জোহরান মামদানির নাম আপনারা অনেকেই হয়তো শোনেননি। কিন্তু তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ারের নাম অনেকেরই জানা। তাঁর বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন উগান্ডায়।

১৯৬৩ সালে কেনেডি পরিবারের আর্থিক অনুদানে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কে আসেন। এখানেই ১৯৯১ সালে মিরা নায়ারের সঙ্গে পরিণয়। সে বছরই জোহরানের জন্ম।

২.

মাত্র ৩৩ বছরের এই জোহরান মামদানি আগামী নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শুধু যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তা–ই নয়, একাধিক জনমত জরিপে এক ডজনের বেশি প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সবার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুমোর তুলনায় ৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন তিনি।

আপাতত জোহরান মামদানির লক্ষ্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জয়লাভ করা। বাছাইপর্বের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুন। যেহেতু নিউইয়র্ক মূলত একটি ডেমোক্র্যাট-প্রধান শহর, তাই বাছাইপর্বে জিতে গেলে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বিস্তর। কিন্তু এই শহর কি একজন বাদামি রঙের মুসলিমকে তার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুত?

৩.

গত বছর একজন দক্ষিণ এশীয় নারী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জিততে পারেননি। ভাবা হয়, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতকায়, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের সমর্থনে কমলা হ্যারিসকে অনায়াসে পরাস্ত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের কোনো তুলনা হয় না। তবে নিউইয়র্ক যে কোনো একটি শহর নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে। এর বার্ষিক বাজেট ১১২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের গড় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু শিক্ষা বিভাগের যে বাজেট (৩৮ বিলিয়ন ডলার), তা লাওসের মতো একটি দেশের জাতীয় বাজেটের বেশি।

নিউইয়র্কের ভোটাদাতাদের যে মানচিত্র, তা–ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার মানচিত্র থেকে একদম আলাদা। যেমন এই শহরের তালিকাভুক্ত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৬ ও ১০ শতাংশ। অথচ সারা দেশে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; ৩০ শতাংশ করে।

 তার চেয়েও বড় কথা, সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অশ্বেতকায়দের পরিমাণ প্রায় ৪২ শতাংশ, সেখানে নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই অশ্বেতকায় ও বহিরাগত।

বস্তুত, জনসংখ্যার গঠনগত দিকে দিয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহর অধিক বৈচিত্র্যময়। কুইন্স, যেখানে জোহরানের বাস, সেখানে ইংরেজি ভাষা ছাড়াও প্রায় ১৮০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়।

৪.

নিউইয়র্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিজস্বতা রয়েছে। এই শহরে প্রায় ৯ লাখ মুসলিমের বাস, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। মুসলিম সংখ্যার হিসাবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিকাগো, যার মোট মুসলিম জনসংখ্যা লাখ তিনেক।

জনসংখ্যার বৈচিত্র্যের বিচারে নিউইয়র্ক ও লন্ডন প্রায় কাছাকাছি। উভয়ের জনসংখ্যা প্রায় সমান সমান (৯ মিলিয়ন বনাম সাড়ে ৮ মিলিয়ন)। নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের ৩৭ শতাংশ বহিরাগত (অর্থাৎ তাঁদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে), তেমনি লন্ডনের বাসিন্দাদের প্রায় ৪০ শতাংশ বহিরাগত। মোট মুসলিম নাগরিকের সংখ্যার হিসাবেও এই দুই শহর কাছাকাছি; লন্ডনে রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ মুসলিম, নিউইয়র্কে ৯ লাখ।

লন্ডনের সঙ্গে নিউইয়র্কের তুলনা টানছি; কারণ, সেখানে বর্তমান মেয়র সাদিক খান পরপর তিনবার বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডন যদি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, তাহলে নিউইয়র্ক কেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানিকে তার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত করবে না?

৫.

নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্বে এন্ড্রু কুমো জোহরানের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। পরপর দুবার নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত কুমো স্বাভাবিকভাবেই নাম-পরিচিতির দিকে দিয়ে জোহরানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

তবে চার বছর আগে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় কুমো এই শহরের নারী ও বামঘেঁষা ভোটারদের কাছে নিন্দিত। তাঁরাই এখন জোহরানকে প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন।

নবীন ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করতেস জোহরানকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছেন। সেটি তাঁকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু ‘পুলসিরাতের শেষ ধাপ’ পার হতে হলে তাঁকে এই শহরের শক্তিশালী ইহুদি লবির বাধা পার হতে হবে।

বুঝিয়ে বলছি। জোহরান ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক। মুখ্যত ডেমোক্রেটিক পার্টির অসন্তুষ্ট প্রগতিশীল অংশের সমন্বয়ে গঠিত এই দল খোলামেলাভাবে নিজেদের সোশ্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে এদের রয়েছে মার্কিন মূলধারার বিপরীত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, অধিকৃত গাজায় এখন যা চলছে, তা স্পষ্ট জাতিহত্যা বা জেনোসাইড। তারা অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর মার্কিন সাহায্য প্রত্যাহারের পক্ষে, সেখানে যেসব মার্কিন সংস্থা নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে, তা তুলে নেওয়ারও পক্ষে।

ইসরায়েল প্রশ্নে জোহরানের এই অবস্থানের কারণে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ইহুদি লবির আপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ধরা যাক, নিউইয়র্কের প্রগতিশীল ভোটার, মুসলিমসহ অন্য অভিবাসীদের ভোটে জোহরান ২৪ জুনের ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জিতে গেলেন। সে ক্ষেত্রে নভেম্বরের চূড়ান্ত ভোটে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে একজন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। অনুমান করি, তাঁরা ইসরায়েলের সমালোচক ও ফিলিস্তিনের সমর্থক একজন মুসলিমকে কোনোক্রমেই এই শহরের মেয়র হিসেবে দেখতে চান না, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যা–ই হোন, একজোট হবেন জোহরানকে পরাস্ত করতে।

৬.

জোহরানের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে ব্রুকলিন থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি-আমেরিকান কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ। ২০২২ সালে এই শহরের প্রগতিশীলদের সমর্থনে শাহানা সহজ জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর পুনর্নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ইহুদি লবির বিরুদ্ধ-প্রচারণার মুখে পড়তে হয়েছে। গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে একজন ইহুদি প্রার্থীকে।

তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়ে বাছাইপর্বে তাঁর পরাজয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শাহানা নিজের অবস্থান বদলে নিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সমালোচনা থেকে সরে না এলেও এখন তিনি হামাসের সন্ত্রাসী হামলার কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছেন; পাশাপাশি নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধিতে কঠোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন।

৭.

জোহরান মামদানি গাজা প্রশ্নে এখনো অনড়। কিন্তু বাছাইপর্বে জিতে গেলে তাঁকে সম্মিলিত ইহুদি লবির মুখোমুখি হতে হবে। মোটেই বিস্ময়ের কিছু থাকবে না, যদি তিনি শাহানার মতো ইসরায়েল প্রশ্নে নিজের অবস্থান অধিক নমনীয় করে আনেন। তবে তা জয়ের জন্য যথেষ্ট কি না, সময়ই বলতে পারবে।

জোহরানের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাও বিবেচনায় রাখতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমান্বয়ে ডেমোক্র্যাটদের
সমর্থক-ভিতে অল্প অল্প করে ক্ষয় ধরিয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি যেখানে এই শহরে পেয়েছিলেন ২৩ শতাংশ ভোট, সেখানে ২০২৪ সালে তাঁর মোট ভোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।

অতিরিক্ত যে ৭ শতাংশ ভোট ট্রাম্প এই শহরে পান, তার একটা বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটাররা। এই ভোটাররা ট্রাম্প-সমর্থিত কোনো রিপাবলিকানকে ভোট না দিয়ে জোহরানকে কেন ভোট দেবেন—এমন প্রশ্নের জবাব আমরা এখনো পাইনি।

জোহরানের বিপক্ষে আরও কাজ করতে পারে অশ্বেতকায়দের ব্যাপারে শ্বেতকায় ভোটারদের দ্বিধা। তারপরও তিনি একজন মুসলিম, যাঁদের ব্যাপারে দেশটির অনেকেরই ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব রয়েছে।

এ মুহূর্তে প্রগতিশীল শ্বেতকায়দের সমর্থনে জোহরান হয়তো এগিয়ে, কিন্তু ভোটের সময় তাঁদের অনেকেই সিদ্ধান্ত বদলে একজন অশ্বেতকায় ও মুসলিমকে ভোট না দিয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ভোট দেবেন, সে সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না।

এই প্রবণতার নাম ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’। ১৯৮২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর নির্বাচনে জনমতে শ্বেতকায়দের সমর্থন পেয়ে এগিয়ে
ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী টম ব্র্যাডলি। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা গেল, প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে গেছেন।

মুখে এক কিন্তু কাজে ভিন্ন, শ্বেতকায় ভোটারদের এই ব্যবহারের নাম ব্র্যাডলি ইফেক্ট। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ঠকে যান আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী ডেভিড ডিনকিন্স। কারণ, ব্র্যাডলি ইফেক্ট। জোহরান মামদানি কি ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’ উতরে যেতে পারবেন?

হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প বল ক ন প র য ক তর ষ ট র র ন উইয়র ক স ট ন র ব চ ত কর ন উইয়র ক র প রগত শ ল ব ছ ইপর ব এই শহর র জনস খ য ইসর য় ল র প রথম অবস থ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন: আমাদের স্মৃতির পথযাত্রা

আজ ৩ নভেম্বর তিনি ৯২ বছরের চৌকাঠ টপকালেন। জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালে। দীর্ঘ জীবন তাঁর—শুধু দীর্ঘ বললে অন‍্যায় হবে, একটি অনন‍্যসাধারণ, অভাবনীয়, বিস্ময়কর জীবন তাঁর। সে জীবনের তুলনা মেলা ভার কোন সৃষ্টিতে, প্রাপ্তিতে বা অবদানে। না, সেসব বিষয়ে আমি বলছি না—সেসব বিধৃত আছে নানান বিদগ্ধজনের লেখায়, আলাপচারিতায়, তাঁর ওপরে তৈরি জীবনচিত্রে। অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের অতুলনীয় কীর্তির কথা সারা বিশ্ব জানে।

আমি শুধু ভাবি আমার অভাবনীয় সৌভাগ্যের কথা। প্রায় তিন দশক সময়ে কাজের সূত্রে শতবার দেখা হয়েছে, একত্রে কাজ করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে নিউইয়র্কে, বোস্টনে, কেমব্রিজে নানান বিষয়ের আলোচনায়, বিতর্কে। আমাদের সময়কার এক বিস্ময়কর প্রতিভার খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে আমার।

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে—যখন আমি বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ছাত্র। তাঁর যে বইটি প্রথম আমার হাতে আসে, তার নাম ছিল ‘চয়েস অব টেকনিক’। খুব সম্ভবত তাঁর স্নাতক-উত্তর অভিসন্দর্ভের ওপরে ভিত্তি করে লেখা। সে বইয়ের বেশির ভাগই বুঝিনি—বোঝার কথাও নয় অর্থনীতির প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থীর। কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণের ধার এবং তাঁর যুক্তির শাণিত ভাষা বুঝতে পেরেছিলাম।

তারপর আমার ছাত্রজীবনে, বিদেশে উচ্চশিক্ষাকালে এবং আমার শিক্ষকতা জীবনে আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকের মতো আমাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে তাঁর গবেষণা এবং বিদ‍্যায়তনিক লেখার কাছে। আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাঁর মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনা; ব‍্যক্তিমানুষ এবং মানবগোষ্ঠীর সক্ষমতা, সুযোগ এবং তাঁর চয়ন ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াস; অর্থনীতিকে দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ; এবং সমতা, বৈষম‍্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর তীক্ষ্ণ লেখা।

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে ড. মাহবুব উল হকের ঘরে যখন আমি জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে যোগদান করি। অধ‍্যাপক সেন, মাহবুব উল হক এবং অধ‍্যাপক রেহমান সোবহান সতীর্থ বন্ধু ছিলেন কেমব্রিজে। তারপর দীর্ঘ এক যুগ তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা মানব উন্নয়ন বিষয়ে। কাজ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আর তর্কবিতর্কের বৈঠক বসত মূলত মাহবুব উল হকের ঘরে। কখনো কখনো অধ‍্যাপক সেন আমার ঘরে চলে আসতেন গল্প করতে বা আমার বাংলা বইয়ের পাতা ওলটাতে।

আমার কেন যেন মনে হতো, তিনি বাংলায় গল্প করতে চাইতেন। তিনি গল্প করতেন কালোর চায়ের দোকানের কথা, সাইকেলে শান্তিনিকেতনে টই টই করে ঘোরা, পৌষ মেলার কথা, শান্তিনিকেতনে তাঁর পৈতৃক নিবাস ‘প্রতীচীর’ কথা। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে তাঁর বন্ধু মীনাক্ষী দত্ত (বুদ্ধদেব বসুর কন্যা) একবার তাঁকে তুলনা করেছিলেন ‘খাঁটি জিলেট ব্লেডের মতো ধারালো বলে’ এবং বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্সিতে অধ‍্যাপক সেনকে দেখা যেত গোটানো হাতা আর জামার পাশের পকেটে গোল করে মোড়ানো দু-নম্বরি খাতা নিয়ে।

হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধার্ঘ‍্য ঢেলে দিয়ে তাঁকে আমি বলি, ‘শুভ জন্মদিন, অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন। আপনি শুধু আমাদের বাতিঘর নন, আপনি আমাদের ধ্রুবতারা। আপনি জ্বল জ্বল করতে থাকুন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পথ দেখানোর জন্য, দিকনির্দেশ করার জন্য।’

নব্বইয়ের দশকে অধ‍্যাপক সেন যখন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার হলেন, তখন আমাদের অনেক বৈঠক বসত মাস্টারস লজে। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ড. হক, আমি এবং অন্যরা বাড়ির পেছনের বাগানে বেড়াতাম। মনে আছে, একবার এমা (অধ্যাপক এমা রথসচাইল্ড, অধ্যাপক সেনের স্ত্রী) এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ইতিহাসবিদ এমা জানিয়েছিলেন যে ওই বাড়িটি একসময় রঙ্গমঞ্চ ছিল।

বাগানের দেয়ালে দেয়ালে তার ছাপ। আমি অনেক সময় এমার অফিসে বসেও কাজ করেছি। মনে আছে, প্রথমবার যখন মাস্টার্স লজে যাই, তখনো সেন পরিবার সেখানে ওঠেনি। আমি সেখানে এক রাত ছিলাম। স্বল্প আলো, নিউটনের চেয়ার, দেয়ালের ছায়া সব মিলে এক রহস‍্যময় ভৌতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। সে রাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না।

আরও পড়ুনবর্তমান সংকটে হবস, রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন যেখানে প্রাসঙ্গিক১৩ জুন ২০২৫

১৯৯৮ সালে মাহবুব হক প্রয়াত হলেন। তার বছর তিনেক পরে আমি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ‍্য বিভাগের পরিচালক পদে বৃত হলাম। অধ‍্যাপক সেনের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের যোগসূত্রটি একটু ক্ষীণ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের অন‍্য সম্পর্কগুলো রইল অটুট।

১৯৯৮ সালে অধ‍্যাপক সেন যখন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর পেলেন, তখন তিনি নিউইয়র্কে। সকালেই তিনি চলে এলেন আমার ঘরে—কী উত্তেজনা, কী উন্মাদনা আমাদের সবার। সেদিনকার সব অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের সহকর্মীরাই করল। অধ‍্যাপক সেনের কাজের ওপরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল আমার তাঁর সহকর্মী হিসেবে। সে বছরেই জাতিসংঘ আয়োজিত ড. হকের স্মরণসভায় অপূর্ব একটি বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন বন্ধুর স্মৃতিতে।

বেণু (রাশেদা সেলিম, আমার প্রয়াত প্রথম স্ত্রী) এসেছিল সে অনুষ্ঠানে। কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি বেণুকে দেখে। অনেক মমতায় আদর করেছিলেন ওকে। বেণু বলেছিল যে ও মাছের ঝোল রেঁধে তাঁকে খাওয়াবে। কী যে উত্তেজিত হয়েছিলেন তিনি। বারবার বলেছিলেন যে বরফ দেওয়া মাছ হলে চলবে না, তাঁর তাজা মাছ চাই। না, সেটা আর হয়ে ওঠেনি কোনো দিন। বেণু চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে অধ‍্যাপক সেন নিউইয়র্কে এলে বেণুকে দেখতে চেয়েছিলেন—আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাদের মধ‍্যাহ্নভোজে।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের বাজেট যে কারণে অমর্ত্য সেনের উন্নয়নতত্ত্বের পরিপন্থী২২ আগস্ট ২০২৪

জাতিসংঘের কাছে ‘পাম’ রেস্তোরাঁয় আমরা কাটিয়েছিলাম বেশ কটি ঘণ্টা। চলে যাওয়ার আগে নিজে বলে ছবি তুলেছিলেন বেণুর সঙ্গে, ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বেণুর এবং আমার কারও চোখ তখন শুকনো ছিল না। বেণুর প্রয়াণের পরে অধ‍্যাপক সেন আমাকে দীর্ঘ একটি হৃদয়স্পর্শী ব‍্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কৈশোরে তাঁর প্রাণঘাতী অসুস্থতা এবং কলকাতা নীলরতন হাসপাতালে সে যুগের চিকিৎসার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন।

তার কিছুদিন পরে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বারবার আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে ঢাকায় তিনি ‘বেণুর মেয়েকে’ দেখতে চান। মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক) উদ্যোগে তাঁর শত ব‍্যস্ততার মধ্যেও অধ‍্যাপক সেন আনিয়ে নিয়েছিলেন সদ্য মা-হারা আমাদের জ্যেষ্ঠ কন‍্যা রোদেলাকে। রোদেলা এখনো বড় মমতার সঙ্গে তাঁর স্নেহ-আদরের কথা বলে। তারও বছর বারো আগে আমাদের কনিষ্ঠ কন‍্যা মেখলা এসেছিল নিউইয়র্কে তাঁর এক বক্তৃতায়। আমি পরিচয় করিয়ে দিতেই কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি! মেখলার সঙ্গেও ছবি আছে ওঁর।

আরও পড়ুনঅমর্ত্য সেনকে মনে করালো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা০৬ নভেম্বর ২০২০

আমার শ্বশ্রুপিতা, বেণুর বাবা, জাতীয় অধ‍্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে তাঁর। তাঁদের দুজনার মধ‍্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ ছিল অত্যন্ত বেশি। অধ‍্যাপক চৌধুরীর সম্ভবত ৮০তম জন্মবার্ষিকীর একটি স্মরণিকার জন্য অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন একটি শুভেচ্ছাবাণী দিয়েছিলেন বাংলায়। সেটার পরিমার্জন, পরিশোধন এবং পরিশীলনে অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন যে কতখানি সময় ও শ্রম দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের অনুধাবনের অগম‍্য। সেটার একটা খসড়া আমার কাছে আছে।

একটা হাসির কথা মনে পড়ল। জাতিসংঘে আমার পদবি কী, আমি যে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত, তার সবটাই অধ‍্যাপক চৌধুরীর জানা। কিন্তু সাহিত‍্যের লোক বলে তাঁর হয়তো ঠিক পরিষ্কার ধারণা নেই যে তাঁর জামাতা আসলেই কী করে, কী তার কাজ। হার্ভার্ডে এক সভায় দুজনেই মঞ্চোপবিষ্ট—আমার শ্বশ্রুপতা সভাপতি, অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন প্রধান অতিথি। কিছুক্ষণ পরে সভাপতি প্রধান অতিথিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, আমার জামাইটি ঠিক কী করে?’ ততোধিক নিচুস্বরে প্রধান অতিথি জবাব দেন, ‘সেলিম? ও যে কী করে তা আমি জানি না।’ সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘সেলিম যে কী করে, তা কেউ জানে বলে মনে হয় না। ‘ঘটনাটি জেনে সবার যে কী হাসি!

অমর্ত‍্য সেন ও সেলিম জাহান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র হয়ে ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি
  • নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র হলেন জোহরান মামদানি
  • নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ৩০ বছরে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি
  • নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলছে, ভোট দিয়েছেন মামদানি-কুমো
  • সর্বশেষ জরিপেও কুমোর চেয়ে ১৪.৩ পয়েন্ট এগিয়ে জোহরান
  • জোহরান মামদানির কতটা বিরোধী, কুমোকে সমর্থন দিয়ে সেটি বুঝিয়ে দিলেন ট্রাম্প
  • নিউইয়র্ক ছাড়িয়ে জাতীয় মুখ মামদানি
  • মামদানির উত্থান থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন ইউরোপের বামপন্থীরা
  • অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন: আমাদের স্মৃতির পথযাত্রা
  • ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প