যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তিবিষয়ক তৃতীয় দফার আলোচনা কবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে চলতি জুলাই মাসের মধ্যে তা না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। আলোচনার জন্য দেশটির কাছে বারবার সময় চেয়েও না পাওয়ার কারণে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। লবিস্ট নিয়োগের ব্যাপারেও তাঁরা হাল প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ আগস্ট কার্যকর হয়ে যাবে পাল্টা শুল্কের হার। এরপরও অবশ্য আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তৃতীয় দফার আলোচনার ব্যাপারে আশাবাদী। আলোচনা করতে ১ আগস্টের আগেই বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে যাবে বলে গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ আলোচনা থেকে ভালো একটা ফলও নিয়ে আসা যাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে। নতুন শুল্কহার কার্যকরের সময় আরেক দফা বাড়তেও পারে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এদিকে পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করতে লবিস্ট নিয়োগের সম্ভাবনাও এখন প্রায় শূন্যের কোটায় বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সরকারের মনোভাবও নেতিবাচক। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, লম্বা সময় নিয়ে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সাধারণত লবিস্ট নিয়োগ করা হয়। এখানে যা করতে হবে, জলদি করতে হবে। লবিস্টদের দিকে ইঙ্গিত করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দর-কষাকষি দূরের কথা, তাঁরা তো ঢুকতেই পারবেন না ওই অফিসের কাছাকাছি।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভালো আছে বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির বকেয়া পরিশোধ করে দেওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি ও মেটলাইফের বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ইউএস চেম্বার আমাকে চিঠি লিখেছে।’
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে পাল্টা শুল্ক (৩৫ শতাংশ) আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সে হার কিছুটা কমাবে বলে আশাবাদী সালেহউদ্দিন আহমেদ। আশাবাদী হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘাটতি তো খুব কম। ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। তার বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। আর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করেছিল ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য।
পাল্টা শুল্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি, লবিস্ট নিয়োগ ইত্যাদি নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক ও নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাতে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নতুন করে বৈঠকে বসেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, যেখানে ছিলেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ।
এ কে আজাদ গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগ হবে না বলে ধরে নিচ্ছি। চেষ্টা চলছে। তবে এখন তা করেও কী লাভ হবে, বুঝতে পারছি না।’ তিনি বলেন, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশ্বাস দিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত ভালো কিছুই হবে।
বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে গম আমদানি
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি গম আমদানির একটি প্রস্তাব গতকাল অর্থনৈতিক বিষয়–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। একই দিন দেশটি থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয় সরকারি ক্রয়–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে।
এ দফায় বাংলাদেশে গম রপ্তানির কাজ পেয়েছে অ্যাগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। কোম্পানিটি ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটসের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বলে ক্রয় কমিটিকে জানায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি টন গমের দাম পড়ছে ৩০২ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ গমের প্রতি টনের দাম ৮১৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা একটু বৈচিত্র্য আনতে চাচ্ছি। অনেক সময় রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে অনিশ্চয়তা দেখা যায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন আমাদের আমদানি বৃদ্ধির দর-কষাকষি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের গমের মানও ভালো।’
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম যে তুলনামূলক বেশি, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দাম একটু বেশি হলেও অন্যদিক দিয়ে সুবিধা পাওয়া যাবে। তাদের গমে আমিষ কিছুটা বেশি। খুব বেশি তা নয়, একটু বেশি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন আহম দ গম আমদ ন গতক ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।