরানি জনগণ অত্যন্ত সংস্কৃতিবান এবং সৃজনশীল। তাদের অর্জন ও সভ্যতার একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব ভাগ্য নির্ধারণে পুরোপুরি সক্ষম, যতক্ষণ না এই প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী বিদেশি হস্তক্ষেপ না থাকে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র ক ষমত ইসল ম ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

যানজটমুক্ত ঢাকার স্বপ্ন: জুলাই থেকে নামছে ইলেকট্রিক বাস

রাজধানী ঢাকার সড়কে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা, বাসের জন্য যাত্রীদের দুর্ভোগ যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা, অসৌজন্যমূলক আচরণ ও নিরাপত্তার সংকট সব মিলিয়ে  যাত্রীদের ভোগান্তি আর ভোগান্তি। এই বাস্তবতা উত্তরণ হতে যাচ্ছে। আগামী ১ জুলাই থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে নতুন রুট-ভিত্তিক গণপরিবহন প্রকল্প, যার লক্ষ্য শহরের যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যাত্রীসেবাকে মানবিক ও যুগোপযোগী করা।

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) । সমন্বিত এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুই সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন সংগঠনগুলো।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমাদের শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত। এই সমস্যা শুধু অবকাঠামো দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়; দরকার শৃঙ্খলা, সমন্বয় ও যাত্রীকেন্দ্রিক পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি। ১ জুলাই থেকে যে প্রকল্প চালু হচ্ছে, তা পরীক্ষামূলক নয়; এর মাধ্যমে শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।”

আরো পড়ুন:

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক ছাত্রদল নেতা নিহত

ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত

উপদেষ্টা বলেন, “এই উদ্যোগে শুধু ইলেকট্রিক বাস নামানোই নয়, শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে সময়নিষ্ঠ, নিরাপদ ও মানবিক করা হচ্ছে। সড়কে সুশৃঙ্খল চলাচলের জন্যই রুট-ভিত্তিক মডেল এবং মালিকদের সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।”

তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় থাকবে নির্দিষ্ট রুট-ভিত্তিক বাস, বাস থামার নির্দিষ্ট স্টপেজ, একক ডিজিটাল টিকিটিং ব্যবস্থা, বাস মালিকদের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষিত চালক ও সহকারী, বাসে সিসি ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিং, নারী-শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীদের জন্য নিরাপদ সেবা। শুরুতে ঢাকা শহরের চারটি নির্দিষ্ট রুটে এই ব্যবস্থা চালু হবে। পরবর্তী ধাপে বর্ধিত রুট অন্তর্ভুক্ত করে পুরো ঢাকা শহরে তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “এত দিন আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক। এতে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এই রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল বাস্তবায়ন হলে পরিবহন ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ফিরবে এবং নাগরিক ভোগান্তি অনেকটাই কমবে।”

তবে এই প্রকল্প নিয়ে কিছু শঙ্কাও রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, মালিকদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এবং টিকিট রাজস্ব বণ্টনের মতো ইস্যুগুলো সমাধান না হলে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির  সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বিপুল বলেন, “সরকারের পরিকল্পনা ভালো কিন্তু চালক-হেলপারদের মানবিক দিকটা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক বেতন, নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া এই উদ্যোগ স্থায়ী হবে না।”

যাত্রীরাও চাইছেন এই উদ্যোগ যেন আরেকটি অসম্পূর্ণ প্রকল্পে পরিণত না হয়।

মতিঝিলের কর্মজীবী নারী সোনিয়া রহমান বলেন, “বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। যদি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রুটে বাস চলে এবং যাত্রীদের সম্মান দিয়ে সেবা দেওয়া হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বড় পরিবর্তন হবে।”

নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটিতে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রকল্পটি সফল হলে এটি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর জন্য একটি রোল মডেল।

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, “ইলেকট্রিক বাস খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা যেন কয়েক মাস পর বন্ধ না হয়ে যায়। পুরোনো অভিজ্ঞতায় আমাদের অনেক হতাশা জমে আছে।”

তিনি বলেন, “ঢাকায় বহু প্রকল্প এসেছে, কিছু শুরু হয়ে হারিয়ে গেছে, কিছু আর বাস্তবায়নই হয়নি। তবে এই বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন প্রকল্প, সরকারি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয়, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, এবং প্রযুক্তিনির্ভর রূপরেখাসব মিলিয়ে এই উদ্যোগে বাস্তব পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। শহর যেমন তার রাস্তা ও যানবাহনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তেমনি তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের ছাপ পড়ে সেখানেও। ১ জুলাইয়ের নতুন সুচনা হবে এটা প্রত্যাশা।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো পুরোনো ডিজেলচালিত বাস। ইলেকট্রিক বাস চালু হলে শুধু শহরের যান চলাচল নয়, বাতাসও হবে পরিচ্ছন্ন।

পরিবেশ গবেষক ড. ফারজানা কবির বলেন, প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ শ্বাস নেয় কালো ধোঁয়ায়। বিদ্যুৎচালিত বাসে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্য। এটি শুধু শহরের পরিবেশ নয়, নাগরিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালে চারটি রুটে ইলেকট্রিক বাস চালু ও চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ২০২৬ সালে অতিরিক্ত ১০০ বাস সংযোজন করা। ২০২৭ সালে দুটি  চার্জিং ডিপো নির্মাণ  করা। ২০২৮ সালে পুরোনো ডিজেলচালিত বাস অপসারণ শুরু করা। ২০২৯ ডিজিটাল টিকিটিং ও লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। ২০৩০ সালে ৪০০ বাস ও তিনটি ডিপোসহ সব কাজ সম্পন্ন করা। এটি বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক দেবে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ৩৭৫ কোটি টাকা।

ঢাকা/এনএফ/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ