আপিল শুনানিতে আইনজীবী শরীফ ভূইয়া: তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো
Published: 21st, October 2025 GMT
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে সব রাজনৈতিক দল ও জনমতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে ১৯৯৬ সালে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, এটিকে বাতিল করা যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে এ কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার শুনানি গ্রহণ করেন। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল দিন রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪: ৩) রায় দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়, আদালতের রায়ের পর তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী এই সরকারব্যবস্থা বাদ দেয় শাসনতন্ত্র থেকে।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির করা পৃথক দুটি আপিল আজ শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা পৃথক আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এর ধারাবাহিকতায় পৃথক আপিল করেন পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির আপিলের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া। তিনি বলেন, সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও পরিণতি বিবেচনা করতে হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ চার বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলা হয়। অপর তিন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রয়োগে ভুল হয়েছে, সঠিক নীতিমালা প্রয়োগ না করায় ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছে, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর প্রতি আঘাত।
আইনজীবী শরীফ ভূইয়া আরও বলেন, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের গণতান্ত্রিক বা প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ফলাফল কী হয়েছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে দেশে আয়নাঘর, গোপন আটক ও নির্যাতন, গুম এবং ‘ডামি নির্বাচন’ হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ফলাফল কী দাঁড়াবে, তা বিবেচনায় না নিয়ে সংকীর্ণ ও টেকনিক্যাল ধারণার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং ফলাফল কোনো কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়নি সেই রায়ে।
সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে শুনানি শুরু হয়। মাঝে আধা ঘণ্টার মতো বিরতি দিয়ে বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত শুনানি চলে। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো.
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল সেই রায়। রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ। এ আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি আবেদন করেন। গত বছরের অক্টোবরে আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তারপর ওই মাসে আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর আরেকটি আবেদন করেন। এ ছাড়া একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে আপিল শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর শুনানির জন্য দিন রাখা হয়। এর ধারাবাহিকতায় আজ প্রথম দিনের শুনানি হলো।
এর আগে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ১৮ আগস্ট বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট আবেদন করেন। তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার মোফাজ্জল হোসেন গত বছরের অক্টোবরে একটি রিট করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে রুল হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল ঘোষণা করা হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ন ন র জন য আপ ল ব ভ গ র ২০১১ স ল র গত বছর র ব চ রপত ব এনপ র আইনজ ব ন কর ন আপ ল র আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্তের আগে কনডেমড সেলে নয়: লিভ টু আপিল শুনানি ২৮ অক্টোবর
বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল) রাখা যাবে না বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির জন্য ২৮ অক্টোবর দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ আজ রোববার এই দিন নির্ধারণ করেন।
এক রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যাবে না বলে গত বছরের ১৩ মে রায় দেন হাইকোর্ট। ঘোষিত রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে অন্য বন্দীদের মতোই দেখতে হবে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বা অন্য বন্দীদের নিরাপত্তার স্বার্থে, সংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্যগত বিষয়সহ ব্যতিক্রম পরিস্থিতির কারণে তাঁকে কনডেমড সেলে রাখতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে।
হাইকোর্টের সেই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত গত বছরের ১৫ মে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত সিপি (লিভ টু আপিল) করতে বলেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষ গত বছর নিয়মিত লিভ টু আপিল করে। আজ আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় লিভ টু আপিলটি ৩৮ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ।
পরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি মেনশন (উত্থাপন) করা হলে আপিল বিভাগ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন গঠিত বেঞ্চে ২৮ অক্টোবর শুনানির জন্য রেখেছেন।
বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত আসামিকে কনডেমড সেলে রাখার বৈধতা নিয়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে কনডেমড সেলে থাকা তিন আসামি ২০২১ সালে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি করে পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ গত বছরের ১৩ মে রায় দেন।
আরও পড়ুনকনডেমড সেলে কেন দুজন বন্দী রাখা হয় না?১৪ মে ২০২২