৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হলো কেন
Published: 20th, June 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ হু হু করে বেড়ে গেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেও খেলাপি ঋণ বাড়ত। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে তখন নানা কৌশল বেছে নেওয়া হতো। প্রতিটি নির্বাচনের আগে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশীয় বা বৈশ্বিক যেকোনো সংকট হলেই ছিল বিশেষ ব্যবস্থা—নির্দিষ্ট সময়ের ঋণ পরিশোধ করা না হলেও খেলাপি করা হতো না। এরপরও আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে খেলাপি ঋণ বেশ বেড়েছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের আগে জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ফলে নতুন সরকার গঠনের পর ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আগে খেলাপি ঋণ মন্থর গতিতে বাড়লেও এখন কেন ক্ষিপ্র গতিতে বাড়ছে।
কোনো ঋণ সময়মতো পরিশোধ করা না হলে খেলাপি হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো আমানতকারীর অর্থই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। বিতরণ করা ঋণ সময়মতো ফেরত না পেলে আমানতকারীরা টাকা তুলতে সমস্যায় পড়েন। এখন যে কটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়েছে, সেসব ব্যাংকের ঋণ আদায় হচ্ছে না।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মোটাদাগে কয়েকটি। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার যেসব খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, অর্থাৎ ঋণ খেলাপি হলেও প্রদর্শন করা হয়নি, তা প্রকাশ্যে আসছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে, এতেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা অবস্থা চলছে, সে কারণেও অনেকে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণীকরণ বা খেলাপি করার নতুন নীতিমালার প্রভাবও পড়েছে।
নতুন নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাংকঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক রীতি চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করা না হলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে। তবে এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে গত এপ্রিল মাস থেকে। এখন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের যে তথ্য বেরিয়েছে, তা মার্চ পর্যন্ত। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়াতে নতুন এই নীতিমালা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। তবে কিছু ব্যাংক আগেভাগেই এই নীতিমালা মেনে ঋণ শ্রেণীকরণ শুরু করেছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে একীভূত হতে যাওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সম্পদের মান নির্ণয় করা হয়েছে। এতেই খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক্সিম ছাড়া বাকি চার ব্যাংক ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা–গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। তারা এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা তুলে নেয়, যা ফেরত দিচ্ছে না। ফলে সেসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে এসব ব্যাংকের আরও ঋণ খেলাপি হয়ে পড়বে। খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউনিয়ন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের অবস্থা ভালো করার জন্য তদারকিতে রাখা হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ব্যবসায়ীদের অনেকের ব্যবসা স্তিমিত হয়ে পড়েছে—এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আগে যেসব ঋণ বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়মিত করা হয়েছিল, তা শোধ না হয়ে আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলো এখন সব ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখানো শুরু করছে। কেউ প্রভাব বিস্তার করে ঋণের মান গোপন রাখতে পারছে না—বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রকৃত চিত্র দেখাতে চাইছে। এতেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
সাবেক ব্যাংকার ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ মনে করেন, যেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তার লাগাম টেনে ধরা জরুরি। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ব্যবসায়ী এখনো দেশে আছেন, তাঁরা কর্মসংস্থান সৃষ্ট করছেন ও অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। সে জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের সহায়তা করা দরকার। ব্যবসা চালু রাখতে প্রয়োজনে আরও সহায়তা দিতে হবে এবং ঋণ নিয়মিত করে দিতে হবে। তাঁদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে ব্যবসা চলমান রাখতে হবে; সেটা হলে আখেরে দেশের উপকার হবে। কারও ব্যবসা বন্ধ করে দেশের উপকার হবে না। বিনিয়োগপ্রবাহ সচল রাখা জরুরি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল গ সরক র র ঋণ খ ল প সব ব য ঋণ ব ড় আওয় ম ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মাপাড়ের আহত জারুল ও পাখিরা
পদ্মাপাড়ের শক্তিশালী বাতাস সঞ্চয় করে ডানা ঝাপটানো পাখিরা হারিয়ে যায় দূরে। হয়তো সে সময়টা খুব ভোরে, যখন পারাবারের ফেরিকর্মী খসরু পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখিদের মতোই টুপ করে বারবার জলে ডুব দিয়ে গোসল করে তার সাবানের ফেনাসমেত শরীরটা নিয়ে। যে সাবানের সাদা ফেনা সরিয়ে ফেললে তার কালো কষ্টিপাথরের মতো শরীরটা বের হয়ে যায়, যার ভেজা চেকপ্রিন্টের লুঙ্গি নিতম্ব ঊরুতে লেপটে থাকলেও তা তার দেখা সিনেমার নায়িকাদের মতো যৌন কামনার বদলে উদ্রেক করে বিরক্তির, গা শিরশির করা ঘৃণার। এ সময় প্রতিদিন ভোরে ছন্দার মাকেও দেখা যায় এক পাশে এসে বাসনকোসন মেজে নিয়ে যেতে। খসরু যতবার ডুব দেয়, ঠিক সেই বরাবর ততবারই ছন্দার মা একদলা থুতু পানিতে ফেলে, যাতে তা খসরুর গোসলকে অসম্পূর্ণই রেখে দেয়। একই সঙ্গেই সাবানের ফেনা মেখে ফরসা হতে বাধা দেয়, নিতম্ব ঊরু সব সময় অবহেলিত হয়েই পড়ে থাকে। কোনো পাখি হয়তো নদীপাড়েরই উঁচু একটা ঢিবির ওপর রাখা বাঁশে গোসল শেষ করে উঠে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশেই কিছু উলঙ্গ শিশুও কাদা নিয়ে খেলা শেষে গোসল করতে ঝুপঝাপ লাপ দেয় পাড়ের অল্প পানিতে। কোনো পাখি হয়তো গভীর রাতে ফেরিঘাটের এই ব্যস্ততা, সারি সারি বাস, ট্রাক আর আলো-অন্ধকার ভেদ করে কালো গভীর পানিতে ছুটে চলা ফেরি চুপচাপ দেখে যায়; যেখানটায় ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’ নামফলক লেখা দেখা যায়, ঠিক সেখানটায় বসে।
ভরদুপুরে এমনই একটা পাখি আহত হয়ে পড়ে থাকে নদীপাড়ের উত্তপ্ত সাদা বালুতে। দলছুট হয়ে উড়তে না পারায় পাখি হতবিহ্বল হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বাকি পাখিরা উড়ে চলে পাল্লা দিয়ে ফেরির সাথে আর নিচে চাকায় ঘুরতে থাকা স্রোতের সাথে। সে সময় হয়তো বগুড়া থেকে বরিশালগামী নবীনবরণ বাসটাও ফেরিতে নদী পার হয়। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে ইসহাক ব্যাপারীকে নামতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে যে কেউ হয়তো বলবে ফেরির এক পাশে যে শৌচাগার আছে, ঠিকঠাক দরজার খিল দেওয়া ছাড়া, ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গন্ধময়, ব্যাপারীর হয়তো সেখানে যাওয়ার জন্যই এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু শৌচাগার ছাড়িয়েও সে সামনে এগোয় আশপাশে না তাকিয়ে। নাহ, শুধু একবার তাকায় যেখানে চানাচুর দিয়ে মসলা, তেল, পেঁয়াজ, ধনেপাতাকুচি মুড়িতে মেশানো হয় এক ইচ্ছাকৃত উচ্চ শব্দে, সর্বনিম্ন দশ টাকার এই মুড়ি মাখার ঘ্রাণ ব্যাপারীকে তাকাতে বাধ্য করে। মুড়িমাখাওয়ালা আর তার চারপাশের ভিড় সব অগ্রাহ্য করে একটা মাইক্রোবাস আর একটা ট্রাকের মাঝখানের অল্প ফাঁকের ভেতর দিয়ে শুকনো শরীরটা ঢুকিয়ে দেয় অল্পতেই পার হওয়ার জন্য। সে সবকিছু ফেলে প্রায় দৌড়ে হাটে। খাড়া লোহার সিঁড়ির হাতল ধরে পৌঁছে যায় তিনতলায়।
খসরু তিনতলায় ব্যস্ত সবাইকে খাবারদাবার ও ভাত দেওয়ায়। তিনতলায় এক পাশে তার চিপস, প্যাকেটের ভাজাপোড়া, চা–কফির দোকান। ফ্রিজটা আপাতত নষ্ট, নাহয় সেখানে আইসক্রিম থাকে। তারই আশপাশে দুটি টেবিল আর কিছু বেঞ্চ পেতে রাখা সবার ভাত খাওয়ার আর বসার জন্য। এক কোণে তার রান্না করার ছোট রুম। এখান থেকে বের হয়েই উঁচু বেঞ্চে সে গামলা ভরে ভাত, মাছ-মাংস, তরকারি, ডাল রাখে। সে একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে না পারায় এখান থেকে সবাই যে যার মতো নিয়ে খায়। মাঝেমধ্যে খসরু এসে তদারকি করে, কেউ তাকে ওতে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বিশেষত যেসব বাস–ট্রাকের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা নিয়মিত আসে। তার আজকের মেন্যু লালশাকভাজি, বেগুনভাজি, নদীর মাছ ভুনা আর পাতলা ডাল। ডাল সবার জন্য ফ্রি। শাপলা বাসের ড্রাইভার লালশাকের গামলা থেকে অর্ধেক শাক একাই খেয়ে ফেলে, আবার যাওয়ার সময় টাকা না দিয়েই মুহূর্তেই তিনতলা থেকে উধাও হয়ে যায়। খসরুর এখন সময় নেই তার পিছু নেওয়ার কিন্তু সে ধরবেই, এমনই সিদ্ধান্ত তার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে সে বাকিদের ডিমভাজি আর ডাল দেয়। এমন সময়-ই ব্যাপারী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ব্যাপারীকে খুব তাড়াহুড়ো করে বলতে শোনা যায়—“তত্তোরি দ্যাওসেন, দেরি হইয়্যা যাইতাসে তো।’ অল্পক্ষণ পরে মেলামাইনের জোড়া প্লেটের ওপর ভাত, ডাল, ডিমভাজি আর পাতলা শরীরটা নিয়ে ছুটতে দেখা যায় নিচে, বাসের ভেতরে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে সে ওপরে না খেয়ে এত ছোটাছুটির কারণ কী? কারণ সেখানে তার ছেলে আবদুর রহমান আর স্ত্রী অপেক্ষায়। ছেলেকে খাইয়ে সে আবার ছুটে চলে ফেরির তিনতলায় প্লেট-গ্লাস ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে একটা গ্লাসও চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে খসরুর কাছ থেকে; কারণ আবদুর রহমান গ্লাস ছাড়া শুধু বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে পারে না।
২.নদীর পাড়ে আহত পাখিটা সূর্যের উত্তাপে গরম হওয়া বালুতে ফুটতে থাকে। মনে হয় কে যেন শরীর থেকে একটা একটা করে নরম পালক টেনে খুলে ফেলছে। বিস্ফারিত কমলা কালো চোখের মণি নিয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকায়, সেখানের সূর্যের আলো তার চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করে। সূর্য আর তার মাঝখানে রংধনুর মতো একটা রাস্তা দেখা যায়। সব শক্তি সঞ্চয় করে সে ওড়ে। হায়, এক হাত সামনে যেতেই সে আবার বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসহাক ব্যাপারী এবার তিনতলা থেকে দ্রুত নেমে আসে দোতলায় নামাজ পড়ার জায়গায়। নামাজের ভেতর কণ্ঠনালি, জিহ্বায় জোর দিয়ে পড়া ‘ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন’ মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় নদীপাড়ের সুবিস্তৃত হাওয়ায়, সাদা চিকচিক বালুতে। তাতে বাইরের আর্দ্রতা কিছু না কমলেও ব্যাপারীর ভেতর পুরোটা দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে প্রস্তুতি নেয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু বলার, দীর্ঘ কোনো মোনাজাত ধরার।
৩.আহত পাখির দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের আকন্দগাছের ঝোপের দিকে। তার চোখে ঝাপসা ধরা দেয় হালকা ময়লা বেগুনিরঙা আকন্দ ফুলের থোকাগুলো, মনে হয় এই দিনের আলোয়ও অসংখ্য তারা ফুটে আছে। যেভাবেই হোক ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে ছায়া মিলবে। পাখি তাকায় ঝোপের দিকে একবার, বিপরীত দিক থেকে রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসা লাল পিঁপড়ার সারির দিকে একবার আর আকাশের স্বচ্ছ কাচরঙা রোদের দিকে। সে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে গন্তব্য নিয়ে।
ওদিকে নবীনবরণ বাসের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে। বাসের সুপারভাইজার মাথা গুনছে, সবাই ঠিকঠাক উঠল কি না। বাসের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফেরি থেকে ডাঙায় এপারে ওঠার জন্য তৈরি। ইসহাক ব্যাপারীর বউ আকলিমা পাশে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, নাক–মুখ বোরকায় ঢাকা আকলিমার ক্ষীণকণ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে বলছে—‘এই যে শুনছেননি ডেরাইভার সাব, আমাগো বাবুর আব্বা তো এক্ষনো আইসা পৌঁছায় নাই যে। হ্যায় নামাজ পড়বার গ্যাছে তো কইল। হে কই গ্যাছে, খুঁইজ্যা আনেন যে।’ সামনের সিটের দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরা বারো-তেরো বছর বয়সী ছেলেটাও এ মুহূর্তে হাতের শসা খাওয়া বন্ধ রেখে একবার আকলিমার দিকে আরেকবার দরজার দিকে, ড্রাইভারের দিকে তাকায়। বিটলবণসহ শসার রস বেয়ে তার পাঞ্জাবির দুই হাতা ভিজিয়ে ফেলে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এ মুহূর্তে না। ফেরির তৃতীয় তলায় সে সময় খসরু একটা বড় গামলায় ডাল, ডিমভাজি আর পোড়া শুকনা মরিচ নিয়ে ভাত খেতে বসে যায়। ঠিক দরজায় ঠাসা সুন্দর ঊরু বের করা লাস্যময়ী নায়িকার ছবির মুখোমুখি হয়ে। সারা দিনের এই একমুহূর্ত সময় পাওয়ার জন্য সে ছটফট করে। এ সময় সে ভাত খায় আর নায়িকার সঙ্গে একান্তে কথা বলে সুখ–দুঃখের, কোন কাস্টমার তার সঙ্গে কী ব্যবহার করল। সবশেষে প্রতিদিন এই আলাপ শেষ হয় এক কষ্ট নিয়ে। নায়িকাকে সে বলে—‘বুঝলানি আমি এই খসরু এত মাইনষেরে রান্না কইরা খাইওইলাম শুধু বাদ থাকলা আমার পেয়ারের লোক তুমি। আমার হাতের ইলিশ মাছ ভাজা শুকনা মরিচ পোড়া দিয়া আর কচি ডাঁটা চিংড়ির ঝোল খাইলে তুমি আমারে সারাডা জীবন মনে রাকতা গো, ভুলবার পারতা না, হ্যাভি টেস।’ সে গোগ্রাসে ভাত মুখে দিয়ে আবার বলতে থাকে—‘সারাডা দিন শুটিংয়ে থাহো, কী যে খাও, সবার রান্দন তো বালা না, কাছত থাকলে যত্ন–আত্তি কত্তামনি। তহন শুধু তুমার রান্দনই রানতাম গো নাইকা ।’ বলেই সে লজ্জা পেয়ে হাসে, আশপাশে কেউ দেখে ফেলল কি না খেয়াল করে। ফেরির দোতলায় সে সময় নামাজের মোনাজাতে ক্রন্দনরত ইসহাক বলছে বিড়বিড় করে—‘ইয়া আল্লাহ, আমার কথা শোনো গো আল্লাহ, কবুল কইর্যা লও সে, আমার পোলাডারে তুমি লইয়া যাইও না গো আল্লাহ। ও আল্লাহ, সারা জাহানের মালিক তুমি মায়ের কোলডা খালি কইরো না। আমি হ্যার মায়েরে কী দিয়া বুঝ দিমু গো আল্লাহ? হ্যায় তো জানে বড় হওনের লগে লগে পোলা ঠিক হইয়্যা যাইব। পোলাতো আরও রোগে পড়তাছে, হ্যার মা’য় তো সন্দেহ করতাসে আমারে। মায়ের মন তো!! আমি যেন হ্যার লগে মিছা কতা না কই। ও মাবুদ, আমি কেমনে কমু পোলার মায়েরে এই ডাউন সিনডোমের পোলার হায়াত আছে আর কয়ডা বছর মাত্র।’
৪.আকাশে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে। কোত্থেকে মেঘের গর্জন শোনা যায়, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নদীপাড়ের অরিন গার্মেন্টস আরবিঅ্যান্ডবি ব্রিকফিল্ডের ছাইরঙা ধোঁয়া তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আহত পাখি তার ঠোঁট হাঁ করে, বৃষ্টির পানির স্বাদ নেয় তার পিপাসার্ত জিহ্বায়। তার চোখ, শরীর ভেজে, আহত ডানার রক্ত ধুয়ে যায়। খসরু সে সময় তিনতলায় হাঁড়ি–পাতিল ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, চুলায় তার রাতের ভাত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সে উদাস দৃষ্টিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে নাকি অন্য কিছু ভাবে, সেটা বলা মুশকিল। ইসহাক ব্যাপারীর এ মুহূর্তে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে। যা এতক্ষণ ধরে বহু চেষ্টায়ও কেন জানি আসেনি। সে বলতে থাকে—‘ইয়া মাবুদ, মাবুদ রে, রাহমানুর রাহিম তুমি তো তোমার বান্দারে খালি হাতে ফেরত দাও না। আমারেও দিয়ো না। প্রয়োজন হইলে আমারে লইয়্যা যাও গো আল্লাহ, তার বিনিময়ে আমার পোলাডার জীবনডা ভিক্ষা দাও, যেমন কইর্যা ফেরত দিসিলা বাদশার পোলারে (এ সময় সে বাসা থেকে মনে করে আসা বাদশাহ বাবর আর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের নাম বহুকষ্ট করেও মনে করতে পারে না )। ব্যাপারী আবার শুরু করে—‘আল্লাহ তুমি তো পানির ওপর থাকন অবস্থায় তোমার অসহায় বান্দার দোয়া কবুল করো। আমার চোখের সামনে আমার আবদুর রহমানরে নিয়ো না আল্লাহ।’ ব্যাপারীর সময়জ্ঞান লোপ পায়, তার হুঁশ থাকে না মোনাজাতে কতটা সময় পেরিয়ে যায়। নিচে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছায়। হঠাৎ করে নেমে আসা বৃষ্টিতে পুরো ফেরি পিচ্ছিল কাদাময় হয়ে যায়। যারা এতক্ষণ কোনো বাস ছাড়াই শুধু নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল, তারা তাদের বস্তা বেডিং, বাচ্চা ছেলের মেয়েদের হাত ধরে পার হয় গাড়িগুলো পাড়ে ওঠার আগেই। আশপাশের ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক ছোটে ধীরে ধীরে। পেছনে যাত্রীসহ নবীনবরণ বাসের ড্রাইভার গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে নেয় সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরি থেকে পাড়ে ওঠার। ব্যাপারীর বউয়ের চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের দু–একজন সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ব্যাপার কী জানতে। এ সময় ব্যাপারীর অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেরও ঠোঁটের দুপাশে লালা গড়িয়ে পড়ে, চোখের মণি বিস্ফারিত করে সর্বশক্তি দিয়ে সে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে—‘আব...বা...আআআ...আব...বা...আআআ।’
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]