সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে আয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি বিষয়ে এখনও কাছাকাছি আসতে পারেনি। সংসদের উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এর অন্যতম।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন নিয়েও দলগুলোর ঐকমত্য হয়নি গত সপ্তাহে হওয়া চার দিনের সংলাপে। দুই দিনের বিরতির পর আজ রোববার আবার শুরু হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী সংলাপ। চলমান পর্ব ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ।
এ পর্যায়ে ঐকমত্যের সংজ্ঞা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য প্রকাশ পেয়েছে। কমিশন এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার কথাও ভাবছে।
গত সপ্তাহের সংলাপের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই বিষয়গুলোতে একদিকে বিএনপি এবং সমমনা পাঁচটি দল। তাদের কাছাকাছি অবস্থান বামপন্থি সিপিবি, বাসদের। বিএনপির বিপরীত অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বাকি দলগুলো। যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, জেএসডির অবস্থানও বিএনপির বিপরীতে।
নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবের বিপক্ষে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে বিএনপি এবং সমমনা এলডিপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট এবং ১১ দলীয় জোট।
চার দিনের সংলাপে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোট শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলে শর্ত সাপেক্ষে ঐকমত্য হয়েছে। যদিও জামায়াত বলেছে, শুধু অর্থবিল এবং আস্থা প্রস্তাব নয়, সংবিধান সংশোধনেও এমপিরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। বিএনপি বলেছে, যুদ্ধাবস্থায়ও দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না এমপিরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর বড় মতপার্থক্য চলছে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন এবং এনসিসি গঠনে। এ দুই বিষয়কেই মৌলিক সংস্কার বলছে ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি চায়, বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ আসন পাবে, ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষে তত আসন পাবে।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতিসহ ২৩ দল বলছে, নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে আসন বণ্টন হলে উচ্চকক্ষ কার্যকর থাকবে না। এ দলগুলো চায়, যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে তত শতাংশ আসন পাবে।
কমিশনের সুপারিশ মেনে এই দলগুলো চায়, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, ৫০ শতাংশ ভোটও পায়নি। উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৬৫-৬৬ শতাংশ ভোট পেতে হবে, যা অসম্ভব। ফলে ভবিষ্যতে সরকারি এবং বিরোধী দলের ঐকমত্য ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব না। বাংলাদেশে সরকারি এবং বিরোধী দলের ঐকমত্য আরও অসম্ভব। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় বিএনপি ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীতা দেখছে না।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা.
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ হলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ডাম্পিং গ্রাউন্ডে (ভাগাড়) পরিণত হবে।
২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ৪০-৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েও কোনো দল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ না হলে, বিজয়ী দল উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যখন, যেভাবে খুশি সংবিধান সংশোধন করতে পারেব।
সংলাপের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক সমাজের একটি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, উচ্চকক্ষের বিষয়ে বিএনপিকে রাজি করাতে মাঝামাঝি একটি অবস্থান নেওয়া হতে পারে। প্রস্তাব করা হতে পারে, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধন করা যাবে। বিএনপির দিক থেকে এ বিষয়ে নমনীয়তার ইঙ্গিত আছে বলেও জানায় সূত্র।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, বিএনপি আগের অবস্থানেই রয়েছে। সংবিধান সংশোধন সহজ রাখার প্রস্তাব পাননি। প্রস্তাব পেলে বিএনপি রাজি কিনা– এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আগে প্রস্তাব আসুক। বিএনপি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে অবস্থান জানাবে।’
আনুপাতিক উচ্চকক্ষে বিরোধিতার করে সালাহউদ্দিন বলেছেন, এতে সরকারি দল দেশ চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়বে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে উচ্চকক্ষে আইন পাস করাতে পারবে না। যেখানে অতীতে ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েও পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনার নজির আছে।
ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, এ ভাষ্য ঠিক নয়। নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা সরকার দল উচ্চকক্ষে যত কম আসনই পাক, সরকার পরিচালনায় আইন প্রণয়নে বাধা নেই। নিম্নকক্ষের পাস করা বিল উচ্চকক্ষ শুধু একবার ফেরত পাঠাতে পারবে। নিম্নকক্ষ বিলটি আবার পাস করলে, আর উচ্চকক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থাতেও সংসদের পাস করা বিল একবার ফেরত পাঠাতে পারেন রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয়বার পাসের পর রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিতে বাধ্য থাকেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার রাশ টানতে কমিশন প্রস্তাব করেছে, এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে।
এতে সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে দাবি করে বিএনপি এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করছে। দলটি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের আইনগুলো শক্তিশালী করার প্রস্তাব করেছে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২১টি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে।
সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিকে রাজি করাতে বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। কমিটি প্রস্তাব করেছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং সরকারি ও বিরোধী দলের বাইরের একজন এমপিকে নিয়ে এনসিসি গঠিত হবে। বিএনপি এতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে সাংবিধানিক নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাব সামনে আসতে পারে। আজ শুরু হওয়া সংলাপে কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা আছে। এ কমিশন শুধু নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখবে। এনসিসির মতো শক্তিশালী হবে না।
এ বিষয়ে জামায়াত নেতা ডা. তাহের সমকালকে বলেন, ঐক্যের জন্য জামায়াত ছাড় দিতে প্রস্তুত। তবে আগে প্রস্তাব আসুক।
ঐকমত্যের সংজ্ঞা নিয়ে মতানৈক্য
শুধু বিএনপি রাজি না হওয়ায় অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না– এমন প্রবণতার অভিযোগ তুলে একাধিক দল বলছে, একটি বিষয়ে কত দল একমত হলে, তা ‘ঐকমত্য হয়েছে’ বলে গণ্য করা হবে– এ ব্যাপারে কমিশনের ব্যাখ্যা থাকা উচিত। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, শিগগির এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
তবে কমিশন সূত্র জানাচ্ছে, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল যেসব বিষয়ে রাজি হবে, সেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। বড় দলগুলো একমত না হলেও তিন-চতুর্থাংশ দল একমত হলে ঐকমত্য হিসেব গণ্য করা হবে। যদিও বিএনপি এ সংজ্ঞায় রাজি নয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ঐকমত্য হতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ট র অন প ত স ল হউদ দ ন র প রস ত ব র ষ ট রপত ন ম নকক ষ ঐকমত য হ ব এনপ র অবস থ ন ষ র আসন প স কর বল ছ ন ক র পর সরক র গঠন র সদস য এনস প ইসল ম ক ষমত এনস স
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ ঘোষণায় শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন আর আস্থাহীনতার পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে এক সম্ভাবনাময় সন্ধিক্ষণে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর কয়েক মাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে চূড়ান্ত করেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এর ওপর ভিত্তি করেই ৫ আগস্ট ঘোষিত হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং তা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও সংলাপভিত্তিক ভবিষ্যতের নতুন সূচনা।
আলোচনা ও ঐকমত্যের কাঠামো
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মার্চ ২০২৫ থেকে দুই দফায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে। প্রথম পর্যায় (২০ মার্চ–১৯ মে): ৩৩টি দলের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় (২ জুন–৩১ জুলাই): ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ২৩ দিনব্যাপী ধারাবাহিক বৈঠকে। এ প্রক্রিয়ায় মোট ১৯টি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ইস্যুতে সম্মতির ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খসড়া প্রস্তুত হয়।
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দফা
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামতের সুযোগ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ,
নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষ গঠন ও ইলেক্টোরাল কলেজ চালু, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও পিএসসির নিয়োগে স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
আংশিক মতভেদ:
সব দল একযোগে সনদের সব দফা মানছে না। দলভেদে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা ১৯টির মধ্যে ১৫টি সংস্কারে একমত, তবে চারটি দফায় তারা সই দেবে না:
১. প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর বা
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) :উচ্চকক্ষে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছে।
২. প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত পদ বিলুপ্তি: একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান না থাকার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. দুদক ও পিএসসি নিয়োগে কমিটি গঠন: এটি ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙবে বলে তাদের মত।
৪. তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নির্বাচনে র্যাঙ্কড চয়েস: বিএনপি ‘সহজ গঠনমূলক নির্বাচন’ চায়, এই পদ্ধতিকে অকার্যকর বলে মনে করছে।
তবে তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে আংশিক সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে ‘আস্থা ভোট, নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন’ এ দলীয় অবস্থান বজায় রাখার শর্তে।
বাস্তবায়ন ছাড়া সই নয়
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্মত হয়েছে বেশিরভাগ সংস্কারে, তবে আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা ঘোষণাপত্রে সই দেবে না।
জামায়াত চায় নারী সরাসরি মনোনয়ন বাতিল করে সংসদে ১০০টি নারী আসন বাড়িয়ে প্রোপোরশনাল নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হোক।
এনসিপি নারী প্রতিনিধিত্ব ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় গণপরিষদ ভিত্তিক সাংবিধানিক সংশোধন কাঠামো। দুই দলই জোর দিয়েছে আইনি রূপ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ছাড়া সনদ কোনো অর্থ বহন করবে না।
জুলাই ঘোষণাপত্র
সরকার জানিয়েছে, ৫ আগস্ট বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ চত্বরে এক বিশেষ আয়োজনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা বলেছেন, ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলিল হবে, নাকি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসম্পন্ন সাংবিধানিক রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এ ঘোষণাপত্রটি যদি কেবল রাজনৈতিক অনুচ্চার প্রতিশ্রুতি হয়, তবে এর সাংবিধানিক গুরুত্ব থাকবে না। আমরা চাই, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হোক।”
ঘোষণাপত্রে কী আছে
খসড়া ঘোষণাপত্রে মোট ২৬টি দফা রয়েছে।
প্রথম ২১টি দফা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, গণআন্দোলনের ঐতিহাসিকতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিবরণ
শেষ ৫টি দফা: গুম-খুনের বিচারের অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি
এতে ২০২১–২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি রাখা হয়েছে।
বিকল্প পথে বাস্তবায়ন: আইন, অধ্যাদেশ, গণভোট?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণাপত্র কার্যকর করতে হলে থাকতে হবে একটি আইনি ভিত্তি। সম্ভাব্য ৩টি পথ:
১. রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ: জরুরি ভিত্তিতে এটি রূপান্তর করা যায়
২. সংসদীয় বিল: আলোচনা শেষে সংসদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে স্বীকৃতি
৩. গণভোট: জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ের মাধ্যমে সাংবিধানিক অনুমোদন
তবে এর কোনটি হবে, এখনো পরিষ্কার নয়। সরকার বা কমিশন এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা কাটাতে জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে তা বাস্তবায়নে একটি স্পষ্ট রূপরেখা দরকার।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “সবার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে। যারা বর্তমানে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ, তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “এটি ইতিহাসের এক মোড়লগ্ন মুহূর্ত। আমরা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে সনদ চূড়ান্ত করেছি, তা ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ।”
৫ আগস্টের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এতে থাকবেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা, নিহতদের পরিবার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে এই ঘোষণা কি কেবল অতীত স্মরণে একটি আয়োজিত মুহূর্ত, নাকি বাস্তব রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রাশিদুল হক বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ ও তার ভিত্তিতে প্রস্তুত ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। যতি এটি আইনি কাঠামোতে প্রণীত হয়। সব রাজনৈতিক দল সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তব বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। অন্যথায়, এই সনদ কেবল ঐতিহাসিক একটি প্রতীক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাহক হয়ে উঠবে না।”
ঢাকা/এএএম/ইভা