Prothomalo:
2025-07-29@21:17:06 GMT

আমি এইখানে নাই

Published: 24th, July 2025 GMT

অনেকক্ষণ যাবৎ একটা মুহূর্তের ভেতর বসে থাকলে সময়কে যতটা ধীর মনে হয়, সেই ধীর সময়ের ধারণা কোনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একইভাবে সময়কে দ্রুত মনে হলেও কোনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেটা বুঝে ওঠা যায় না। রোমাঞ্চিত হৃদয়ের কাছে সময়ের ধারণা তাই বরাবরই গোলমেলে।

ব্যাপারটা আমি বুঝেছি ওর দেওয়া ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে। ফাসট্র্যাক ব্র্যান্ডের ঘড়ি। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, নতুন ঘড়ি, তাই কি দ্রুত চলছে? মনে মনে হাসলাম। হাসতে হাসতেই মনে হলো, ব্র্যান্ড নামের সঙ্গে সংহতি রেখে দ্রুত চলার সম্ভাবনাটুকুও একদম অমূলক নয়।

খণ্ডমুহূর্তের অন্তরালাপ যে হাসি হাসাল আমাকে, সে হাসি দেখেনি ও। সন্ধ্যা পড়ে এসেছে।

বলল, ‘আলো কমেছে। চলো, আরও যতটুক যাওয়া যায়!’

কতটুক যাওয়া যায়, এ প্রশ্নে ঘুম ভাঙল আমার। প্রশ্নটা আমার নয়, আমার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে আভার। ঘুমঘোরে প্রশ্নের প্রথম অংশটা শুনতে পাইনি।

আভা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সাগরের তলদেশে অক্সিজেন ছাড়া কত দূর যাওয়া যায়?’ সত্যি কথা বলতে, এর উত্তর আমি জানি না। এসব আচমকা প্রশ্ন নিয়ে আভা প্রায় হাজির হয়। যেমন আলোর গতির বিপরীত দিকে যাওয়া সম্ভব কি না কিংবা শব্দ দিয়ে কীভাবে সমুদ্রতলের গভীরতা মাপা হয়—এসব ইত্যকার প্রশ্ন! এ–জাতীয় তথ্য-তত্ত্ব-ব্যাখ্যার জবাব ওর বাবাই দিতে পারে চটজলদি। ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই পারে, কিন্তু করবে না। আভার কেন জানি মনে হয়, তার ইউনিভার্সিটি প্রফেসর মা-ই সব জানে! আমি জামশেদকে ডাক দিলাম। সাড়া দিল না। বোধ হয়, শাওয়ারে।

জামশেদ বুয়েট থেকে পাস করে চাকরি করেনি, কারখানা দিয়েছে। সোডিয়াম সিলিকেট তৈরি করে। এক্সপোর্টও করছে ইদানীং। ফলে বেশ ব্যস্ততা।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে কাপড় পরছে যখন, আভার প্রশ্নটার কথা জানালাম। বললাম, ‘মেয়েটার সঙ্গে নাশতা খেতে খেতে আলাপ কইরো।’ জামশেদ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে আচমকা জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান আছে কি না আমার বা বিশেষ কোনো সাক্ষাৎ বা মোলাকাত?’

নাহ, বিশেষ কোনো সাক্ষাৎ বা অনুষ্ঠান কিছুই নেই। রাতের ঘুমানোর আগে মনে হলো বেগুনি শাড়িটা পরি। কালই ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময় প্রিয়াঙ্গন থেকে ব্লাউজটা তুলেছি। ব্লাউজটা থেকেই মনে হলো, আজ সকালে বেগুনি শাড়িটাই পরা যায়! এ জন্যই রাতে বের করে রাখা।

যত ব্যস্তই থাকুক, জামশেদ খুব অবজারভেন্ট। বোধ হয় আমার ব্যাপারেই। মেয়ের খোঁজখবর রাখে ঠিকই। কিন্তু আমার ব্যাপারে যেভাবে খুঁটিনাটি ডিটেইল মনে রাখে, মেয়ের ক্ষেত্রে রাখে না। আমার ক্ষেত্রে আগ থেকে অনেক কিছুই আঁচ করতে পারে সে। সব সময় তার প্রেডিকশন যে মিলে যায়, তা কিন্তু নয়। যেমন আজকে। সে দেখেছে, কাউচের ওপর আমার শাড়ি-ব্লাউজ ইস্তিরি করে রাখা। ড্রেসিং টেবিলে নতুন টিপের একটা পাতা। সঙ্গে রাখা এক জোড়া রুপালি বালা। সবই কাল ব্লাউজ আনতে গিয়ে কিনেছি। কারও সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনা বা আনুষ্ঠানিক হাজিরা দেওয়ার বিষয় এখানে নেই।

তবে দাপ্তরিক হাজিরা তো আছেই। জামশেদ বেরোতে বেরোতে আমি বিছানা থেকে উঠে টেবিলে রাখা ছোট্ট মাউন্টবোর্ডটায় টাঙিয়ে রাখা ক্লাস রুটিন দেখে নিই। আজকে একটু দেরিতেই ক্লাস।

নাশতা করে সেজেগুঁজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের একটা ছবি তুলি। বড় বোনকে ছবিটা পাঠাব। মেজ বোনকেও পাঠাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ও চোখে দেখে না। এবারের ঈদে আমরা তিন বোন একই রকম শাড়ি কিনেছিলাম। বোনদের মধ্যে শাড়িবিষয়ক এই আদিখ্যেতা আমরা যারপরনাই উপভোগ করি।

ডিপার্টমেন্টে নিজের কক্ষে পৌঁছাই পৌনে নয়টায়। দরজা দিয়ে ঢুকেই রুমের দেয়ালঘড়িটা দেখা যায়। তাই সময়টা স্পষ্ট মনে আছে। অন্য সময় হয়তো থাকত না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আজ আমিও জামশেদের মতো অবজারভেন্ট হয়ে গেছি।

বেলা এগারটায় ক্লাস। ক্লাসের আগে আমি জুলিয়া ক্রিস্তেভার ‘পাওয়ারস অব হরর: অ্যান এসে অন অ্যাবজেকশন’ বইটা নিয়ে বসি। আজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এবজেকশনের কনসেপ্টটা নিয়ে আলাপ করব। মিসোজিনির সঙ্গে মিলিয়ে। কঠিন বাংলায় বললে, অপাঙ্ক্তেয় বোধ হওয়া। মানে এবজেকশনের কথা বলছি। সাধারণত আমরা তো জানি, বর্ণপ্রথায় উঁচু বর্ণের লোকেরা নিচু বর্ণের লোকদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করে। একই পাতে বসে খেতে চায় না। অচ্ছুত ভাবে। এই অচ্ছুত ভাবার প্রক্রিয়াটা কিন্তু দুই পক্ষকে দুইভাবে প্রভাবিত করে। উঁচু বর্ণ নিজেদের নিচু বর্ণ থেকে স্পষ্টত আলাদা করে ফেলে। আর নিচু বর্ণ এই অপাঙ্ক্তেয় বর্গটিকে আত্মস্থ করে শরীরে মগজে–মজ্জায় ধারণ করে। তারা ভাবে, তারা আসলেই হয়তো একই পাতে বসে খাবার যোগ্য নয়। কিংবা যুক্তিগতভাবে কখনো নিজেদের যোগ্য মনে করলেও হাজার বছরের প্রচলিত রীতির ফলে তাদের আচরণের মধ্যে এই অ্যাবজেকশন প্রোথিত হয়ে যায়। ফলে তারা সহজেই এই ‘অপাঙ্ক্তেয় বোধ’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।

ক্লাস লেকচারের ক্ষেত্রে আমি এই কাজ করি। শেষ মুহূর্তে আরেকবার ঝালাই করে নিই নিজের মধ্যে। নিজের মধ্যেই আলাপগুলো বিন্যস্ত করে নিই, যেন পরিপার্শ্ব সাপেক্ষে যেকোনো তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারি শিক্ষার্থীদের সামনে।

আভাকে যখন গর্ভে ধারণ করি, তখন আমি মন্ট্রিয়লে। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট ফর জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ফেমিনিস্ট স্টাডিজে ছয় ক্রেডিটের এমএ কোর্সে পড়ছি। তিন ক্রেডিটের আবশ্যিক ফেমিনিস্ট থিওরিজ অ্যান্ড মেথডস কোর্সের পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে জুলিয়া ক্রিস্তেভা পড়া শুরু করি। আভা জন্ম নেওয়ার পর তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতেও আমি ক্রিস্তেভা পড়েছি। আভাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমি ক্রিস্তেভা প্রস্তাবিত সাইকোসেক্সুয়াল বিকাশ সম্পর্কে এত গভীরভাবে বুঝেছি যে প্রতিবার এসব তত্ত্বকথা পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে আভার ছোটবেলার ছবিটা উদ্ভাসিত হয় আবার।

এই পর্যন্ত নোট নিয়ে আমারও একটু মনোযোগ বিচ্যুত হলো। চা খাওয়া প্রয়োজন। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু রুমে পানি আনা নেই। এ ছাড়া এই সাতসকালে কোনো অফিস কর্মচারীও নেই যে পানির বোতলটা ভরে এনে দিয়ে যাবে।

তাই নিজেই উঠলাম। মুখে একটু আলো–বাতাস লাগানো প্রয়োজন।

আমাদের ডিপার্টমেন্ট কলা ভবনের পঞ্চম তলায়। লম্বা করিডরটায় এসে দাঁড়ালে সামনের লনের বর্ষীয়ান কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছগুলো দেখা যায়।

আমি রুম থেকে বেরিয়েই থমকে যাই। খালি করিডরে একটা মাত্র লম্বামতো লোক। ধোপদুরস্ত ছাই রঙা রেমি কটনের একটা শার্ট ও কালো জিনস পরা। দেয়ালে সাঁটা ক্লাস রুটিন দেখছে।

আমি দরজা দিয়ে বেরোতেই আমার দিকে মুখ ঘুরাল। আমি ভূতগ্রস্তের মতো আঁতকে উঠলাম।

ছোটবেলায় স্লিপওয়াক করতাম। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো দরজায় গিয়ে বারবার বাড়ি খেতে খেতে ঘুমটা ভেঙে যেত প্রায়। ঘুম ভাঙার পর সম্বিত ফিরে পাওয়ার আগে আগে অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য ঠিক এ রকম অনুভূতি হতো আমার। বুক ধরফর করত। এখন আর এ ধরনের বুক ধরফরানি হয় না বহুদিন।

এই মুহূর্তে হচ্ছে।

এই করিডরে যে দুজন মাত্র লোক আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি, তারা পরস্পরের অবয়ব দেখি না আজ বারোটি বছর! সম্বিত ফিরে এলে বুঝতে পারলাম, তানসিরের শরীরটা এই বারো বছরে একটু ভারী হয়েছে। তবে ঠিক মোটা হয়েছে বলা যাবে না।

তানসিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম যে বাক্যটি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল তা হলো, ‘আমার তো ক্লাস আছে।’

‘রুটিনে দেখলাম দশটায়’, তানসির বলল।

আমি বললাম, ‘ক্লাস এক ঘণ্টা পেছানো হয়েছে। এগারোটায় ক্লাস।’

ও বলল, ‘তাহলে তো অনেক সময়। বেশি সময় নেব না।’

তানসিরকে নিয়ে আমার রুমে ঢুকলাম। টেবিলের এপাশটায় আমার চেয়ারে বসে মনে পড়ল, ওয়াটার বটলে পানি ভরার কথা ভুলে গেছি। টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটি আমার ডান পাশে, আমার আরও কাছে এনে তানসির বসে পড়ল।

মাথার ওপর প্রাগৈতিহাসিক ফ্যান ঘরঘর আওয়াজ করে ঘুরছে। আওয়াজটা অন্যদিন এতটা কানে লাগে না।

জিজ্ঞেস করল, ‘অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন না ধরার বাতিক আছে নাকি।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’ জানালাম, ‘এ ধরনের কোনো বাতিক আমার নেই। যেকোনো নম্বর থেকে ফোন এলেই ধরি।’

‘রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ ফোন দিয়েছে’, তানসির বলল।

আমি টেবিলের নিচের তাকটায় চার্জে দেওয়া ফোন চেক করি। পাঁচটা মিসড কল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘শেষে ট্রিপল থ্রি কি না।’

বলল, ‘হ্যাঁ। কালকেই নিয়েছি দেশে ফিরে।’

‘তানসির নিউ’ নামে সেভ করে রাখলাম নম্বরটা। এর আগে তানসির নামে যে নম্বরটি সেভ করা আছে, ওটা থেকে বারো বছর যাবৎ কোনো ফোন আসেনি। কিন্তু নম্বর রয়ে গেছে।

তানসির পকেট থেকে বের করে একটা আয়তাকার বাক্স রাখল। বলল, ‘তোর জন্য।’

আমি দেখলাম ওর দিকে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িটায় ওকে ঠিক মানাচ্ছে না। ভারিক্কি ভাবটার সঙ্গে এটা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির কোনো একটা সংযোগ থাকতে পারে।

বাক্সটা খুলে দেখি, ফাসট্র্যাকের ঘড়ি। তানসির জানে ফাসট্র্যাক ঘড়িবিষয়ক আমার সফোমোরিক অবসেশনের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে ও আমার সঙ্গে বহুবার গিয়েছে ফাসট্র্যাকের ঘড়ি কিনতে। ওর এক মামাতো ভাই তখন দিল্লি পড়ত। ছুটিতে ঢাকায় আসার সময় ওর মামাতো ভাইকে দিয়ে একটা ফাসট্র্যাক ঘড়ি আনিয়েছিল তানসির। সে ঘড়িটা এক রাতে জানালার পাশে রাখা পড়ার টেবিল থেকে চুরি করে নিয়ে গেছেন জনৈক চোর।

ঘড়ি চুরি হওয়া নিয়ে কান্না করব, এমনটা আমি ছিলাম না কখনোই। আত্মসম্মানবোধ আর ক্লাস কনশাসনেসের জায়গা থেকে আমি নিজেকে নিজে বুঝিয়েছিলাম, সামাজিক যে অর্থব্যবস্থা এবং সে সময়ে চলমান যে অর্থনৈতিক দুর্দশা নেমে এসেছিল ঢাকা শহরে, তাতে জনৈক লুম্পেন প্রলেতারিয়েত যদি জানলা দিয়ে মধ্যরাতে আমার ঘড়িটি নিয়ে পরবর্তী দিনের জন্য অন্নসংস্থান করতে পারে, তা হলে মন্দ কী!

এই কথা শুনে তানসির দুঃখ পাওয়ার বদলে হেসেছিল। বলেছিল, ‘পাতাখোর শালা!’

পাতাখোর বলতে যে গাঁজাখোরদের বোঝায়, এটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। এতে আমাদের গ্রুপের আরেক বন্ধু জামিল খুব চোট পেয়েছিল। গাঁজা খাওয়াটাকে এভাবে অপরাধের পর্যায়ে দেখতে সে নারাজ।

জামিল বলেছিল, ‘তোরা ইন্টারমিডিয়েটে উদ্ভিদবিদ্যাটা মন দিয়ে পড়লে বুঝতি ক্যানবিজ মূল ফুলপ্রধান গুল্ম।’

পাশ দিয়ে তখন এক ফুল বিক্রেতা হেঁটে যাচ্ছিল। জামিল ডাক দিল তাকে। ডেকে তার কাছ থেকে একটা গোলাপ নিল। তারপর পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো লম্বামতো কিছু একটা বের করল। কাগজের মোড়ক খুলে দেখা গেল, ওগুলো গাঁজা।

গোলাপ আর গাঁজা দুই হাতে নিয়ে জামিল বলেছিল, ‘শোনো, এই যে ফুল আর উইডের মধ্যে আসল ডিফারেন্সটা হইল আমাদের জাজমেন্ট।’

আমরা সবাই হু হু করে হেসেছিলাম। ঘড়ি চুরির বিনিময়ে আমাদের মধ্যকার এই হাস্যরস আমাকে কান্নার কথা ঘূর্ণাক্ষরেও মনে আনায়নি সেদিন।

কিন্তু আজ বেশ কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চোখে একগাদা বাষ্প জমে আছে।

আমি তানসিরকে বললাম, ‘জীবনে যে সময় আমার তোর সময় সবচেয়ে দরকার, তখন তুই সময় না দিয়ে এই বারো বছর পর এসে সময় দেখার ঘড়ি দিচ্ছিস?’

তানসির চুপ করে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পর জিজ্ঞেস করে, ‘নিবি না তাহলে?’

আমি বাক্স থেকে ঘড়িটা নিয়ে হাতে পরি। ঘড়িতে এখন দশটা বেজে দশ মিনিট।

তানসির ওঠার আগে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্লাস শেষে কী করছি?’ জানালাম, ‘দুইটায় আভাকে স্কুল থেকে তুলতে যাব। তিনটায় টিচার্স মিটিং আছে। চারটায় শেষ হবে।’

ও রুম থেকে বেরোনোর সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা দমকা বাতাসে দরজাটা খুলে গেল। বাতাসে আমার লেখা নোটগুলো সব উড়ে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণের সময় আমরা ফিল্ম ক্লাবের সবাই মিলে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত কাগজ আর স্টাইরোফোম কেটে সাজসজ্জার জিনিসপত্র তৈরি করছিলাম। আমাদের তখন দ্বিতীয় বর্ষ। তানসির আসার কথা সেই সকালে। কিন্তু দুপুর পেরিয়ে গেলেও কোনো খোঁজ নেই ওর।

ওই সময় হুট করে ক্লাবের দরজা খুলে জামিল ঢুকেছিল। ভেবেছিলাম, তানসির এসেছে। জামিল আচমকা দরজা খোলাতে নকশা করা কাটা কাগজগুলো বাতাসের ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গেল।

ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার সময় যে ফোনটি কিনেছিলাম, সপ্তাহখানেক আগে সদলবলে চানখাঁরপুলে কালাভুনা খেতে গিয়ে ফেলে রেখে এসেছি। পরে আর সেই ফোনটির হদিস মেলেনি।

জামিলের ফোন থেকে বার কয়েক ফোন দিলাম তানসিরকে। ফোন বন্ধ পেলাম। কোনো বিপদ ঘটেছে কি না চিন্তা হতে লাগল।

দুপুরে জামিল জোর করে খাওয়াতে নিয়ে গেল মিলন চত্বরে। গত দুই বছরে কতবার দুপুরে তানসিরকে ছাড়া খেয়েছি, আঙুল গুনে বলা যাবে। কিন্তু সেসব দিনে আগে থেকেই জানতাম, দুপুরে আমাদের দেখা হচ্ছে না। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা কিংবা আমাদের কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে আটকে যাওয়া ছাড়া এমন ঘটনা আগে ঘটেনি।

তানসির, আমি আর জামিল একসঙ্গে থাকতাম সব সময়। জামিল মাঝেমধ্যে সিনথিয়াকে দেখলে আড্ডার মাঝখান থেকে উঠে চলে যেত। এমন হতো যে লাইব্রেরির বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছি আমরা তিনজন। সিনথিয়া সামনে দিয়ে হাকিম চত্বরের দিকে গেল ফটোকপির দোকানে। সঙ্গে সঙ্গে সুরসুর করে উঠে চলে গেল জামিল। গিয়ে কী করল? স্রেফ ঘুরঘুর করল। সিনথিয়া যতক্ষণ ফটোকপি দোকানের সামনে আছে, ততক্ষণ ফটোকপি দোকানের মামার সঙ্গে হয়তো বেহুদা আলাপ জুড়ে দিল। এই ছিল জামিল। আমি আর তানসির লাইব্রেরির বারান্দায় বসে বসে হাসলাম; হয়তো সন্ধ্যা হতে হতে বাসার দিকে রওয়ানা দিতাম।

তানসির প্রতিদিনই আমার সঙ্গে আমার বাসা পর্যন্ত আসত। মা–বাবা অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে আমরা হয়তো ছাদে যেতাম।

ইস্টার্ন হাউজিংয়ের নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলো সবে দাঁড়ানো শুরু করেছিল তখন। আমরা শান্তিনগরের মোড়ের ইস্টার্ন অ্যাপার্টমেন্টসে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতাম সে সময়। ছাদ থেকে বেশ বিস্তৃত ঢাকা শহর দেখা যেত।

আমার একটা আইওয়া ওয়াকম্যান ছিল। আর তখনকার হেডফোনগুলো ছিল হেডব্যান্ড মডেলের। এয়ারফোন তখনো অতটা জনপ্রিয় হয়নি। আর আমার আইওয়া ওয়াকম্যানের হেডব্যান্ড হেডফোনের ফ্রেমটা ছিল নমনীয় স্টিলের। আমি আর তানসির একসঙ্গে গান শোনার জন্য সেই ফ্রেমটা একটু বাঁকিয়ে ছড়িয়ে নিয়েছিলাম। তারপর দুজন পরস্পরের কাছাকাছি বসে হেডফোনের একটা অংশ আমার বাঁ কানে আর অন্য অংশটি ওর ডান কানে লাগিয়ে একসঙ্গে গান শুনতাম। মনে আছে, তখন সিডি সাউন্ডের ফিতা ক্যাসেটে রেকর্ড করা ব্রায়ান এডামসের ‘অন আ ডে লাইক টুডে’ অ্যালবামটি এলিফ্যান্ট রোডের ‘রেইনবো’ থেকে কিনেছিলাম।

ইস্টার্ন হাউজিংয়ের পনেরো তলার ছাদের ওপরে আরেক চিলতে ছাদ ছিল আমাদের। ওখানে বসে ঢাকা শহরে সন্ধ্যা নামা দেখতাম। বড় সড়কগুলোতে সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করলে আমাদের কানে বেজে উঠতে ব্রায়ান এডামসের ফ্যাসফ্যাসে অথচ লিপ্ত গলার ‘ক্লাউড নাম্বার নাইন’।

ওদিন তানসির ক্যাম্পাসে এল সন্ধ্যায়। সঙ্গে ছিল ফারহানা। ফারহানা হলিক্রসে আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল। আমরা একসঙ্গে ডিবেটিং ক্লাব করতাম। আমাদের পূর্বপরিচিতি সৌজন্য সম্ভাষণে আমাদের পরস্পরের মুখে একটা মেকি হাসি ফুটিয়েছিল। দুপুরে মিলন চত্বরে তেলতেলে খিচুড়ি খেয়ে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে উচ্ছ্বসিত হাসিটা ঠিক হাসতে পারছিলাম না।

তানসির জানাল, তার দুই বছর আগে যে প্রেমসম্পর্কে ছেদ পড়েছিল, সেটা আজকে আবার দৈবক্রমে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। তার এই প্রেম বিষয়ে আমি জামিল দুজনই আগে থেকে জানতাম। কিন্তু ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত জানতাম না। ওদিন জানলাম। তার সেই নাম না-বলা গোপন প্রেমিকাটি আমার পূর্বপরিচিত ফারহানা।

পেটের অস্বস্তিটা অসহ্য আকার ধারণ করেছিল। আচমকা বমি করে দিয়েছিলাম। জামিল এসে ধরেছিল আমাকে।

শত চেষ্টা করলাম ক্লাসে মনোযোগী হতে। নোটগুলো ধরে ধরে জুলিয়া ক্রিস্তেভার ‘অ্যাবজেকশন’ কনসেপ্টটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বুঝানোর চেষ্টা করলাম, মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ কীভাবে সিস্টেমেটিক অ্যাবজেকশন বলবৎ রাখে সমাজে। কীভাবে একটা রীতিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় নারী পরিচয়ের মধ্যে বিচ্যুতি বোধের ধারণাটি মজ্জাগতভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের মনমরা লাগছে আজ। আমি হয়তো ঠিকঠাক বুঝাতে পারছি না ওদের। আমার নিজেরও আজকে একটু খাপছাড়া লাগছে। মনে হচ্ছে, কী যেন বাদ দিয়ে গেলাম। বাদ দিয়ে গেলাম বলেই কি বুঝতে পারছে না ছাত্রছাত্রীরা?

পেছনের সারি থেকে থ্রি কোয়ার্টার পরা ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাম, আপনি কি রেডিওহেডের “ক্রিপ” গানটা শুনেছেন?’

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। হঠাৎ রেডিওহেড কেন! আমি অবশ্যই রেডিওহেড শুনেছি। তানসির রেডিওহেড শুনতে পছন্দ করত না। কিন্তু আমি করতাম।

ছেলেটা বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি যখন “অ্যাবজেকশন’ বুঝাইতেছিলেন, আমার মাথার মধ্যে রেডিওহেডের “ক্রিপ” গানটার কোরাস পার্টটা বারবার মনে আসতেছিল—“আ’ম আ ক্রিপ, আ’ম আ উইয়েডো, হোয়াট দ্য হেল আ’ম ডুয়িং হেয়ার, আই ডোন্ট বিলং হেয়ার!” ম্যাডাম, এই যে “আই ডোন্ট বিলং হেয়ার” ফিলিংসটাই কি অ্যাবজেকশন?’

আমি ছেলেটার দিকে থম মেরে তাকিয়ে থাকলাম। ওর নাম মাশরুর। আজকে তিন দিন পর ক্লাসে এসেছে। ভাবছিলাম, ওকে একটা আচ্ছামতো ঝাড়ি দেব। কিন্তু আজকে কেন যেন ঝাড়ি দেওয়ার মুডে নেই। তার ওপর এই সে এত দারুণ একটা প্রসঙ্গ টেনে আনল; সত্যিই অবাক হলাম।

সবাইকে রেডিওহেডের ‘ক্রিপ’ গানটা শুনে ব্যক্তিগত অনুভূতি লিপিবদ্ধ করে আনার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। টিচার্স পার্কিং স্ট্যান্ডে গাড়ি রাখা ছিল। রাসেল গাড়িতেই ছিল। এই ছেলেটা আজ সাত বছর আমাদের গাড়ি চালাচ্ছে।

নীলক্ষেত দিয়ে বেরোতে জ্যামে পড়লাম। মাঝেমধ্যে আমারও মনে হয়, আই ডোন্ট বিলং হেয়ার। এইটা আমার জায়গা না। এখানে আমি থেকেও থাকি না। এইখানে আমার আসলেই কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি আছি অন্য কোথাও…

১০

মাস্টার্সের ভাইবার দিন আমার গায়ে হলুদ ছিল। ভাইবা দিয়ে বেরোতে গিয়েই পড়ি দারুণ বিপাকে। সড়ক অবরোধ! প্রমাদ গুনছিলাম, ভয়ংকর জ্যামট্যাম যেন না লাগে।

নবীনবরণের পর থেকে তানসিরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ শিথিল হয়ে যায়। আমি ফিল্ম ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করে দিই। ডিপার্টমেন্টে বেশি সময় দিতে থাকি। সেমিনারে থাকি। জার্নাল পড়ি। লাইব্রেরিতে যাই। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করি বিভিন্ন প্রজেক্টে। যে দুটি বাচ্চাকে পড়তাম, মানে টিউশনি করাতাম, তাদের পড়ানোও বন্ধ করে দিই। কারণ, সময় কুলাতে পারছিলাম না। পড়াশোনা নিয়ে একটা দারুণ নেশা ধরে গিয়েছিল। থার্ড ইয়ার থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ক্লাস শেষ হলে কলা ভবন অঞ্চল থেকে সোজা শান্তিনগরের রিকশা নিতাম।

আমার অনার্স শেষ হওয়ার পরপর বড় আপুর বিয়ে হয়, সেনাকুঞ্জে। মাহতাব ভাইয়া তখন বেশ চৌকস আর্মি অফিসার। সুদর্শন আবার অমায়িক। আর্মি অফিসারদের মতো রুক্ষ লোক উনি নন। আপু আর মাহতাব ভাইয়ার সঙ্গে স্টেজে ছবি তুলতে উঠে জামশেদের পায়ে ধাক্কা লেগে আমি স্টেজ থেকে পড়ে যাই।

জামশেদকে আমি ঠিক চিনতাম না। ওই দিনই চিনেছি। মাহতাব ভাইয়ের ছোট ভাই রিফাতের বন্ধু। জামশেদ বেশ যত্নআত্তি করল আমার। খুব লজ্জিত হলো আমার এই পড়ে যাওয়ায়। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমার পড়ে যাওয়ার বাতিক আছে। আমার চোখের কাছে, হাতে, কনুইতে বিভিন্ন কাটা দাগ দেখালাম।

জামশেদের দিকে এক গাল হেসে বললাম, ‘জি, এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার! প্রতিবার নতুন নতুন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। আজ আপনার সঙ্গে পরিচয় ঘটল। আচ্ছা, আপনি কি ডাক্তার?’

‘না, ইন্টারমিডিয়েটে আমি বায়োলজি বাদ দিছিলাম, যেন ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে না হয়’, বলল জামশেদ।

আমি বললাম, ‘যাক, বাঁচা গেল। এবারের পড়ে যাওয়া অন্তত অন্য পেশার লোকের সঙ্গে পরিচয় ঘটাল।’

আমরা হাসলাম খুব।

জামশেদ তখন বুয়েট থেকে পাস করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চাকরি নয়, চাকরি সে করতে চায় না।

মাস্টার্সের দিনগুলোতে জামশেদ আমাকে নিতে আসত। প্রায় যে তার সঙ্গে বের হওয়া হতো, তা নয়। যেতাম মাঝেমধ্যে। জামশেদ খেতে পছন্দ করত। আমার অত খাওয়াদাওয়া পছন্দ না। কিন্তু নতুন নতুন রেস্তোরাঁগুলো জামশেদ না থাকলে আবিষ্কার করা হতো না, এটা সত্যি কথা।

আমাদের বিয়েটা যথাসময়ে হলো না। ওই দিন বিডিআর ক্যাম্পে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। বিডিআর কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল, তাদের ওপর বছরের পর বছর ধরে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। তাই তারা বিডিআরে নিযুক্ত সামরিক বাহিনীর লোকজনকে বিডিআর ক্যাম্পে আটকে হত্যা করে। মিডিয়ায় লোকজন বলতে থাকল, এই বিদ্রোহ একটা ভারতীয় চক্রান্ত। সরকারেরও হাত আছে এর সঙ্গে। সরকার ভারতীয়দের সঙ্গে চক্রান্ত করে এ দেশের সামরিক বাহিনিকে নিজেদের জিম্মায় আনতে চাইছে। চারিদিকে নানা শঙ্কা!

সেই থমথমে অবস্থায় বিয়েটা পেছাল। জামশেদের ফরেন ইনভেস্টরদের সঙ্গে একটা পূর্বপরিকল্পিত মিটিং ছিল সিয়াটলে। প্ল্যান ছিল বিয়ে শেষ করে আমিসহ সিয়াটল ঘুরে আসব। জামশেদ সেবার একাই গেল।

১১

বিয়ের আগে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ‘মনপুরা’ দেখে বেরোতে গিয়ে তানসিরের সঙ্গে বহুদিন পর দেখা। বেশ মেলোড্রামাটিক সিনেমা, আমাদের দেখা হওয়াটাও।

আমার অন্য অনেক বাতিকের মতো মেলোড্রামাটিক সিনেমা দেখে চোখ ছলছল করার বাতিকও আছে। এটা নিয়ে ফিল্ম ক্লাবের বন্ধুরা আমার সঙ্গে মজা নিত। আমাদের ফিল্ম ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ইমরান ভাইয়া বলত, ‘শিকোয়ার কান্না জাস্টিফায়েড। ঋত্বিক ঘটক কী বলছে, মনে নেই? বলছে, মেলোড্রামা আমাদের, আমাদের সমগ্র উপমহাদেশের বার্থ রাইট, আমাদের জন্মগত অধিকার। এখানে কান্নাবিধুরতা থাকবে, বিলাপ থাকবে, মর্সিয়া ক্রন্দন থাকবে। শিকোয়া আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পিউরেস্ট সাউথ এশিয়ান দর্শক।’

হলে কাকতালে আমার পাশের সিটে বসেছিল তানসির। একা। ফারহানা সঙ্গে নেই। আমার সঙ্গে আমার এক কাজিন আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে সে ক্যান্সেল করেছিল। ফলে আমার ডান পাশের সিটটা ফাঁকা ছিল। আর বাঁ পাশে ছিল তানসির। আমি তানসিরকে দেখে ডান পাশের ফাঁকা সিটটায় গিয়ে বসলাম।

ফিল্মের মেলোড্রামাটিক সিনে আমার ছলছল চোখ দেখে তানসির একটু থমকে গিয়েছিল। সে পাশের সিটটায় এসে বসেছিল।

মাঝেমধ্যে যখন পিছে ফিরে তাকাই, সন্দেহ হয়, আমি কি সেদিন ‘মনপুরা’ দেখে কেঁদেছিলাম, নাকি তানসিরকে দেখে মন পোড়া শুরু হয়েছিল দেখে কেঁদেছিলাম। কান্নার সত্য ইতিহাস আসলেই কি জানা যায় কখনো?

‘মনপুরা’ দেখে আমরা বসলাম একসঙ্গে। খাওয়াদাওয়া করলাম ফুডকোর্টে। তানসির কিছু একটা বলি বলি করছিল; কিন্তু বলছিল না। হয়তো আমার বিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। আমিও বেশ আপ্লুত হয়ে মুখিয়ে ছিলাম তার বক্তব্য শোনার জন্য।

তানসির বরং অন্য খবর জানিয়েছিল। জানিয়েছিল, ফারহানার সঙ্গে তার কঠিন ঝগড়া হয়েছে আবার। সে বেশ বিক্ষিপ্ত। আমার হৃৎপিণ্ড মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠেছিল। এই কেঁপে ওঠার সঠিক ব্যাখ্যা আমি পাইনি সেই দিন। ফারহানার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় তানসির আর আমার যোগাযোগ আবার বাড়তে পারে, এই সম্ভাবনা থেকে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল নাকি আশঙ্কা থেকে কেঁপে উঠল—আমি হলফ করে বলতে পারব না। একবার মনে হয়েছিল, যোগাযোগ ঘটুক—এটা আমার ভেতরের এক অংশ চাইছে। আবার অন্য অংশ চাইছে, দ্বিতীয়বারের মতো হৃদয়ভঙ্গের বেদনা থেকে আমি যেন দূরে থাকি।

এই নড়বড়ে অবস্থায় তানসিরকে বলে ফেলি, আমি তার জন্য বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু অনুভব করি। এই উপলব্ধিটা আমার হয়েছে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, তানসির আমার সঙ্গে সব সময় আছে। যদিও কখনো এই বিষয়ে আমাদের কোনো কথা দেওয়ানেওয়া ঘটেনি; তবু অবচেতনে এই ধরে নেওয়াটা আমার ভালোবাসাবিষয়ক উপলব্ধিকে বারবার একটা অবধারিত ট্র্যাজিডির মধ্যে নিপতিত করেছে।

আমার কথা শুনে তানসির কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, ‘এত দিন বলিস নাই কেন?’

বললাম, ‘এই যে এখন বললাম।’

হঠাৎ বিকট শব্দে আওয়াজ। আমি ভয়ে তানসিরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।

১২

বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে সিলিন্ডার বাস্ট করে আগুন ধরে গিয়েছিল সেদিন। তানসির তৎক্ষণাৎ খুব করিতকর্মার মতো আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লোকজনের ধাক্কাধাক্কি বাঁচিয়ে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল। আমি স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম। অবশ হয়ে ছিলাম।

তখনো বুঝতে পারিনি, আমি কি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার জেরে ভয়ে শঙ্কায় অবশ হয়ে গিয়েছিলাম, নাকি প্রথমবারের মতো তানসিরের জড়িয়ে ধরার সংবেদী তীব্রতায় অবশ হয়ে গিয়েছিলাম।

মলের নিচে নেমে তানসির হাঁফাচ্ছিল। আমি কিছু অনুভব করতে পারছিলাম না, ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধাতস্থ হয়ে তানসির আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই ঠিক আছিস?’

আমি শুধু বললাম, ‘আমি তোকে ভালবাসি, তানসির।’

১৩

ওদিন শেষবারের মতো তানসির আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল। আমরা কোনো রিকশা, সিএনজি কিছু নিলাম না। কাওরান বাজার, মগবাজার হয়ে আমরা শান্তিনগর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। মাঝখানে একটা চায়ের দোকানে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। তানসির সিগারেট ধরিয়েছিল। সিগারেটের টাকা আমি কখনো পরিশোধ করিনি। কোনো বন্ধুর ক্ষেত্রেই না। ওই দিন সিগারেটের টাকা আমিই পরিশোধ করেছিলাম।

বেইলি রোডের একটা কফিশপ দেখে তানসির পরামর্শ দিয়েছিল, কফিটফি খেয়ে ওয়াশরুমে মুখটুক ধুয়ে ফ্রেশট্রেশ হয়ে যেন বাসায় ঢুকি। যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল।

আমি কফি খাই না। ওই দিন শুধু শুধুই কফি অর্ডার করেছিলাম। তানসির এসপ্রেসো নিল একটা। আমি মোকা নিয়েছিলাম।

তানসির আমার হাত ধরে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। আমার কান্না ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল সেদিন।

হেঁচকি উঠেছিল বার কয়েক। হেঁচকি দিতে দিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী চাস তুই? কী করা উচিত আমাদের?’

মনে আছে, তানসির আরেকটু পাশে এসে বসেছিল। বাঁ হাতের মধ্যমা দিয়ে ডান চোখটি ঘষেছিল। হাতের তালু দিয়ে নিজের মুখটা প্রায় ঢেকে রেখেছিল। ওর চোখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের উচিত আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষদের কষ্ট না দেওয়া।’

আমি আর কথা বাড়াইনি।

তানসির আমাকে বাসার নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। আমি ধীরে সুস্থে বাসায় উঠেছিলাম সিঁড়ি ভেঙে। লিফট ব্যবহার করিনি সেদিন।

দরজা খুলে বাসায় ঢুকে ফোন বের করে দেখি ইন্টারন্যাশনাল কল। বুঝলাম, জামশেদ ফোন দিয়েছিল।

জামশেদ সিয়াটল থেকে ফিরলে সেই বছর ডিসেম্বরের শীতে আমাদের বিয়ে হয়। তানসির পরের বছর পহেলা শ্রাবণ বিয়ে করে ফারহানাকে। বন্ধু জামিল আমাকে ফোন করে খবরটি জানিয়েছিল।

১৪

আভাকে স্কুল থেকে তুলে বাসায় নামিয়ে আবার কলা ভবন ফিরতে ফিরতে নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট দেরি হলো। ডিপার্টমেন্টে এসে জানলাম, আজকে মিটিং হচ্ছে না।

দুপুরে খাওয়া হয়নি। চারটা বাজে এখন। তানসিরের দেওয়া ফাসট্র্যাক ঘড়িতেই দেখলাম। শুধু শুধুই এলাম এই জ্যাম ঠেলে। কবজিতে বাঁধা ঘড়ি থেকে মুখ তুলতেই দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তানসির।

বেশ একটা সুন্দর হাসি হেসে বলল, ‘ডক্টর শিকোয়া, আপনি কি এখন অনেক ব্যস্ত?’

১৫

আমি ওকে নিয়ে টিচার্স লাউঞ্জে গেলাম। দুজনেই অভুক্ত ছিলাম। ও টিচার্স লাউঞ্জের খাবার নিয়ে বেশ ঠাট্টা–মশকরা করল। একটা পেঁপের শরবত অর্ডার করল। এত পানি মিশিয়েছে যে পেঁপের স্বাদই নাকি পাওয়া যায় না। আমি কখনো ওই পেঁপের শরবত খাইনি। তাই আসলেই বলতে পারব না, ঠিক বলেছে কি না। বা হতে পারে, আমাকে লেগপুল করার পুরোনো অভ্যাস থেকেই এমন বলছে।

টিচার্স লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে কলা ভবনের দরজা দিয়ে বেরোলাম। লেকচার থিয়েটারের সামনে দিয়ে হেঁটে মল চত্বরের দিকে গেলাম। মল চত্বরে ওর গাড়ি পার্ক করা ছিল। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে।

গাড়ির পাশে গিয়ে পেছনের সিটে রাখা একটা টোট ব্যাগ বের করে। টোট ব্যাগের ওপর লেখা ‘সিডনি’। টোট ব্যাগটা নেওয়ার পর আমরা হাঁটতে থাকি।

তানসির হাঁটতে হাঁটতে জানাল, ফারহানা নিবিড়কে নিয়ে অত্যন্ত ওভারকনশাস থাকে। পান থেকে চুন খসতে দেওয়া যায় না। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে টুকটাক মনোমালিন্য হয়। নিবিড় ওদের ছেলে। আভার তিন বছরের ছোট। মা ছেলে এখন সিডনিতে আছে। তানসির এসেছে একুশ দিনের জন্য। বাইশতম দিনে সিডনি চলে যাবে। এসেছে তার পরলোকগত পিতার নামে একটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করার কাজে। কিছু অর্থ লেনাদেনার বিষয় আছে। ওর চাচারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষা কর্মসূচি–সংক্রান্ত একটা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান চালায়। সম্প্রতি গঠিত হওয়া ট্রাস্টের টাকায় একটা ব্রেইল প্রকাশনার কথাবার্তা চলছে।

জিজ্ঞেস করলাম, পারিবারিক কাজে যেহেতু এসেছে, ওসবে ব্যস্ত না থেকে এতগুলো বছর পর কেন হঠাৎ এসেছে? এর মধ্যে নিশ্চয়ই সে বহুবার দেশে এসেছে। কোনোবারই তো দেখা করতে আসেনি। নাকি ফারহানার সঙ্গে নতুন কোনো ঝগড়া হয়েছে?

ফোড়ন কেটেই বললাম, ‘পূর্ব ইতিহাস বলে, প্রত্যেকবার ফারহানার সঙ্গে ঝগড়া হলেই আমার সঙ্গে দেখা হয় তোর।’

আমার দিকে ঘুরে তাকাল হাঁটতে হাঁটতে। থেমে গেল।

বলল, ‘আচ্ছা, তবে যাচ্ছি।’

বলেই নিজের গাড়ির দিকে হাঁটা দিল। আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম তার ভ্রুক্ষেপহীন চলে যাওয়ার দিকে। তার পেছনে দৌড় দিলাম।

ওর রেমি কটনের শার্টটার পেটের দিকটায় খামচি মেরে ধরে বললাম, ‘বারো বছর আগেও এভাবে চলে গেছস। আসছস কেন, তাইলে?’

আমার দিকে ঘুরে তাকাল তানসির। বলল, ‘বারো বছর ধরে একটা দিনও যে তোকে ভুলতে পারি নাই। সেটাই জানাতে আসছি।’

আমার হাতে টোট ব্যাগটা দিল। খুলে দেখি, ওখানে একগাদা ভাজ করা কাগজ। আমি একটা ভাজ করা কাগজ বের করলাম। খুলে দেখি, সাদা কাগজ। তাকালাম ওর দিকে।

‘ব্রেইলে লেখা’, জানাল। আমি পৃষ্ঠার ওপর বুলালাম চোখ বন্ধ করে। ব্রেইলে লেখা ‘ভালোবাসি’ শব্দটার ওপর হাত এসে পড়ল।

চারটা চিঠি আছে। ব্রেইলে লেখা। তানসির জানে, আমি ব্রেইল পড়তে পারি। আমার মেজ বোনের জন্য আমরা দুই বোনই ব্রেইল পড়তে শিখেছিলাম।

বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে, বৃষ্টি হবে। আমরা রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের মূল গেটের সামনে একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসলাম। ও আমার কনিষ্ঠ আঙুলটা তার কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রাখল। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। আমি ওর কাঁধে মাথা রাখলাম।

চত্বরে দূরে ঘাসে বসে একদল ছেলে গান গাইছে। কনক ও কার্তিকের গান। ধ্রুব এষের লেখা—‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাক, একটু বসিয়া থাকো।’ বেশ পছন্দের গান আমার।

আমি বুঝলাম না, ছেলেগুলো কি আমাদের জন্য গাইছে গানটা?

হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি ঢুকল মল চত্বরে। টিচার্স পার্কিং স্ট্যান্ডের দিকে চলে যেতে দেখে বুঝলাম, আমার গাড়ি এসে গেছে। আমরা যে পাশটায় বসেছি, মনে হয় ড্রাইভার রাসেল আমাদের দেখেছে।

তানসিরকে জানালাম, আমার গাড়ি এসেছে।

কিছু উত্তর করল না। আমিও কিছু বললাম না। শুধু ওর কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

অনেকক্ষণ যাবৎ একটা মুহূর্তের ভেতর বসে থাকলে সময়কে যতটা ধীর মনে হয়, সেই ধীর সময়ের ধারণা কোনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একইভাবে সময়কে দ্রুত মনে হলেও কোনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেটা বুঝে ওঠা যায় না। রোমাঞ্চিত হৃদয়ের কাছে সময়ের ধারণা তাই বরাবরই গোলমেলে।

ব্যাপারটা আমি বুঝেছি ওর দেওয়া ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে। ফাসট্র্যাক ব্র্যান্ডের ঘড়ি। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, নতুন ঘড়ি, তাই কি দ্রুত চলছে? মনে মনে হাসলাম। হাসতে হাসতেই মনে হলো, ব্র্যান্ড নামের সঙ্গে সংহতি রেখে দ্রুত চলার সম্ভাবনাটুকুও একদম অমূলক নয়।

খণ্ডমুহূর্তের অন্তরালাপ যে হাসি হাসাল আমাকে; সে হাসি দেখেনি ও। সন্ধ্যা পড়ে এসেছে।

বলল, ‘আলো কমেছে। চলো, আরও যতটুক যাওয়া যায়!’

১৬

ওর গাড়ির পাশে পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছি। ও পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করাতে লক্ষ করলাম ওর চাবির রিংটা।

‘তানসির, তোর চাবির রিংটা দেখি?’

চাবির রিংটা আমার হাতে দিল। হাতে নিয়ে বুঝলাম, রিংটা সে নিজে বানিয়েছে। রিংটা বহুকাল আগের আমার একটা ঘড়ির ছিঁড়ে যাওয়া বেল্ট দিয়ে বানানো। ঘড়িটা তানসির সেই তখনই মেরামত করতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কখনো ফেরত দেয়নি আর।

ঘড়িটার কথা ভুলেই গেছিলাম আমি। চাবির রিংটা দেখে মনে পড়ল। ও ঘড়ির বেল্টটাকে বিশেষ পদ্ধতিতে পেঁচিয়ে চাবির রিং বানিয়েছে—বেশ শিহরিত লাগল দেখে।

অন্ধকারে বুঝতে পারলাম, আমার চোখ একটু ছলছল করছে। বিদায় নেওয়ার জন্য বললাম, ‘আচ্ছা, আসি তাহলে।’

মুখ ঘুরিয়ে কান্না চেপে আমি টিচার্স পার্কিং স্ট্যান্ডে রাখা আমার গাড়ির দিকে আগাতে থাকলাম। হঠাৎ পেছন থেকে তানসিরের হাত আমার কবজি শক্ত করে চেপে ধরল।

তানসির আমার কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি, যতটুক কাছাকাছি এলে শ্বাসপ্রশ্বাসের উষ্ণতা ঘাড়ে টের পাওয়া যায়, ততটুক কাছাকাছি এসে বলল, ‘ভালোবাসি।’

১৭

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ব্রেইলে লেখা ছোট ছোট চিঠিগুলো পড়ি।

প্রথম চিঠি: আমি ভালোবাসি তোকে—এ কথা আজকের নয়, ইউনিভার্সিটির সেই প্রথম দিন থেকে বলতে চেয়েছি।

দ্বিতীয় চিঠি: কিন্তু তুই আমাকে সব সময় বলেছিস, বন্ধুত্ব আর প্রেম–ভালোবাসাকে তুই মিলাতে চাস না কখনো। তাই বন্ধুকে ভালোবাসি বলতে সাহস হয়নি কখনো!

তৃতীয় চিঠি: আমি এ জন্যই এতগুলো বছর একটা বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিলাম। বাক্যটা হলো ‘আমি ভালোবাসি তোকে’।

চতুর্থ চিঠি: বাক্যটা খেয়াল করে দেখ। ‘ভালোবাসি’ শব্দটাই আমাকে আর তোকে আলাদা করে রেখেছে এত দিন!

বাসায় ফিরেই আগে চিঠিগুলো নিজের লকারে ঢুকিয়ে রাখি। লম্বা গোসল দিই। খাওয়াদাওয়া সারি। আভাকে খাওয়াই। নিজ রুমে এসে দরজা ভেজিয়ে তানসিরের লেখা চিঠিগুলো বের করে পড়ি। বুকের ভেতর ধুকপুকানির আওয়াজ বেড়ে যেতে থাকে।

জামশেদ ফোন করেছিল। বলল, আসতে একটু রাত হবে। তানসিরের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত এত তীব্রভাবে মনে পড়ছে, বলার মতো নয়!

১৮

রাতে কখন ঘুমিয়েছি, বুঝিনি। শুধু মাঝরাতে বুঝেছিলাম, আমার পাশে এসে শুয়েছে কেউ।

সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি, কাউচে বসে আছে আভা। খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিস্মিত হয়ে বলি, ‘পাখিবাচ্চাটা, কিছু হয়েছে?’

আভা বলে, ‘আমি দেখলাম, আব্বু না; তোমার পাশে কে যেন শুয়ে আছে।’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম আভার দিকে। পাশ ফিরে দেখি, বিছানা খালি।

বিছানার অইপাশটা দেবে আছে। বিছানায় কেউ শুলে বিছানা যেভাবে দেবে যায় তেমন। এর মানে সারা রাত অবশ্যই কেউ শুয়েছে এই পাশে।

সেই মুহূর্তে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল জামশেদ। জামশেদ বোধ হয় আজকেও তাড়াতাড়ি অফিসে যাবে।

কিছু জিজ্ঞেস করলাম না, শুয়েই থাকলাম। দেখলাম, বেশ পরিপাটি হয়ে সুন্দর করে সেজেগুঁজে বেরিয়ে গেল জামশেদ।

আভা কিছুক্ষণ আমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকল। আমি বিছানার ডান পাশে শুয়ে থাকা শরীরের ছাপের দিকে তাকিয়ে থাকি।

আভাকে বললাম, ‘তুই যে আমার সঙ্গে বাবার বদলে অন্য কাউকে শুয়ে থাকতে দেখলি, হতে পারে লোকটা আলোর বেগের চেয়ে দ্রুত বেগে এসে আরও দ্রুতগতিতে ফেরত চলে গেছে।’

আমরা মা–মেয়ে মিলে হাসলাম।

১৯

আভাকে স্কুলে পাঠিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে এসে বসেছি। তানসিরের সঙ্গে গতকালের আলাপগুলো মনে করে বারবার হাসছি।

তানসির জিজ্ঞেস করেছিল, আমি সুখী কি না। বলেছি, সুখী কি না, এটা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আসল সমস্যাটা হলো, আমরা আসলে জানি না আমরা আসলে কী চাই। আমরা যা চাই, তা পেলেই যে আমরা সুখী হয়ে যাব, বিষয়টা একেবারেই তা না। হ্যাপিনেস একটা লিবারেলিস্ট ধারণামাত্র। ইউটিলিটারিয়ানরাই হ্যাপিনেস নিয়ে তত্ত্ব করে মজা পায়। এখন প্রশ্ন হলো, ‘তুই কোন সুখের কথা বলছিস, গৌতম বুদ্ধের সুখ নাকি ইউটিলিটারিয়ানদের সুখ?’

নিজেকেই প্রশ্নটা আবার করলাম। নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, সুখ-অসুখের কথা বাদ দিই, আমি কি আসলেই তৃপ্ত? শারীরিক হোক কিংবা মানসিক হোক, জীবনের আসল তৃপ্তি —আমার কাছে মনে হয়—একটা নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর থাকা। এমনকি নিজের সঙ্গে, নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করার মধ্যেও অসীম তৃপ্তি আছে। সারা জীবন সুখী হয়ে থাকতে চাইলে আমাদের আসলে বেকুব হয়েই থাকতে হবে।

আমি বেকুব না। আমি জানি, সবকিছু ঠিকঠাক থেকে তানসিরের সঙ্গে থাকাথাকি সম্ভব হলেও আমি সম্ভবত ‘আমাদের’ মিস করতাম। আমি আসলে ইউনিভার্সিটির সেই তানসির আর শিকোয়াকে মিস করি। ওদের জন্য ভেতরটা আমার এখনো হু হু করে ওঠে। সে সময়ের শিকোয়া আর আমি এক ব্যক্তি হয়তো না। সে সময়ের তানসির আর গতকালের তানসিরও এক তানসির না।

আমাদের ভেতরকার এই ক্রমপরিবর্তনের ঠিকুজি যদি আমরা রাখতে শিখে যাই, তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রভু হয়ে উঠতে পারব। আর নিজেরাই নিজেদের প্রভু হয়ে ওঠে যারা, তারা কখনো সুখী হয় না। সুখী থাকে দাসমনোবৃত্তির লোকজনেরা।

আমি সুখী না। তবে এ জীবন নিয়ে আমি তৃপ্ত।

গোসলে ঢুকে অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পানির ছিটা পড়ে শুকিয়ে আয়নাটি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

মনে হলো, নিজের ধূসর প্রতিবিম্বের সামনে অপলক প্রতিক্ষার পর নিজের নয়, বরং প্রিয়জনের স্পষ্ট মুখ ভেসে ওঠে। অথচ সেই প্রিয়মুখের ছবি তুলে রাখা সম্ভব হয় না কখনো।

প্রতি রাতে চোখবন্ধ মুহূর্তের ভেতর আমাদের সেই প্রিয়মুখও ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে চোখ খুললেও তাকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আফসোস! মনে মনে সেই প্রিয়মুখের ছবি তুলে রাখার মতো ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়নি এখনো!

নাশতা শেষ করে শাড়ি পরে খোলা চুলে জানলার পাশে এসে বসলাম। সব আয়োজন শেষে করে রইলাম প্রতিক্ষার পাদদেশে; কখন আমার ফোনের স্ক্রিনে ‘তানসির নিউ কলিং’ লেখাটি ভেসে উঠবে।

জানালায় পর্দা উড়ল। বাতাস বইছে। আজ হয়তো ঝুম বৃষ্টি নামবে।

২০

জামিল কলিং—স্ক্রিনে ভেসে উঠল। এত বছর পর আচমকা জামিলের ফোন পেয়ে ভড়কে গেলাম।

ফোন রিসিভ করলাম।

‘কি রে শিকোয়া, আছিস কেমন?’

‘আছি রে, দোস্ত! কত বছর পর!’

‘তোকে একটা দুঃসংবাদ জানাতে ফোন করেছি। গতকাল সিডনি থেকে হংকং ছেড়ে যাওয়া ক্যাথে প্যাসেফিকের ফ্লাইটটা ক্র্যাশ করেছে। অই ফ্লাইটে আমাদের তানসির ছিল। ঢাকা আসতেছিল ও; হংকংয়ে লেওভার ছিল।’

আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ঠিক শুনলাম?

‘জামিল, দোস্ত, এই রকম ফালতু জোক করিস না প্লিজ!’

‘শিকোয়া, আমারও খবরটা প্রসেস করতে কষ্ট হচ্ছে। জোক করতেছি না, দোস্ত। এখন ফোন রাখি। অন্য বন্ধুদের জানাই। পরে কথা হবে।’

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ব্রেইলে লেখা চিঠিগুলো বের করলাম। হাত বুলিয়ে দেখি, কোনো কিছুই লেখা নেই। সম্পূর্ণ সাদা পৃষ্ঠা। হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালাম। ফাসট্র্যাকের ঘড়িটাতে কোনো কাঁটা নেই। ফোনের কন্ট্যাক্ট ডিটেইলে গিয়ে দেখি, ‘তানসির নিউ’ লেখা কন্ট্যাক্ট ডিটেইলে ফোন নম্বর ০০০০০০০০০০০। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, নম্বরটার শেষে ছিল ০০০৩৩৩। এভাবেই ফোন নম্বর মনে রাখি আমি। প্রথমে ০১৭ মানে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরের নম্বর। তারপর দুইটা ডিজিট। তারপর তিনটা ডিজিটের জোড়া। সেই হিসাবে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘তানসির নিউ’ লিখে আমি যে নম্বরটি সেভ করেছিলাম, সেটি ছিল ০১৭২৬০০০৩৩৩।

নম্বরটি লিখে ডায়াল করলাম। অপারেটর জানাল, নম্বরটি বন্ধ আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম হ র ত র জন য জ জ ঞ স করল ম ড প র টম ন ট ইউন ভ র স ট জ জ ঞ স কর আম র দ ক কর ছ ল ম ন র জন য ব র করল বছর পর সব সময় একসঙ গ আম র স বন ধ ক আম র গ বস ছ ল থ কল ম হয় ছ ল ওই দ ন ব ড আর আম র হ ল আম ক আম র প র আম র স ভ কর আম র ব আম র চ ব র কর র স মন র ভ তর ব রব র আম দ র আম র ক তত ত ব আম র ম বলল ম র একট পছন দ র ওপর আওয় জ র বছর আসল ই র সময় ত রপর করত ম প রথম বসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ