নির্বাহী বিভাগের গুরুত্ব বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান কাজ ও জটিল পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কার্যকর নেতৃত্ব দেওয়া এখন নির্বাহীর অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু একই সঙ্গে এই বাড়তি নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। গবেষকেরা বলেন, নির্বাহী ও আইন পরিষদের মধ্যে সম্পর্কই সরকারের মূল সংযোগ। এই সম্পর্ক জাতীয় রাজনীতির চরিত্র, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাহীর প্রভাব রাজনৈতিক কাঠামো, গণতন্ত্রের ধরন ও জরুরি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়ে থাকে।

ওয়েস্টমিস্টার পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই কেন্দ্রীয় চরিত্র। যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা প্রায় একই রকম ক্ষমতা ভোগ করেন, যদিও ক্ষমতা প্রয়োগের ধরনে পার্থক্য আছে। অনেক সময় সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এই বাড়তি ক্ষমতা শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা গেলেও সেটি গণতন্ত্রের ভারসাম্য ও জবাবদিহির জন্য হুমকি হতে পারে।

কে এম মহিউদ্দিন তাঁর বইটিতে সংসদীয় শাসনে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা কীভাবে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, মন্ত্রিসভার সম্মিলিত দায়বদ্ধতা কীভাবে ক্ষীণ হয়ে পড়ছে এবং এতে গণতন্ত্রের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বইটির শুরুতেই লেখক আলোচ্য বিষয়ের পরিসর ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। এরপর তিনি ১১টি অধ্যায়ে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরেছেন: প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্য বনাম মন্ত্রিপরিষদের সম্মিলিত নেতৃত্ব, প্রধানমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতার পরিধি, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, প্রধান নির্বাহীর কার্যালয়ের ভূমিকা, সাংবিধানিক কাঠামোতে জবাবদিহি, নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে দায়বদ্ধতা এবং শেষ অধ্যায়ে এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসেবে হাইব্রিড গণতন্ত্রের মধ্যে একনায়কতন্ত্রের উত্থান।

লেখকের মূল যুক্তি হচ্ছে যদিও সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হয়, বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীই হয়ে উঠেছেন সর্বত্র ক্ষমতাধর। ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের যৌথ নেতৃত্ব ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং একক নির্বাহী ক্ষমতা বাড়ছে।

বইয়ের আকর্ষণীয় অংশ হলো এই ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের পেছনে কাঠামোগত উপাদানগুলোর বিশ্লেষণ—যেমন দলীয় রাজনীতির ধরন, নেতৃত্বপূজা, নির্বাচনী কৌশল, পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি, সংবিধানের বাইরে গিয়ে ক্ষমতার ব্যবহার, বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করা, জবাবদিহির অভাব ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব। এসব উপাদানের ভিত্তিতে লেখক দেখিয়েছেন—সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেই কীভাবে এক ‘রাষ্ট্রপতি-ধাঁচের’ প্রধানমন্ত্রী তৈরি হয়েছে।

তবে বইটি সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। লেখকের বিশ্লেষণ যতই গভীর হোক, কিছু ক্ষেত্রে তা পূর্বনির্ধারিত বা ‘ডিটারমিনিস্টিক’ বলে মনে হতে পারে। অনেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সংসদীয় কাঠামোর অন্যান্য ভারসাম্য রক্ষাকারী ব্যবস্থাগুলোর বিশ্লেষণ কিছুটা উপেক্ষিত হয়েছে।

তবু বইটিকে সমসাময়িক সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ, চিন্তাশীল ও তথ্যসমৃদ্ধ পর্যালোচনা বলা যায়। এটি একদিকে যেমন একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতার প্রতি সতর্ক করে, তেমনি গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির প্রতি নতুন করে প্রতিশ্রুতি তৈরির আহ্বান জানায়।

বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, সেখানে এই বই গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হতে পারে। সংসদীয় কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষায় বিভিন্ন পক্ষের পর্যালোচনা ও মতামতের আলোচনায় এই গ্রন্থ চিন্তার খোরাক জোগায়। তাই নীতিনির্ধারক, গবেষক, সচেতন নাগরিক এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রচর্চার শিক্ষার্থীদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য। লেখকের অন্তর্দৃষ্টি ও বিস্তারিত গবেষণা ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মন্ত্রিপরিষদ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সরকার: গণতন্ত্রের ভেতরেই একনায়কতন্ত্রের উত্থান

কে এম মহিউদ্দিন 

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ 

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা

মূল্য: ৭০০; পৃষ্ঠা: ৩২৮ 

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র র র ভ রস ম য ব যবস থ ক ষমত র র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

নেতৃত্ব কেন উদাসীন থাকবে

সম্প্রতি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছেন।

যেকোনো রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় গঠনতন্ত্র ও নীতি-কর্মসূচির ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা দেশবাসীকে গণতন্ত্রের সবক দিতে যতটা উদ্‌গ্রীব, দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন। তারেক রহমানের এ বক্তব্যে যদি সেই উদাসীনতা কাটানোর সদিচ্ছা প্রকাশ পায়, আমরা স্বাগত জানাই।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এর বাইরে অনেক অনিবন্ধিত দল আছে, যারা নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। আশা করি, নির্বাচন কমিশন দ্রুততম সময়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকুক আর না-ই থাকুক, তাদের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। তারা যে জনগোষ্ঠীর সমর্থন চায়, তাদের আস্থা অর্জন করতে হয়। মানুষ দলটির নীতি-আদর্শের পাশাপাশি নেতৃত্ব গঠনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও দেখতে চাইবে। বিশেষ করে দলটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি কতটা মেনে চলছে, সেসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি কম থাকায় এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন প্রতিটি দলের সব স্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়, যা ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো দলই সেই শর্ত পূরণ করেনি। বাংলাদেশে কিছু দল আছে, তারা নারী নেতৃত্বের ঘোর বিরোধী। তারা কমিটিতে নারীর উপস্থিতি দেখতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব দল দশকের পর দশক নারী নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেসব দলও এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই। এ কারণে কোনো দলের কোনো স্তরে ১০ শতাংশ নারী নেতৃত্বের দেখা পাওয়া যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়ে ২০২০ সালের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়।

যে রাজনৈতিক দল জনগণকে নেতৃত্ব দেবে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তাদের কর্মকাণ্ডে কেন জবাবদিহি থাকবে না। একনায়ক পদ্ধতিতে দল পরিচালিত হওয়ার পরিণাম কতটা বিপজ্জনক হয়, তার প্রমাণ আমরা নিকট অতীতে কিংবা তারও আগে বহুবার পেয়েছি। তারপরও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মানসিকতার দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে, এমন দাবি করা যাবে না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে দলে গণতন্ত্রায়ণের কথা বলেছেন, সেটি সব রাজনৈতিক দলের জন্যই প্রযোজ্য। প্রতিটি দল পরিচালিত হতে হবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। সেই সঙ্গে যেসব দলের গঠনতন্ত্রে দলীয় প্রধানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পরিবর্তন করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকেও দলে গণতন্ত্রায়ণের বিষয়টি সামনে আসে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ মুহূর্তে সেই সুযোগ না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব গঠনের কাজটি এগিয়ে নেওয়া।

বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা যখন দলে গণতন্ত্র সংহত করার কথা বলেছেন, তখন সেই দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা কতটা মজবুত, দলটির নেতৃত্বের উচিত সেটা খতিয়ে দেখা। বিএনপির তৃণমূল স্তরে যে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে, তার জন্য নেতৃত্ব গঠনের দুর্বলতাও কম দায়ী নয়। যে দলটি ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে চাইছে, সেই দলটির নেতৃত্ব দলের গণতন্ত্রায়ণের বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি
  • জুলাই সনদে এক বিন্দু ছাড় নয়: নাহিদ
  • গণমানুষের পক্ষে পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্বাধীনতা–উত্তর গ্রুপ থিয়েটার
  • নেতৃত্ব কেন উদাসীন থাকবে
  • ইসি অভিযান থেকে রাহুলদের আটক, পরে ছেড়ে দিল পুলিশ