জোহরান মামদানির নাম আপনারা অনেকেই হয়তো শোনেননি। কিন্তু তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ারের নাম অনেকেরই জানা। তাঁর বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন উগান্ডায়।

১৯৬৩ সালে কেনেডি পরিবারের আর্থিক অনুদানে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কে আসেন। এখানেই ১৯৯১ সালে মিরা নায়ারের সঙ্গে পরিণয়। সে বছরই জোহরানের জন্ম।

২.

মাত্র ৩৩ বছরের এই জোহরান মামদানি আগামী নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শুধু যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তা–ই নয়, একাধিক জনমত জরিপে এক ডজনের বেশি প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সবার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুমোর তুলনায় ৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন তিনি।

আপাতত জোহরান মামদানির লক্ষ্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জয়লাভ করা। বাছাইপর্বের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুন। যেহেতু নিউইয়র্ক মূলত একটি ডেমোক্র্যাট-প্রধান শহর, তাই বাছাইপর্বে জিতে গেলে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বিস্তর। কিন্তু এই শহর কি একজন বাদামি রঙের মুসলিমকে তার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুত?

৩.

গত বছর একজন দক্ষিণ এশীয় নারী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জিততে পারেননি। ভাবা হয়, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতকায়, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের সমর্থনে কমলা হ্যারিসকে অনায়াসে পরাস্ত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের কোনো তুলনা হয় না। তবে নিউইয়র্ক যে কোনো একটি শহর নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে। এর বার্ষিক বাজেট ১১২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের গড় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু শিক্ষা বিভাগের যে বাজেট (৩৮ বিলিয়ন ডলার), তা লাওসের মতো একটি দেশের জাতীয় বাজেটের বেশি।

নিউইয়র্কের ভোটাদাতাদের যে মানচিত্র, তা–ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার মানচিত্র থেকে একদম আলাদা। যেমন এই শহরের তালিকাভুক্ত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৬ ও ১০ শতাংশ। অথচ সারা দেশে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; ৩০ শতাংশ করে।

 তার চেয়েও বড় কথা, সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অশ্বেতকায়দের পরিমাণ প্রায় ৪২ শতাংশ, সেখানে নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই অশ্বেতকায় ও বহিরাগত।

বস্তুত, জনসংখ্যার গঠনগত দিকে দিয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহর অধিক বৈচিত্র্যময়। কুইন্স, যেখানে জোহরানের বাস, সেখানে ইংরেজি ভাষা ছাড়াও প্রায় ১৮০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়।

৪.

নিউইয়র্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিজস্বতা রয়েছে। এই শহরে প্রায় ৯ লাখ মুসলিমের বাস, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। মুসলিম সংখ্যার হিসাবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিকাগো, যার মোট মুসলিম জনসংখ্যা লাখ তিনেক।

জনসংখ্যার বৈচিত্র্যের বিচারে নিউইয়র্ক ও লন্ডন প্রায় কাছাকাছি। উভয়ের জনসংখ্যা প্রায় সমান সমান (৯ মিলিয়ন বনাম সাড়ে ৮ মিলিয়ন)। নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের ৩৭ শতাংশ বহিরাগত (অর্থাৎ তাঁদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে), তেমনি লন্ডনের বাসিন্দাদের প্রায় ৪০ শতাংশ বহিরাগত। মোট মুসলিম নাগরিকের সংখ্যার হিসাবেও এই দুই শহর কাছাকাছি; লন্ডনে রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ মুসলিম, নিউইয়র্কে ৯ লাখ।

লন্ডনের সঙ্গে নিউইয়র্কের তুলনা টানছি; কারণ, সেখানে বর্তমান মেয়র সাদিক খান পরপর তিনবার বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডন যদি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, তাহলে নিউইয়র্ক কেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানিকে তার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত করবে না?

৫.

নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্বে এন্ড্রু কুমো জোহরানের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। পরপর দুবার নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত কুমো স্বাভাবিকভাবেই নাম-পরিচিতির দিকে দিয়ে জোহরানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

তবে চার বছর আগে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় কুমো এই শহরের নারী ও বামঘেঁষা ভোটারদের কাছে নিন্দিত। তাঁরাই এখন জোহরানকে প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন।

নবীন ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করতেস জোহরানকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছেন। সেটি তাঁকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু ‘পুলসিরাতের শেষ ধাপ’ পার হতে হলে তাঁকে এই শহরের শক্তিশালী ইহুদি লবির বাধা পার হতে হবে।

বুঝিয়ে বলছি। জোহরান ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক। মুখ্যত ডেমোক্রেটিক পার্টির অসন্তুষ্ট প্রগতিশীল অংশের সমন্বয়ে গঠিত এই দল খোলামেলাভাবে নিজেদের সোশ্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে এদের রয়েছে মার্কিন মূলধারার বিপরীত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, অধিকৃত গাজায় এখন যা চলছে, তা স্পষ্ট জাতিহত্যা বা জেনোসাইড। তারা অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর মার্কিন সাহায্য প্রত্যাহারের পক্ষে, সেখানে যেসব মার্কিন সংস্থা নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে, তা তুলে নেওয়ারও পক্ষে।

ইসরায়েল প্রশ্নে জোহরানের এই অবস্থানের কারণে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ইহুদি লবির আপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ধরা যাক, নিউইয়র্কের প্রগতিশীল ভোটার, মুসলিমসহ অন্য অভিবাসীদের ভোটে জোহরান ২৪ জুনের ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জিতে গেলেন। সে ক্ষেত্রে নভেম্বরের চূড়ান্ত ভোটে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে একজন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। অনুমান করি, তাঁরা ইসরায়েলের সমালোচক ও ফিলিস্তিনের সমর্থক একজন মুসলিমকে কোনোক্রমেই এই শহরের মেয়র হিসেবে দেখতে চান না, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যা–ই হোন, একজোট হবেন জোহরানকে পরাস্ত করতে।

৬.

জোহরানের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে ব্রুকলিন থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি-আমেরিকান কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ। ২০২২ সালে এই শহরের প্রগতিশীলদের সমর্থনে শাহানা সহজ জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর পুনর্নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ইহুদি লবির বিরুদ্ধ-প্রচারণার মুখে পড়তে হয়েছে। গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে একজন ইহুদি প্রার্থীকে।

তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়ে বাছাইপর্বে তাঁর পরাজয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শাহানা নিজের অবস্থান বদলে নিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সমালোচনা থেকে সরে না এলেও এখন তিনি হামাসের সন্ত্রাসী হামলার কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছেন; পাশাপাশি নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধিতে কঠোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন।

৭.

জোহরান মামদানি গাজা প্রশ্নে এখনো অনড়। কিন্তু বাছাইপর্বে জিতে গেলে তাঁকে সম্মিলিত ইহুদি লবির মুখোমুখি হতে হবে। মোটেই বিস্ময়ের কিছু থাকবে না, যদি তিনি শাহানার মতো ইসরায়েল প্রশ্নে নিজের অবস্থান অধিক নমনীয় করে আনেন। তবে তা জয়ের জন্য যথেষ্ট কি না, সময়ই বলতে পারবে।

জোহরানের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাও বিবেচনায় রাখতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমান্বয়ে ডেমোক্র্যাটদের
সমর্থক-ভিতে অল্প অল্প করে ক্ষয় ধরিয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি যেখানে এই শহরে পেয়েছিলেন ২৩ শতাংশ ভোট, সেখানে ২০২৪ সালে তাঁর মোট ভোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।

অতিরিক্ত যে ৭ শতাংশ ভোট ট্রাম্প এই শহরে পান, তার একটা বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটাররা। এই ভোটাররা ট্রাম্প-সমর্থিত কোনো রিপাবলিকানকে ভোট না দিয়ে জোহরানকে কেন ভোট দেবেন—এমন প্রশ্নের জবাব আমরা এখনো পাইনি।

জোহরানের বিপক্ষে আরও কাজ করতে পারে অশ্বেতকায়দের ব্যাপারে শ্বেতকায় ভোটারদের দ্বিধা। তারপরও তিনি একজন মুসলিম, যাঁদের ব্যাপারে দেশটির অনেকেরই ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব রয়েছে।

এ মুহূর্তে প্রগতিশীল শ্বেতকায়দের সমর্থনে জোহরান হয়তো এগিয়ে, কিন্তু ভোটের সময় তাঁদের অনেকেই সিদ্ধান্ত বদলে একজন অশ্বেতকায় ও মুসলিমকে ভোট না দিয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ভোট দেবেন, সে সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না।

এই প্রবণতার নাম ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’। ১৯৮২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর নির্বাচনে জনমতে শ্বেতকায়দের সমর্থন পেয়ে এগিয়ে
ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী টম ব্র্যাডলি। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা গেল, প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে গেছেন।

মুখে এক কিন্তু কাজে ভিন্ন, শ্বেতকায় ভোটারদের এই ব্যবহারের নাম ব্র্যাডলি ইফেক্ট। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ঠকে যান আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী ডেভিড ডিনকিন্স। কারণ, ব্র্যাডলি ইফেক্ট। জোহরান মামদানি কি ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’ উতরে যেতে পারবেন?

হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প বল ক ন প র য ক তর ষ ট র র ন উইয়র ক স ট ন র ব চ ত কর ন উইয়র ক র প রগত শ ল ব ছ ইপর ব এই শহর র জনস খ য ইসর য় ল র প রথম অবস থ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ

৪ আগস্ট ২০২৪, শ্রাবণের শেষ বিকেল। ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন হাজারো ছাত্র-জনতা। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

ফ্লাইওভার এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হঠাৎ বিকট শব্দে গর্জে ওঠে মহিপাল এলাকা। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী, জাকির হোসেন শাকিব ও ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব। সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ছিলেন শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম। ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।

মহিপাল এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষ্য।

আরো পড়ুন:

‘এখন আমার মোবাইলে ওর ফোন আসে না’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু

শহীদ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘‘ও মাথায় আমার ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। এক বছর পরও আমরা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। মেয়েটা (শ্রাবণের বোন) ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথাও বলে না।’’ 

শহীদ ছাইদুল ইসলাম শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘‘শাহী বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল শহর থেকে ফেরার ভাড়া লাগবে। কিন্তু আর ফেরেনি।’’

শহীদ ওয়াকিল আহম্মদ শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘‘চুল কাটবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। হয়ত বুঝেছিল, এবারই শেষ দেখা। বুকের মধ্যে তিনটা গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।’’

মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। যারা জামিনে বের হয়ে আসে, তাদের অনেকে প্রভাবশালীদের সহায়তায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।’’ 
আহতদের একজন নূর হোসেন, তখন ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। উল্টো হামলার মুখে পড়তে হয়।’’ 

ঘটনার দিন ফেনী শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হয়। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে নেয়া হয় শ্রাবণের মরদেহ। একে একে আসতে থাকে অন্যদের মরদেহও। হাসপাতালে কান্নার রোল পড়ে যায়। মহিপালের হামলা ও হত্যার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। এ সব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জনের নাম রয়েছে। আরো ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ আছে। একমাত্র মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য। 

পুলিশ বলছে, ১৬৪ ধারায় ১১ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। 

৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে গুলি করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন যুবক মহিপাল প্লাজার সামনে রিকশা থেকে নেমে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার আশপাশে অনেকের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্র ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল গুলিবিদ্ধ।

সেদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও মারধর ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। অনেককে মোটরসাইকেল থামিয়ে মারধর করা হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল। এ দিন অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে ব্যাংক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘‘শহীদদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত। অথচ এখনো বিচার হয়নি। আমরা দাবি করছি, বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক।’’ 

ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি নিজাম হাজারীকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তারাই চার্জশিটে আছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বিদেশে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে।’’ 

ঢাকা/সাহাব/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভুল রেলস্টেশনে নামা তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় একজন গ্রেপ্তার
  • পাবনায় মসজিদের নির্মাণকাজ নিয়ে সংঘর্ষে আহত আরও একজনের মৃত্যু
  • গয়নার দোকান থেকে গুজবের বাজার—তামান্না অবশেষে মুখ খুললেন রাজ্জাক প্রসঙ্গে
  • নতুন পত্রিকা আনছেন রুপার্ট মারডক, নাম দ্য ক্যালিফোর্নিয়া পোস্ট
  • অনেক ইহুদি ভোটার জোহরানকে সমর্থন করছেন, একমত তাঁর গাজা ইস্যুতেও
  • ‘বেসবলে’ ৬৭৫০ স্বাক্ষর
  • আবুল হাসানকে নিয়ে নতুন গল্পগাছা ও পূর্বাপর
  • সরকারের কাছ থেকে ভোট আদায় করেই ছাড়ব: মির্জা আব্বাস
  • অচলায়তন ভেঙে সক্রিয় হওয়ার অপেক্ষায় কোয়াব
  • রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ