মা ও শিশুর অনুপুষ্টির জোগানে এমএমএস: বিদ্যমান অবস্থা ও সম্ভাবনার পথ
Published: 23rd, July 2025 GMT
অংশগ্রহণকারী
শামস এল আরেফিন
ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, মাতৃ ও শিশু শাখা, আইসিডিডিআরবি
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)
তসলিম উদ্দীন খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসএমসি
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, মাতৃ ও শিশু পুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
আসফিয়া আজিম
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল
সুবীর খিয়াং
টেকনিক্যাল এক্সপার্ট – হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড গভর্নেস, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট
নীলিমা আজাদ
প্রকল্প সমন্বয়কারী, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভমড নিউট্রিশন (গেইন)
যতন ভৌমিক
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
আফসানা হাবিব শিউলী
প্রধান, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
সঞ্চালনাফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনাআফসানা হাবিব শিউলী
প্রধান, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
একজন গর্ভবতী নারীর সুস্থতা শুধু তাঁর নিজের নয়, গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ বিকাশের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সময় নারীর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কিলোক্যালরি অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়। এর পাশাপাশি আয়রন, ফলিক অ্যাসিডসহ অন্তত ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজের চাহিদা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এসব উপাদান সন্তানের অঙ্গ গঠন, স্নায়বিক বিকাশ, মস্তিষ্কের উন্নয়ন, জন্মের সময় ওজন ও দৈর্ঘ্য ঠিক রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারা আফ্রিকার প্রজননক্ষম নারীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই একাধিক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতিতে ভোগেন। এই ঘাটতি শুধু মায়ের জন্য নয়, গর্ভস্থ শিশুর জন্যও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। অনেক সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়, নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম হয় কিংবা জন্মের পর নানা জটিলতায় পড়ে। এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্ট বা এমএমএস।
ভ্রূণের বিকাশের প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদান দরকার হয়। গর্ভাবস্থার শুরুতেই রক্তনালির গঠনের জন্য কিছু পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এরপর ভ্রূণের আকার ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরির সময় আরও কিছু ভিটামিন-খনিজের চাহিদা তৈরি হয়। মাঝামাঝি সময়ে স্নায়বিক বিকাশ ও পুষ্টি সঞ্চয়ের জন্য নির্দিষ্ট উপাদান দরকার হয়। শেষ ধাপে শরীরের টিস্যু গঠন ও সামগ্রিক শারীরিক কাঠামো তৈরিতে পুষ্টির গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। প্রতিটি এমএমএস ব্যবহারে শিশুর উচ্চতা, ওজন, মাথা ও বাহুর পরিধি তুলনামূলকভাবে বেশি হয়, যা তার ভবিষ্যৎ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রচলিত পুষ্টিসহায়তা হলো আইএফএ (আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড) সাপ্লিমেন্ট। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, এমএমএস আইএফএর তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। এতে থাকে আয়রন, ফলিক অ্যাসিডসহ ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ উপাদান, যা গর্ভাবস্থার অতিরিক্ত পুষ্টি চাহিদা পূরণে সক্ষম। ১৭টি গবেষণা ট্রায়াল ও ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারীর ওপর পরিচালিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যবহারে কম ওজন নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকি ১২ শতাংশ কমে এবং শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ২৯ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভবতী নারীদের জন্য গবেষণাভিত্তিক পটভূমিতে এমএমএস ব্যবহারের সুপারিশ করে।
তবে এমএমএস নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা এখনো প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন, এটি গর্ভাবস্থায় শিশুকে ‘অতিরিক্ত বড়’ করে তোলে এবং প্রসবের সময় সিজারিয়ানের ঝুঁকি বাড়ায়। আবার পরিবার বা স্বামীও অনেক সময় গর্ভবতী নারীর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে বাধা দেন। সম্প্রতি হেলেন কেলার বাংলাদেশ ট্রান্সফরমিং লাইভস থ্রু নিউট্রিশন প্রকল্পের অধীনে এমএমএস পুরুষ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে একটি গবেষণা করেছে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, এই সামাজিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, পুরুষ সদস্যদের সচেতনতা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার জরুরি। গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরামর্শ প্রদান, পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা ও ক্যাম্পেইন পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হলে এমএমএসকে সরকারিভাবে মাতৃস্বাস্থ্য সেবার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
ইতিমধ্যে বিশ্বের ৪৬টি দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া, ইথিওপিয়া, সিয়েরা লিওনে এমএমএসকে মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বুরকিনা ফাসো, মাদাগাস্কার, সিয়েরা লিওন, নাইজেরিয়ায় এমএমএসকে জাতীয় ওষুধের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশেও এমএমএস নিয়ে গবেষণা ও বাস্তবায়নের কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে। আমরা বর্তমানে বাস্তবায়নের দ্বিতীয় ধাপে অবস্থান করছি। এখন দরকার দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। এমএমএসের উপকারিতা সম্পর্কে পরিবার, স্বাস্থ্যকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের সচেতন করে এর ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণ করা জরুরি।
শামস এল আরেফিন
ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, মাতৃ ও শিশু শাখা, আইসিডিডিআর বি
বাংলাদেশে চিকিৎসা-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা প্রদানকারী কর্তৃক গর্ভকালীন সেবা বা অ্যান্টেন্যাটাল কেয়ারের (এএনসি) কাভারেজ ৮৮ শতাংশ হলেও এর একটি বড় অংশ ৭২ শতাংশ, পরিচালিত হয় বেসরকারি খাতে। সুপ্রতিষ্ঠিত বড় হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে ছোট ছোট ক্লিনিকও এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্গত। তাই মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্ট (এমএমএস) বিতরণের ক্ষেত্রে এই জটিলতা মাথায় রেখে নকশা করতে হবে।
সরকার সাধারণত নিজস্ব উৎপাদিত ক্রয়কৃত পণ্য নিজেদের চ্যানেলেই বিতরণ করতে চায়। কিন্তু যদি বিতরণ কেবল সরকারি চ্যানেলে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা দিয়ে জাতীয় কাভারেজ অর্জন করতে পারবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যাটারনাল নিওনেটাল চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথ (MNC&AH) প্রোগ্রাম, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ম্যাটারনাল, চাইল্ড, রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথ (MCRAH) প্রোগ্রাম এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর সবাই মাতৃ ও প্রসবকালীন সেবার সঙ্গে যুক্ত। এই তিন প্রতিষ্ঠানকেই এ বিষয়ে নিজস্ব প্রকিউরমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
আইএফএর (আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড) পরিবর্তে এমএমএস আসা উচিত এবং এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। এই দুটি একসঙ্গে থাকার কোনো কারণ নেই। এমএমএসকে আইএফএর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ এবং এমএমএস উৎপাদনে বিনিয়োগের রূপরেখা নির্ধারণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এসএমসির প্রতিনিধির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এমএমএসের প্রতি কোর্সের দাম প্রায় ৬ ডলার। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ মিলিয়ন নারী গর্ভধারণ করেন। যার অর্থ বছরে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এটি বাংলাদেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের খুবই ক্ষুদ্র অংশ। তাই এটি সরকারের সামর্থ্যের বাইরে নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমএমএস সংক্রান্ত সুপারিশটি শর্তসাপেক্ষ। আমরা এটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন করতে পারব কি না এবং এর কার্যকারিতা কেমন হবে, তা দেখতে হবে। সরকার যদি ঘোষণা করে যে তারা সবাইকে এমএমএস দেবে কিন্তু প্রয়োজনীয় অন্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
অধ্যাপক ডা.
ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)
গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মা সব পুষ্টি শিশুর কাছে বিলিয়ে দেন। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় মা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, কিন্তু তার শিশু ততটা রক্তস্বল্পতায় ভোগে না। যদিও গুরুতর রক্তস্বল্পতা থাকলে শিশুরও সমস্যা হয়। তাই মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সত্যি বলতে আমরা অনেকেই এমএমএস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতাম না। তবে আপনাদের উপস্থাপনা থেকে জানতে পারলাম বাংলাদেশে এমএমএস-অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিশ্রুতি হয়েছে ২০২৪ সালের মে মাস থেকে। এই তথ্যটি জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
আমি সব সময়ই একটি কথা বলি, শুধু আমাদের জানলে হবে না, আমাদের সমাজকেও জানাতে হবে। অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সারা দেশে ৩ হাজার ৫০০ পোস্টগ্র্যাজুয়েট সদস্য এবং ১৯টি শাখা রয়েছে। এই শাখাগুলোর মাধ্যমে আমরা এমএমএস সম্পর্কে জ্ঞান সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারব। ঐতিহ্যগতভাবে আমরা প্রথমে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড, তারপর আয়রন-ক্যালসিয়াম দিয়ে থাকি। কিন্তু এমএমএস সম্পর্কে জানার পর প্রশ্ন আসে, কেন মায়েরা এখনো অপুষ্টিতে ভুগছেন? কেন স্টানটিং বা শিশুরা খর্বাকৃতির হচ্ছে? কেন স্টিলবার্থ বা গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যু হচ্ছে?
আপনাদের উপস্থাপনায় দেখেছি, এমএমএস ব্যবহারের ফলে স্টিলবার্থ ৮ শতাংশ কমেছে এবং স্টানটিং ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে। এটি আমাদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। আমি মনে করি আয়রন-ফলিক অ্যাসিড নাকি এমএমএস—এই বিতর্ক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এখন সময় এসেছে সবাইকে এমএমএস দেওয়ার কথা বলার।
যতই সুষম খাদ্য গ্রহণ করা হোক না কেন এমনকি সচ্ছল ব্যক্তিরাও ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদানের অভাবে ভোগেন। শরীরে ১৫টি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং বিভিন্ন ভিটামিন (এ, বি২, বি৩, বি৬, বি১২, সি, ডি, ই) প্রয়োজন। এমএমএস নিশ্চিত করবে যে মা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করছেন এবং এর ফলে পুষ্টির অভাব কমবে।
আমি মনে করি যেটুকু ঘাটতি আপনারা গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন, তা পূরণের জন্য কভারেজ বৃদ্ধি এবং সবাইকে এমএমএসের আওতায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। একজন মা যদি জানতে পারেন যে এই ওষুধ তাঁর জন্য এবং তাঁর শিশুর জন্য উপকারী তবে তিনি অবশ্যই এটি গ্রহণ করবেন।
তসলিম উদ্দীন খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি)
আমরা প্রায় কয়েক দশক ধরে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ব্যবহারকেই সমাধান মনে করতাম। কিন্তু যখন এমএমএস এল, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড পুরোপুরি সমাধান নয়।
জাতীয় পুষ্টি সেবা (এনএনএস) থেকে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৪৯ বয়সী নারীদের ৪৪ শতাংশেরই জিংকের ঘাটতি রয়েছে। তাঁদের ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে ৭১ শতাংশ। আবার এসব মায়ের মধ্যে রক্তশূন্যতা আছে ৩০ শতাংশের। আয়োডিনের অভাব আছে আরও ৩০ শতাংশের। সুতরাং এই যে বড় একটা অংশের অণুপুষ্টির অভাব আছে, এটি আমরা আগে সেভাবে অনুভব করতে পারিনি।
ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স, সি, ডি, ই, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, আয়োডিন, জিংক, কপার, সেলেনিয়ামসহ ১৫টি ভিটামিন ও মিনারেলের পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে ক্যালসিয়ামের। এটি করা গেলে গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের আর পুষ্টির ঘাটতি হবে না।
এ ক্ষেত্রে আইসিডিডিআরবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আইসিডিডিআরবি এর কমপ্লায়েন্স দেখেছে এবং সেখানে ইতিবাচক কিছু বিষয় আছে। এসব নিয়ে আমরা খুব শিগগির হয়তো বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা দেখতে পাব।
আমরা পার্টনারশিপের মাধ্যমে এমএমএস নিয়ে কাজ শুরু করি। সেখানে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুরুতে এটা ছিল ব্যবসায়িক মডেল। এটি ফার্মেসিসহ অন্যান্য জায়গায় পাওয়া যায়। আমরা সাড়ে তিন বছরে ১০০ মিলিয়ন ট্যাবলেট বিক্রি করেছি। এক মিলিয়ন গর্ভবতী মা আমাদের এ ট্যাবলেট গ্রহণ করেছেন।
গর্ভকালীন সেবা বা অ্যান্টেন্যাটাল কেয়ার (এএনসি) সেবার সঙ্গে সামগ্রিক উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন এবং সেখানে কিশোরীদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে মাত্র ৪১ শতাংশ গর্ভবতী মা চারটি অ্যান্টেন্যাটাল কেয়ার (এএনসি) সেবা পান। আমাদের অবশ্যই গাইনোকোলজিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা না হলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না।
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে চাইলে মাকে সুস্থ রাখতে হবে। দুর্গম এলাকা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনা মূল্যে এমএমএস দিতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যিকভাবেও এমএমএস বিক্রির ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাদের সামর্থ্য রয়েছে, এমন পরিবারগুলো কিনে খায়। আমরা মনে করি, বিনা মূল্যে বিতরণ সাময়িক সময়ের জন্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি কোনো সমাধান নয়। এটি করা গেলে আমরা ভবিষ্যতে অন্য রকম বাংলাদেশ দেখতে পাব।
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, মাতৃ ও শিশু পুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ
গর্ভকালীন মায়ের কী কী পুষ্টি দরকার? এ ক্ষেত্রে এমএমএস কীভাবে সহায়ক হতে পারে? গর্ভাবস্থা নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হলেও এটি পুষ্টির দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি সময়। এই সময়ে বৈচিত্র্যময় ও নির্দিষ্ট পরিমাণে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ এবং পুষ্টি-সম্পর্কিত যত্ন অত্যন্ত জরুরি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা গর্ভবতী নারীদের জন্য মোট ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সম্পন্ন এমএমএস গ্রহণের সুপারিশ করে, যা গর্ভবতী নারীদের পুষ্টির মান উন্নত করতে কার্যকর একটি উপায়। এটি মায়ের অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতা হ্রাসে সহায়তা করে, ফলে জন্মের সময় কম ওজনের শিশুর জন্মের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং প্রি-টার্ম বার্থের হার কমাতে সহায়তা করে, একই সঙ্গে, ভ্রূণের সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করে এবং ভবিষ্যতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করেছে—তা হলো, দেশভিত্তিক প্রমাণ ও প্রেক্ষাপটভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ করে, যেসব দেশে দীর্ঘদিন ধরে গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রসবপূর্ব আয়রন ফলিক অ্যাসিড সম্পূরক (IFA) ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেসব দেশের জন্য আইএফএ থেকে এমএমএসে স্থানান্তরের সম্ভাব্য প্রভাব গভীরভাবে মূল্যায়ন করা জরুরি। এ ছাড়া থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মায়েদের ওপরে এর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, এই স্থানান্তরের প্রভাব শুধু মাতৃ, প্রসবকালীন ও শিশুর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ফলাফলের ওপরই নয়, বরং এমএমএসের কার্যকারিতা ও টেকসই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এর ন্যায্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা, স্থায়িত্ব ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কেও স্থানীয় পর্যায়ে গবেষণা, পাইলট প্রকল্প ও পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে এখনো অনেক নারীর পুষ্টিগত ঘাটতি রয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সেখানে সরকারকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত এমএমএস নিয়ে জরিপ পরিচালনা করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ ধরনের জরিপ দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা, পুষ্টিগত চাহিদা চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি মূল্যায়নের জন্য অপরিহার্য তথ্য সরবরাহ করবে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)—বিশেষ করে এসডিজি–২ ও এসডিজি–৩ অর্জনে সরকারকে আরও কার্যকরভাবে সহায়তা করবে। (অনলাইনে দেওয়া লিখিত বক্তব্য)
আসফিয়া আজিম
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল
নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল সরকারের সঙ্গে কাজ করে। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রোগ্রামে সরকারকে সহায়তা করে থাকি। আমি সম্ভাবনার দিকে নজর দিতে চাই। মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টসের (এমএমএস) ভূমিকা নিয়ে আমরা সবাই জানি এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে, এমএমএস সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। এ জন্য সরকার যে পদ্ধতিতে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড (আইএফএ) ট্যাবলেট বিতরণ করেছে, সে পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।
পাশাপাশি আইএফএর পরিবর্তে যদি এমএমএস দেওয়া শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের সব নারীই এর সুবিধা পাবেন। বিশেষ করে প্রান্তিক, বঞ্চিত, হতদরিদ্র, ঝুঁকিতে থাকা নারী ও যাঁদের ক্রয়ক্ষমতা নেই, তাঁদের অণুপুষ্টির চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, তা ভাবনার বিষয়। এটা যদি সরকার গ্রহণ করে, তাহলে আমরা আমাদের সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সুস্থ ও সবল জাতি পাব।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি নারী একবার অ্যান্টেন্যাটাল কেয়ার (এএনসি) সেবা নেন। আর বড় একটা অংশ সরকারি পর্যায়ে প্রথম এএনসি সেবা নিতে আসেন দ্বিতীয় সেবার সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর। ফলে তাঁকে আইএফএ কিংবা এমএমএস যা–ই দেওয়া হোক না কেন, নির্ধারিত ডোজ সম্পন্ন হয় না। সুতরাং এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, আমরা আইএফএকে এমএমএস দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চাইছি। অথচ আমাদের আইএফএর ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি আছে।
পুরো গর্ভাবস্থায় সুপারিশকৃত এমএমএস ডোজ হচ্ছে ১৮০টি ট্যাবলেট। এতে খরচ হয় প্রায় ৭০০ টাকা। যদি সরকারিভাবে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মাধ্যমে এমএমএস উৎপাদন করা হয়, তাহলে এর খরচ অনেকটাই কমে আসতে পারে। অর্থাৎ সরকার যদি নিজেরাই এমএমএস তৈরি করে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এটি উপজেলা ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, তাহলে এর দাম কিছুটা কমে আসতে পারে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এমএমএস খুব ভালো ফল দেয়। এটি গর্ভবতী মায়েদের খাওয়ানো গেলে অনেকগুলো সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। গর্ভবতী নারী ও নবজাতকের ওপর এর প্রভাব ইতিবাচক।
সুবীর খিয়াং
টেকনিক্যাল এক্সপার্ট—হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড গভর্ন্যান্স, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট
হাঙ্গার প্রজেক্ট দুই বছর যাবত ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর সাসটেইনেবল নিউট্রিশন’ নামে একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় আমরা ৫০টি ইউনিয়নে কাজ করছি। রংপুরের গঙ্গাছড়া উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন, পত্মীছড়ায় ১১টি ইউনিয়ন, রাজশাহীর মোহনপুরে ৪টি ইউনিয়ন, ময়মনসিংহ সদরে ৭টি ইউনিয়ন, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে ৫টি ইউনিয়ন, খুলনার বটিয়াঘাটায় ২টি, বাগেরহাটের শরণখোলায় ৪টি ও ফকিরহাটে ৮টি ইউনিয়ন। আমাদের সহযোগী হচ্ছে রেনেটা।
আমরা মায়েদের ‘মাতৃকণা’ নামক এমএমএস ও শিশুদের ‘পুষ্টিকণা’ নামে বিতরণ করছি। গত বছর আমরা ১০ হাজার মা ও ৫ বছরের নিচে ৬ হাজার শিশুকে এমএমএস বিতরণ করেছি। আমাদের জরিপ বলছে, ৯৭ শতাংশ মা মাতৃকণা গ্রহণ করার পর তাঁদের শরীরে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। আর বাকি ৩ শতাংশের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা গর্ভধারণসংক্রান্ত জটিলতার মতোই। আর ৫ বছরের কমবয়সী যেসব শিশুকে আমরা পুষ্টিকণা দিয়েছি, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পুষ্টিকণা খাবারটা শিশুরা বেশ উপভোগ করেছে, যা ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়। আমরা মূলত কাজ করেছি ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন (আইপিএইচএন) ও কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের সঙ্গে। পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্য থেকে আমরা এমএমএস (মাতৃকণা ও পুষ্টিকণা) বিতরণ করেছি।
আমরা এই প্রকল্পের শুরুতে জরিপের মাধ্যমে মায়েদের নির্বাচন করেছি, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তাঁদের সঙ্গে কিশোরী ও শাশুড়িরাও আছেন। আমরা তাঁদের গর্ভধারণসংক্রান্ত ১১টি সেশনের ওপর পাঠদান করছি। স্থানীয় নারীরাই আমাদের স্বেচ্ছাসেবক। এই নারী কর্মীদের মাধ্যমে আমরা মায়েদের কাছে পৌঁছাই। যাঁদের আয় দশ হাজার টাকার কম বা যাদের প্রথমবার প্রসব হচ্ছে, কিংবা যাঁরা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিয়েছেন, এমন মায়েদের আমরা নির্বাচন করছি। এরপর আমরা তাঁদের বিনা খরচে হিমোগ্লোবিন, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করছি।
আমরা ৮টি উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে জরিপ করে দেখতে পেয়েছি, যেসব মায়ের প্রথম সন্তান মিসক্যারেজ হয়েছে বা কম ওজনের হয়েছে, তাঁরা এমএমএস গ্রহণের পর অনেক ভালো ফল পেয়েছেন। তাঁদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বেড়েছে, বিএমআই বেড়েছে, স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
নীলিমা আজাদ
প্রকল্প সমন্বয়কারী, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)
এমএমএসের উপযোগিতা ও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি অবগত। তবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার কি এটি গ্রহণ করবে, করলে কীভাবে করবে? আমরা যদি সরকারের কাছে একটি ব্যবসায়িক মডেল বা অন্য যেকোনো মডেলের মাধ্যমে এমএমএস পৌঁছে দিতে পারি, তবে সেটি গর্ভবর্তী মায়েদের জন্য একটি বড় সুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা চাই সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হোক যেখানে আইএফএর পাশাপাশি এমএমএসও অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
দ্বিতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় এমএমএস ছিল এবং পুষ্টিসম্পর্কিত তৃতীয় কর্মপরিকল্পনায়ও এটি থাকবে বলে আশা করা যায়। আশা করি, সরকার তার পরবর্তী নীতিমালায় বিনা মূল্যে বিতরণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও যুক্ত করবে। এর ফলে গর্ভবর্তী মায়েদের কাছে এমএমএস পৌঁছানো সহজ হবে।
২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত নিউট্রিশন ফর গ্রোথ (এনএফজি) সম্মেলনে প্রথমবারের মতো পুষ্টির আলোচনায় বেসরকারি খাতের বিষয়টি আসে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ২৯ থেকে ২১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদি আমরা এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, তাহলে এমএমএস নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, এটি শুধু গর্ভধারণের ফলাফলেই সাহায্য করবে না, বরং একজন মায়ের রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধেও অত্যন্ত কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য অ্যাসেম্বলিতেও কম ওজনের নবজাতক কমানোর বিষয়টি আমাদের অগ্রাধিকার হিসেবে এসেছে।
আমরা ইতিমধ্যে ১০ লাখ মায়ের কাছে এমএমএস বিক্রি করতে পেরেছি। আমাদের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে মায়ের সঙ্গে সরাসরি ফোন যোগাযোগ করা হয়, সেখানে দেখা গেছে ৪৫ শতাংশ মা ৯০টির বেশি ট্যাবলেট গ্রহণ করেছেন। যদি আমরা আরও বেশি চাহিদা তৈরি করতে পারি, তবে এটি বাড়ানো সম্ভব। ২১ শতাংশ মা ১৮০টি ট্যাবলেট কিনছেন। যখন আমরা ধারাবাহিকতা নিশ্চিত কর,ব তখন এটি রক্তস্বল্পতার ওপর প্রভাব ফেলবে এবং কম ওজনের নবজাতকের জন্মহার কমাতে সহায়তা করবে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বা অন্য দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, সেখানেও এটি অন্তর্ভুক্ত থাকুক। পরিশেষে বলতে চাই, এসএমসির পাশাপাশি আমরা গেইন থেকে এসেনশিয়াল ড্রাগস লিস্টে এমএমএস অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।তৃতীয় কর্মপরিকল্পনায়ও এটি থাকবে বলে
যতন ভৌমিক
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, ট্রান্সফর্মিং লাইভস থ্রু নিউট্রিশন , হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল
এমএমএসের কার্যকারিতা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক স্টাডি ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বেশ ভালোভাবে হয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকেরা একমত হয়েছেন যে আয়রন ফলিক অ্যাসিডের (আইএফএ) পরিবর্তে এমএমএস ব্যবহারে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফলাফল (ইমপ্যাক্ট) আসবে।
গর্ভবতী কোনো মা যদি ছয় মাস প্রতিদিন একটি করে এমএমএস ট্যাবলেট খান, তাহলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি যে তাঁর অণুপুষ্টির অভাব হবে না। কারণ, এতে ১৫টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান আছে। তাই পেশাদার, বিশেষজ্ঞ, গবেষকসহ সবাই এমএমএসের কার্যকারিতা সম্পর্কে একমত।
হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ট্রান্সফর্মিং লাইভস থ্রু নিউট্রিশন
প্রকল্পের মাধ্যমে এমএমএস বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য যোগাযোগ কৌশল এবং পুরুষদের অংশগ্রহণের বিষয়ে একটি গবেষণা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যার ফলাফল অচিরেই সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে শেয়ার করবে। এখন বাংলাদেশ সরকারের মাতৃস্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজে এমএমএস অন্তর্ভুক্ত করার কর্মকৌশল নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। পাশাপাশি সরকারের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় এমএমএস অন্তর্ভুক্ত করে বিতরণের কৌশল নির্ধারণ বিষয়ে ভাবতে হবে। অন্যান্য সফল কার্যক্রমের যেমন মিসোপ্রোস্টল এবং ক্লোররহেক্সিডিনের অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণা অনুযায়ী প্রথমে এমএমএসের পলিসি করতে হবে, তারপর কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। আর সর্বশেষে তা বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। সরকারকে এমন কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেখানে এমএমএস মাতৃস্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
দ্বিতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় এমএমএস অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আমরা আশা করি পুষ্টিভিত্তিক তৃতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনাতেও এটি স্থান পাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রামে এমএমএস অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই এমএমএসকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার একটা রোডম্যাপ করা খুব জরুরি। এ বিষয়ে সরকারি–বেসরকারি, এনজিও, ডেভেলপমেন্ট পার্টনার, সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করতে হবে। সরকারের সেবাকেন্দ্রগুলো ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে কীভাবে এই কার্যক্রমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগে এমএমএস বাস্তবায়নে সফলতা আসবে বলে আমি মনে করি।
সুপারিশতৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করতে এমএমএসকে সরকারিভাবে মাতৃস্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দুর্গম এলাকা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনা মূল্যে এমএমএস প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
এমএমএসকে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের (আইএফএ) বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
এমএমএসের উপকারিতা সম্পর্কে পরিবার, স্বাস্থ্যকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের সচেতন করে এর ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণ করা জরুরি।
এ উদ্যোগ টেকসই করতে অবশ্যই গাইনোকোলজিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পুষ্টি সম্পর্কিত তৃতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় এমএমএস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রয়োজন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র দ র জন য আইস ড ড আর ন শ চ ত কর প রকল প র সরক র র স ব তরণ কর কম ওজন র আম দ র স ট য বল ট শ র জন য শ শ র জন ব তরণ ক ক র যকর ব সরক র ব যবস থ সহ য ত রক র য ক জ কর র জন ম উপ দ ন পর চ ল পর ব র জন ম র পর য য ন করছ দরক র সমস য র ওপর র একট ন করত প রথম ফল ফল ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।