নাটোরে বাসচাপায় চারজন নিহত হওয়ার চার দিন পর চালক মামুনুর রশিদকে (৪০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের চকপাড়া থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নাটোরের ঝলমলিয়া হাইওয়ে থানার পুলিশ।

মামুনুর রশিদ রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভাংড়া গ্রামের আশরাফ আলীর ছেলে। আজ বুধবার আদালতে হাজির করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ঝলমলিয়া হাইওয়ে থানা সূত্রে জানা যায়, ২০ জুন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নাটোর শহরের বনবেলঘরিয়া এলাকায় নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে রাজশাহীগামী রাব্বী পরিবহনের একটি বাস বিপরীত দিক থেকে আসা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে অটোরিকশার চালকসহ চারজন নিহত হন। অটোরিকশার তিন যাত্রী গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা রাজশাহীর বানেশ্বের থেকে আম কিনে নাটোরে যাচ্ছিলেন। এ ঘটনার পর পুলিশ বাসটি আটক করতে পারলেও চালক পালিয়ে যান। পরে নিহত অটোরিকশাচালকের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা করেন।

হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, চালকের অবহেলায় চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। ঘটনাটি সারা দেশের মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে অভিযুক্ত চালককে গ্রেপ্তারে একযোগে মাঠে নামে। অবশেষে গতকাল রাতে র‍্যাবের সহযোগিতায় রাজশাহী থেকে চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ বুধবার তাঁকে আদালতে হাজির করা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

চাকরি পাচ্ছেন না গাজীপুরের কাজ হারানো শ্রমিকেরা, কী করছেন তাঁরা

এক যুগের বেশি সময় বেক্সিমকোর পোশাক কারখানায় চাকরি করেছেন মনির শেখ। চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় ঘুরেও চাকরি পাননি। বাধ্য হয়ে এখন সবজি বিক্রি করছেন। শুধু মনির শেখ নন, কাজ হারানো শ্রমিকদের অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।

চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় নতুন চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন মনির শেখ; কিন্তু যখনই কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, তিনি আগে বেক্সিমকোতে কাজ করেছেন, তখনই না করে দেয়। চাকরি জোটেনি; কিন্তু কিছু একটি তো করে পেট চালাতে হবে। সে জন্য এখন সবজি বেচে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

গত সপ্তাহের রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর চক্রবর্তী বাজার এলাকায় মনির শেখের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেক শ্রমিক পেশা বদল করেছেন; অনেকে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বাস্তবতা হলো ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ গাজীপুরের ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি শিল্পকারখানা নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। শিল্প পুলিশের তথ্যানুসারে, চাকরি হারিয়েছেন ৭৩ হাজার শ্রমিক। অনেক শ্রমিক আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন; সবজি বিক্রি, ফেরি করে পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।

যশোরের কোতোয়ালি থানার নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা জামাল হোসেন চক্রবর্তী এলাকায় মামুনের কলোনিতে ভাড়া থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আট-নয় বছর বেক্সিমকোতে কাজ করছেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। কিছুদিন হালচাষ করেছেন; কিন্তু সেই কাজ ভালো লাগেনি। এরপর স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে দুই মাস আগে নতুন চাকরি খুজেতে আসেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন চাকরি পাচ্ছেন না।

একই কলোনির ভাড়াটিয়া আনিসুর রহমান বলেন, ‘নতুন চাকরি না পাইয়া এখন ফেরি কইরা জিনিসপত্র বিক্রি করতাছি। সংসার তো চালাইতে অইবো—কী করমু কন।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থাভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিমুখী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা। বেকার হন এসব কারখানার ২৮ হাজার ৫১৩ শ্রমিক। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন শ্রমিকেরা।

গাজীপুর মহানগরের চক্রবর্তী এলাকায় বসবাস করে থেকে ১২ বছরের বেশি সময় বেক্সিমকোতে চাকরি করেছেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, কারখানায় যখন কাজ করেছেন, তখন স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। ছেলেকে কারখানা এলাকায় একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেও কাজ পাচ্ছেন না। এই মাসে (আগষ্ট) চাকরি না পেলে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবেন বলে পরিকল্পনা করছেন।

কলকারখানা, পরিদর্শন অধিদপ্তর ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু বেক্সিমকো নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত গাজীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ৪১টি। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিনস, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্ল্যাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ বিজিএমইএভুক্ত বড় ২০টি প্রতিষ্ঠান।

গত সপ্তাহের রোববার সকালে বেক্সিমকো কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আগের সেই চিরচেনা হইচই নেই। মানুষের আনাগোনা একেবারেই কমে গেছে। আগে যেখানে শ্রমিকদের ভিড়ে সড়কে হাঁটা কঠিন ছিল, সেখানে এখন নীরবতা নেমে এসেছে। শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে এলাকায় শত শত বাড়িঘর তৈরি করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। এখন প্রায় সব বাড়িতেই ঝুলছে ‘বাসা খালি আছে’ নোটিশ। অধিকাংশ বাড়িঘরই এখন খালি পড়ে আছে।

স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, আগে যেখানে সারা দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন সেখানে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। সারা দিনই বসে বসে কাটাতে হয়। আরেক ব্যবসায়ী শংকর চন্দ্র পাল বলেন, মাসের বেতনের সময় হলে কয়েক ভরি গয়না বিক্রি হতো, এখন বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। টিভি আর মুঠোফোনে ভিডিও দেখে সময় পার করছি।

চক্রবর্তী এলাকার বাড়ির মালিক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তাঁর কলোনিতে ৪৫টি কক্ষ আছে। আগে সব কক্ষেই ভাড়াটিয়া ছিলেন; কিন্তু এখন মাত্র সাতটি কক্ষে ভাড়াটিয়া আছে, বাকিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। এই অবস্থা এলাকার সব বাসায়। অনেকেই ব্যাংকঋণ নিয়ে বহুতল ভবন করেছেন। তাঁরা এখন ব্যাংকের ঋণও দিতে পারছেন না।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। কারখানার শ্রমিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নতুন চাকরি পাচ্ছেন না। পরে বাধ্য হয়ে এখন চন্দ্রা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় হলেও পেশা মনমতো হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে যাদের চাকরি চলে গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই বেকার, অধিকাংশই গ্রামে ফিরে গেছে। অনেকেই ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এখনো যাঁরা কাজ করছেন, সেই সব শ্রমিকের মধ্যে ছাঁটাই আতঙ্ক আছে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ অনেকটাই কমেছে। তবে এখন কিছু কারখানায় নানা ধরনের জটিলতা আছে। যে কারণে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন। আগে থেকেই টের পেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হচ্ছে। ফলে সেভাবে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে না।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে,  বন্ধ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই কাজ না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল ও আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ