জোহরান মামদানির নাম আপনারা অনেকেই হয়তো শোনেননি। কিন্তু তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ারের নাম অনেকেরই জানা। তাঁর বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন উগান্ডায়।

১৯৬৩ সালে কেনেডি পরিবারের আর্থিক অনুদানে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কে আসেন। এখানেই ১৯৯১ সালে মিরা নায়ারের সঙ্গে পরিণয়। সে বছরই জোহরানের জন্ম।

২.

মাত্র ৩৩ বছরের এই জোহরান মামদানি আগামী নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শুধু যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তা–ই নয়, একাধিক জনমত জরিপে এক ডজনের বেশি প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সবার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুমোর তুলনায় ৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন তিনি।

আপাতত জোহরান মামদানির লক্ষ্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জয়লাভ করা। বাছাইপর্বের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুন। যেহেতু নিউইয়র্ক মূলত একটি ডেমোক্র্যাট-প্রধান শহর, তাই বাছাইপর্বে জিতে গেলে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বিস্তর। কিন্তু এই শহর কি একজন বাদামি রঙের মুসলিমকে তার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুত?

৩.

গত বছর একজন দক্ষিণ এশীয় নারী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জিততে পারেননি। ভাবা হয়, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতকায়, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের সমর্থনে কমলা হ্যারিসকে অনায়াসে পরাস্ত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের কোনো তুলনা হয় না। তবে নিউইয়র্ক যে কোনো একটি শহর নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে। এর বার্ষিক বাজেট ১১২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের গড় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু শিক্ষা বিভাগের যে বাজেট (৩৮ বিলিয়ন ডলার), তা লাওসের মতো একটি দেশের জাতীয় বাজেটের বেশি।

নিউইয়র্কের ভোটাদাতাদের যে মানচিত্র, তা–ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার মানচিত্র থেকে একদম আলাদা। যেমন এই শহরের তালিকাভুক্ত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৬ ও ১০ শতাংশ। অথচ সারা দেশে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; ৩০ শতাংশ করে।

 তার চেয়েও বড় কথা, সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অশ্বেতকায়দের পরিমাণ প্রায় ৪২ শতাংশ, সেখানে নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই অশ্বেতকায় ও বহিরাগত।

বস্তুত, জনসংখ্যার গঠনগত দিকে দিয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহর অধিক বৈচিত্র্যময়। কুইন্স, যেখানে জোহরানের বাস, সেখানে ইংরেজি ভাষা ছাড়াও প্রায় ১৮০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়।

৪.

নিউইয়র্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিজস্বতা রয়েছে। এই শহরে প্রায় ৯ লাখ মুসলিমের বাস, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। মুসলিম সংখ্যার হিসাবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিকাগো, যার মোট মুসলিম জনসংখ্যা লাখ তিনেক।

জনসংখ্যার বৈচিত্র্যের বিচারে নিউইয়র্ক ও লন্ডন প্রায় কাছাকাছি। উভয়ের জনসংখ্যা প্রায় সমান সমান (৯ মিলিয়ন বনাম সাড়ে ৮ মিলিয়ন)। নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের ৩৭ শতাংশ বহিরাগত (অর্থাৎ তাঁদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে), তেমনি লন্ডনের বাসিন্দাদের প্রায় ৪০ শতাংশ বহিরাগত। মোট মুসলিম নাগরিকের সংখ্যার হিসাবেও এই দুই শহর কাছাকাছি; লন্ডনে রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ মুসলিম, নিউইয়র্কে ৯ লাখ।

লন্ডনের সঙ্গে নিউইয়র্কের তুলনা টানছি; কারণ, সেখানে বর্তমান মেয়র সাদিক খান পরপর তিনবার বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডন যদি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, তাহলে নিউইয়র্ক কেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানিকে তার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত করবে না?

৫.

নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্বে এন্ড্রু কুমো জোহরানের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। পরপর দুবার নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত কুমো স্বাভাবিকভাবেই নাম-পরিচিতির দিকে দিয়ে জোহরানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

তবে চার বছর আগে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় কুমো এই শহরের নারী ও বামঘেঁষা ভোটারদের কাছে নিন্দিত। তাঁরাই এখন জোহরানকে প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন।

নবীন ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করতেস জোহরানকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছেন। সেটি তাঁকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু ‘পুলসিরাতের শেষ ধাপ’ পার হতে হলে তাঁকে এই শহরের শক্তিশালী ইহুদি লবির বাধা পার হতে হবে।

বুঝিয়ে বলছি। জোহরান ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক। মুখ্যত ডেমোক্রেটিক পার্টির অসন্তুষ্ট প্রগতিশীল অংশের সমন্বয়ে গঠিত এই দল খোলামেলাভাবে নিজেদের সোশ্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে এদের রয়েছে মার্কিন মূলধারার বিপরীত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, অধিকৃত গাজায় এখন যা চলছে, তা স্পষ্ট জাতিহত্যা বা জেনোসাইড। তারা অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর মার্কিন সাহায্য প্রত্যাহারের পক্ষে, সেখানে যেসব মার্কিন সংস্থা নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে, তা তুলে নেওয়ারও পক্ষে।

ইসরায়েল প্রশ্নে জোহরানের এই অবস্থানের কারণে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ইহুদি লবির আপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ধরা যাক, নিউইয়র্কের প্রগতিশীল ভোটার, মুসলিমসহ অন্য অভিবাসীদের ভোটে জোহরান ২৪ জুনের ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জিতে গেলেন। সে ক্ষেত্রে নভেম্বরের চূড়ান্ত ভোটে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে একজন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। অনুমান করি, তাঁরা ইসরায়েলের সমালোচক ও ফিলিস্তিনের সমর্থক একজন মুসলিমকে কোনোক্রমেই এই শহরের মেয়র হিসেবে দেখতে চান না, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যা–ই হোন, একজোট হবেন জোহরানকে পরাস্ত করতে।

৬.

জোহরানের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে ব্রুকলিন থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি-আমেরিকান কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ। ২০২২ সালে এই শহরের প্রগতিশীলদের সমর্থনে শাহানা সহজ জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর পুনর্নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ইহুদি লবির বিরুদ্ধ-প্রচারণার মুখে পড়তে হয়েছে। গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে একজন ইহুদি প্রার্থীকে।

তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়ে বাছাইপর্বে তাঁর পরাজয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শাহানা নিজের অবস্থান বদলে নিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সমালোচনা থেকে সরে না এলেও এখন তিনি হামাসের সন্ত্রাসী হামলার কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছেন; পাশাপাশি নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধিতে কঠোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন।

৭.

জোহরান মামদানি গাজা প্রশ্নে এখনো অনড়। কিন্তু বাছাইপর্বে জিতে গেলে তাঁকে সম্মিলিত ইহুদি লবির মুখোমুখি হতে হবে। মোটেই বিস্ময়ের কিছু থাকবে না, যদি তিনি শাহানার মতো ইসরায়েল প্রশ্নে নিজের অবস্থান অধিক নমনীয় করে আনেন। তবে তা জয়ের জন্য যথেষ্ট কি না, সময়ই বলতে পারবে।

জোহরানের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাও বিবেচনায় রাখতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমান্বয়ে ডেমোক্র্যাটদের
সমর্থক-ভিতে অল্প অল্প করে ক্ষয় ধরিয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি যেখানে এই শহরে পেয়েছিলেন ২৩ শতাংশ ভোট, সেখানে ২০২৪ সালে তাঁর মোট ভোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।

অতিরিক্ত যে ৭ শতাংশ ভোট ট্রাম্প এই শহরে পান, তার একটা বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটাররা। এই ভোটাররা ট্রাম্প-সমর্থিত কোনো রিপাবলিকানকে ভোট না দিয়ে জোহরানকে কেন ভোট দেবেন—এমন প্রশ্নের জবাব আমরা এখনো পাইনি।

জোহরানের বিপক্ষে আরও কাজ করতে পারে অশ্বেতকায়দের ব্যাপারে শ্বেতকায় ভোটারদের দ্বিধা। তারপরও তিনি একজন মুসলিম, যাঁদের ব্যাপারে দেশটির অনেকেরই ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব রয়েছে।

এ মুহূর্তে প্রগতিশীল শ্বেতকায়দের সমর্থনে জোহরান হয়তো এগিয়ে, কিন্তু ভোটের সময় তাঁদের অনেকেই সিদ্ধান্ত বদলে একজন অশ্বেতকায় ও মুসলিমকে ভোট না দিয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ভোট দেবেন, সে সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না।

এই প্রবণতার নাম ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’। ১৯৮২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর নির্বাচনে জনমতে শ্বেতকায়দের সমর্থন পেয়ে এগিয়ে
ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী টম ব্র্যাডলি। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা গেল, প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে গেছেন।

মুখে এক কিন্তু কাজে ভিন্ন, শ্বেতকায় ভোটারদের এই ব্যবহারের নাম ব্র্যাডলি ইফেক্ট। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ঠকে যান আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী ডেভিড ডিনকিন্স। কারণ, ব্র্যাডলি ইফেক্ট। জোহরান মামদানি কি ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’ উতরে যেতে পারবেন?

হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প বল ক ন প র য ক তর ষ ট র র ন উইয়র ক স ট ন র ব চ ত কর ন উইয়র ক র প রগত শ ল ব ছ ইপর ব এই শহর র জনস খ য ইসর য় ল র প রথম অবস থ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার উপায়

আধুনিক জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে মুসলিম বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে আরও এক গভীর প্রশ্ন নিয়ে—আমরা কীভাবে আমাদের জ্ঞানের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনব? কীভাবে আমরা পশ্চিমা চিন্তার আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের পথ খুঁজব?

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম পণ্ডিতরা জ্ঞানের আলো জ্বেলেছেন, বিশ্বকে শিখিয়েছেন; কিন্তু ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় আমাদের জ্ঞানের সেই সোনালি ঐতিহ্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

জ্ঞানের ওপর আধিপত্য

গত শতাব্দীতে মুসলিম ও অমুসলিম চিন্তাবিদেরা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বই, প্রবন্ধ ও সেমিনারে এই আলোচনা এতটাই ভারী হয়ে উঠেছে যে মনে হয়, আমরা একই জায়গায় আটকে আছি।

মুসলিমরা এই বিতর্কে ঢুকেছিলেন তাঁদের হারানো মর্যাদা ফিরে পাওয়ার আশায়; কিন্তু আমরা কোথায় ভুল করলাম? ঔপনিবেশিকতাকে দোষারোপ করে আমরা কত দূর এগোলাম?

আমার মনে হয়, কোনো কারণে আলোচনা আমাদের ভুল পথে নিয়ে গেছে—আমরা সত্যিকারের সংস্কারের বদলে পৃষ্ঠপোষকতায় মেতে উঠেছি। ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ, সংগীত উৎসব বা ফর্মুলা ওয়ান রেসের মতো কাজে বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি।

শিক্ষার কথা ভাবলেও আমরা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় আমদানি করেছি; কিন্তু নিজেদের জ্ঞানের ঐতিহ্যের গভীরতায় ফিরে যাইনি।

আমরা সত্যিকারের সংস্কারের বদলে পৃষ্ঠপোষকতায় মেতে উঠেছি। ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ, সংগীত উৎসব বা ফর্মুলা ওয়ান রেসের মতো কাজে বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি।

ইসমাইল আল-ফারুকির ‘জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ ধারণা একসময় আমাদের হৃদয়ে আলো জ্বেলেছিল। তিনি বলেছিলেন, সব শাখার জ্ঞানকে ইসলামি নীতির সঙ্গে মিলিয়ে একটি একেশ্বরবাদী বিশ্বদৃষ্টি গড়তে হবে; কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন কোথায় যেন ম্লান হয়ে গেছে। (ইসমাইল আল-ফারুকি, ইসলামাইজেশন অব নলেজ, পৃ. ৩৫, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, হেরন্ডন, ১৯৮২)

আমাদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি সত্যিই আমাদের জ্ঞানের ঐতিহ্য ফিরে পেতে চাই, নাকি পশ্চিমের ছায়ায় হাঁটতে চাই?

আরও পড়ুনইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় মুসলিম নারীর করণীয়২৬ আগস্ট ২০২৫পশ্চিমা জ্ঞানের শৃঙ্খল

পশ্চিমা জগৎ জ্ঞানেরও আধিপত্য স্থাপন করেছে, এমনকি যেসব ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বের বৈধতা কম, সেখানেও তাদের ছায়া আছে।

উদাহরণস্বরূপ বলি, আমেরিকার ইলিনয়ে একটি প্রদর্শনীতে কোরআনের একটি দুর্লভ পাণ্ডুলিপির প্রেক্ষাপট বর্ণনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন অমুসলিম নারীকে। দারুল কাসিমের একজন ছাত্র যখন তাঁর ভুল সংশোধন করতে চাইলেন। তিনি উত্তর দিলেন, ‘এখানে আমিই দায়িত্বে।’

আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, একজন মুসলিম পণ্ডিতের আরবি ব্যাকরণের পাণ্ডুলিপি পশ্চিমা প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ, তিনি পশ্চিমা উৎস উল্লেখ করেননি।

এ ঘটনাগুলো দেখায়, পশ্চিমা একাডেমিক গেটকিপিং আমাদের জ্ঞানের ইতিহাসকে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যায় ঢেলে সাজাচ্ছে।

এই ইউরোপকেন্দ্রিক আধিপত্য আমাদের জ্ঞানের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আমাদের পাণ্ডুলিপি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের গল্প—এগুলোকে অন্যরা তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছেন।

পেরুভিয়ান পণ্ডিত আনিবাল কুইজানো বলেন, ডিকলোনাইজেশন মানে জ্ঞানের ওপর ইউরোপকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করা। আমাদের জ্ঞানের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের নিজেদের জ্ঞানতত্ত্ব পুনর্গঠন করতে হবে (আনিবাল কুইজানো, ‘কলোনিয়ালিটি অব পাওয়ার’, পৃ. ৫৩০, নেপান্টলা, ডারহাম, ২০০০)।

আমেরিকার ইলিনয়ে একটি প্রদর্শনীতে কোরআনের একটি দুর্লভ পাণ্ডুলিপির প্রেক্ষাপট বর্ণনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন অমুসলিম নারীকে। দারুল কাসিমের একজন ছাত্র যখন তাঁর ভুল সংশোধন করতে চাইলেন। তিনি উত্তর দিলেন, ‘এখানে আমিই দায়িত্বে।’ইসলামি জ্ঞানতত্ত্বের পথ

ইসলামি জ্ঞানতত্ত্ব তিনটি মূল উৎসকে স্বীকৃতি দেয়: পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি থেকে উদ্ভূত জ্ঞান এবং নবীর মাধ্যমে আসা প্রত্যাদেশের মতো সত্য প্রতিবেদন। এ তিনটি উৎস মানুষের জ্ঞানের সব শাখাকে ঘিরে রাখে।

ইসলামে জ্ঞান কখনো আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, তিনিই সব জ্ঞানের মূল উৎস। পশ্চিমা ঐতিহ্য আধুনিকতার নামে জ্ঞানকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে; কিন্তু ইসলাম বলে, সত্যিকারের সৃজনশীলতা আল্লাহর জ্ঞানকে সম্মান করা থেকে আসে। (সুরা আলাক, আয়াত: ১-৫)

ইতিহাসে মুসলিমরা এই জ্ঞানের উৎসগুলো আয়ত্ত করে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইসলামি স্বর্ণযুগে (অষ্টম-চতুর্দশ শতাব্দী) বাগদাদের বাইত আল-হিকমা বিভিন্ন সংস্কৃতির জ্ঞানের মিলনস্থল ছিল।

ইবনে সিনা ও আল-ফারাবির মতো পণ্ডিতেরা বিজ্ঞান, দর্শন আর ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন; কিন্তু আজ আমরা এই ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের জ্ঞানের গল্প এখন অন্যরা লিখছে, আমাদের কণ্ঠকে নিশ্চুপ করে দিয়ে। (সৈয়দ হোসাইন নসর, সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম, পৃ. ৫৬, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৬৮)

ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামি জ্ঞান: একটি মিথ্যা দ্বন্দ্ব

আজ মুসলিম বিশ্বে একটি গভীর দ্বন্দ্ব রয়েছে—ইসলামি আর ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করব? অনেকে মনে করেন, পশ্চিমা রেনেসাঁর মতো একটি পুনর্জাগরণ দরকার, যেখানে আখিরাত বা পরকালের চিন্তা বাদ দেওয়া হবে; কিন্তু মুসলিমরা আখিরাতে বিশ্বাসী, আর এই বিশ্বাসই আমাদের জ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিকে গঠন করে।

এই দ্বন্দ্ব মিথ্যা। কারণ, ইসলামি শরিয়া আমাদের দুনিয়ার কাজকে আখিরাতের সঙ্গে যুক্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিমরা দান করেন কেবল মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, বরং আখিরাতের পুরস্কারের আশায়। এই দান কেবল মানবিক নয়, গভীরভাবে ধর্মীয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬১)।

ইসলামি জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানকে ধর্মনিরপেক্ষ বা পবিত্র বলে ভাগ করে না। এটি জ্ঞানকে নাফি’ (উপকারী) এবং আনফা’ (অধিক উপকারী) হিসেবে দেখে। নাফি’ জ্ঞান এই দুনিয়ায় মানুষের উপকার করে, যেমন নুহ (আ.)-কে আল্লাহ জাহাজ নির্মাণের জ্ঞান দিয়েছিলেন, আর দাউদ (আ.)-কে লোহা দিয়ে বর্ম তৈরির শিল্প শিখিয়েছিলেন। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮০)

আনফা’ জ্ঞান পরকালে উপকার করে, যেমন কোরআন তিলাওয়াত, ইবাদতের জ্ঞান বা আল্লাহর সেবার জ্ঞান। মাদ্রাসা, মসজিদ বা জাকাত ফাউন্ডেশন এই আনফা’ জ্ঞানের অংশ।

আরও পড়ুননিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো ইসলামে ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব২৩ আগস্ট ২০২৫জ্ঞানের একতা

ইসলামের তাওহিদ শুধু আল্লাহর একত্ব নয়, জ্ঞানের একত্বও। আমাদের জ্ঞানকে ধর্মনিরপেক্ষ বা পবিত্র বলে ভাগ করার দরকার নেই। তাওহিদ আমাদের শেখায়, সব জ্ঞান আল্লাহ থেকে আসে, আর তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য উপকারী হতে পারে।

আজকের যুগে, যখন সমান্তরাল বিশ্বের ধারণা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করছেন, তখন পরকালে বিশ্বাস করা অযৌক্তিক নয়। আমাদের জ্ঞানকে তার সঠিক উপযোগিতা অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে—দুনিয়ার জন্য যা উপকারী, আর আখিরাতের জন্য যা অধিক উপকারী। (এম এ খোলওয়াড়িয়া, ‘ডিকলোনাইজিং নলেজ,’ পৃ. ১৮, আল–জাজিরা, দোহা, ২০২৫)

মুসলিমরা দান করেন কেবল মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, বরং আখিরাতের পুরস্কারের আশায়। এই দান কেবল মানবিক নয়, গভীরভাবে ধর্মীয়।পুনর্জাগরণের পথ

ইসমাইল আল-ফারুকির জ্ঞানের ইসলামীকরণ ছিল একটি শুরু; কিন্তু আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। আমাদের জ্ঞানতত্ত্বকে পুনর্গঠন করতে হবে ইউরোপকেন্দ্রিক কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে। এটি কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতির বিষয় নয়; বরং জ্ঞানের মূল ভিত্তির বিষয়।

আমাদের ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে—ইবনে রুশদ, আল-গাজ্জালির মতো পণ্ডিতদের কাছে, যাঁরা জ্ঞানকে আল্লাহর আলোর সঙ্গে মিলিয়েছিলেন। আমাদের মাদ্রাসাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যেখানে বিজ্ঞান, দর্শন আর ধর্ম একসঙ্গে ফুটে উঠবে।

আজকের ডিজিটাল যুগে ইসলামি জীবনধারা অ্যাপগুলো আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ‘মুসলিম প্রো’র মতো অ্যাপ নামাজের সময়, কোরআন পাঠ আর দোয়ার সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু এই অ্যাপগুলো শুধু সরঞ্জাম নয়, এগুলো আমাদের জ্ঞানের ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তোলার একটি পথও বটে।

আমাদের হৃদয়ে এই বিশ্বাস জাগাতে হবে যে আমাদের জ্ঞান আমাদের নিজস্ব—এটি আল্লাহর দেওয়া আলো, যা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়কেই আলোকিত করতে পারে। (মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ, ইনট্রোডাকশন টু ইসলাম, পৃ. ৭৮, দার আল-আন্দালুস, লন্ডন, ১৯৬৯)

মুসলিম বিশ্বের সামনে একটি সুযোগ—নিজেদের জ্ঞানের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার, ইউরোপকেন্দ্রিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার। আমাদের ঐতিহ্য কেবল অতীত নয়, এটি আমাদের হৃদয়ের আলো, যা নতুন সময়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। কোরআন আমাদের জ্ঞানের পথে ডাকে। (সুরা তাহা, আয়াত: ১১৪)

তাওহিদ আমাদের শেখায়, জ্ঞান এক—এটি আল্লাহ থেকে আসে, আর এটি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের পথ দেখায়। আমাদের এই আলোকে আঁকড়ে ধরতে হবে, আমাদের গল্প নিজেদের কণ্ঠে বলতে হবে। এই পথে আমরা কেবল জ্ঞানই ফিরে পাব না, আমাদের হৃদয়ে শান্তি আর মর্যাদাও ফিরিয়ে আনব।

সূত্র: আলজাজিরা ডট কম

আরও পড়ুনবিশ্বে ইসলামের শান্তিপূর্ণ প্রসার১৪ মার্চ ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামীকাল নিউইয়র্ক যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • গকসু নির্বাচন: জাহিদের প্রচারণায় সবুজের ডাক
  • রাকসুতে দুঃখ ঘোচাতে চায় ছাত্রদল, জয় ধরে রাখতে মরিয়া শিবির
  • শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব
  • চুয়াডাঙ্গায় আবাসিক হোটেল থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার
  • অনুমতি ছাড়াই মেটার বিজ্ঞাপনে স্কুলশিক্ষার্থীদের ছবি
  • নরসিংদীতে ব্রহ্মপুত্র থেকে পাঁচ মামলার আসামির লাশ উদ্ধার
  • মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার উপায়
  • তুর্কি ধনকুবেরের প্রমোদতরিতে ট্রাম্পকন্যার অবকাসযাপন, শ্বশুর তখন জ্বালানিচুক্তি নিয়ে ব্যস্ত লিবিয়ায়
  • নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের মঞ্চে বাংলাদেশি মডেল নিবিড় আদনান