প্রায় ৯-১০ ফুট উঁচু বেজায় বৃহৎ একটি রকের ফাটল থেকে গজিয়েছে, চিরল চিরল পাতায় সমাচ্ছন্ন একটি বৃক্ষ। গাছটির দুদিকে প্রসারিত হয়েছে সরল-সোজা দুটি ডাল। তাতে রোদ পড়ে তৈরি হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের প্রতীক ক্রুশের আকৃতি। গোসলখানার তালাশে ফার্মহাউসের দিকে যাওয়ার মেঠোপথের নির্দেশনা দিতে গিয়ে এল-নোরা ঠিক এই গাছেরই উল্লেখ করেছিল। এ মুহূর্তে আমার প্রয়োজন, ওয়ারি গোত্রের পিরামিড থেকে স্মৃতিপ্রবণ মনকে ইনকা ট্রেইলের বাস্তবতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। জোরকদমে হেঁটে আসায় একটু ক্লান্তও লাগছে, তাই বসে পড়ি পা ছড়িয়ে। 

বৃক্ষটির প্রজাতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেও, তার গোড়ার খোঁড়লে ডিমে তা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে থাকা গোটা ছয়েক বনঘুঘুকে দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক লাগে! গাছটির কাণ্ড থেকে অর্কিডের মতো বেরিয়ে এসেছে কয়েকটি সাদাটে ধূসর কলি। তার গোড়া থেকে পালা করে ফেসো ছিঁড়ে নিচ্ছে, আগ্রাসী গোছের দুটি নাম না জানা পাখি। 

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রান্তরের ওপারে ঘন হয়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের দিকে নজর দিই। কাঠের বেড়া দেওয়া একটি ফার্মহাউসের আদলও স্পষ্ট ওঠে। ওখান থেকে বেরিয়ে, আস্তেধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে ট্রেইলের চেনা মুখ—কারমাইকেল কারামুচি। দূরত্বের জন্য তার চোখমুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয় না কিছু, তবে রোদে সুঠাম দীর্ঘ দেহের ছায়া ফেলে পাতা–লতা, পাথর ও পতঙ্গ নিরিখ করে করে, অতি ধীরে হাঁটার ভঙ্গি থেকে ‘ক্রাম’ ডাকনামে পরিচিত কারামুচিকে চিনতে আমার ভুল হয় না।

সোনালি চুল ও বাহারি দাড়িতে তারুণ্যদীপ্ত ক্রাম মজার মজার মেসেজ উৎকীর্ণ টি-শার্ট পরতে ভালোবাসে। দিন তিনেক আগে তাকে দেখি, এল-নোরার হাত ধরে মৃদুস্বরে কিছু বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। তখন তার টি–শার্টের পেছনে লেখা ছিল, ‘সরি গার্লস্, আই ডেট ওনলি মডেলস’। 

আমাদের দেখতে পেয়ে ক্রাম হাতও নেড়েছিল। তখন খেয়াল করেছিলাম, অত্যন্ত সুদর্শন এই যুবকের পিঠে দুটো ডানা জুড়ে দিলে, তাকে মডেল করে আঁকা যায় দেবদূতের চিত্র। মানুষটি খুব নিচু গলায় মাঝেমধ্যে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন ধাঁচের গান গেয়ে ক্যাম্পসাইটের কারও কারও মন মাতিয়েছে। ট্র্যাকার নারীদের মধ্যে তার স্তাবকও জুটেছে, তবে সাড়া দানে সে এখন অব্দি বিরত আছে। 

ক্রাম আমার কাছাকাছি এগিয়ে এলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ইশারায় গাছটির ছায়ায় সৃষ্ট ক্রুশচিহ্নটি দেখাই। গোসল সেরে এসেছে, তাই ট্রাউজারের এখানে-ওখানে ফুটে উঠেছে জলের ছোপ ছোপ আর্দ্রতা। আঙুলে স্যাঁতসেঁতে টি–শার্টে ক্রুশের প্রতীক এঁকে সে বলে, দিস শ্যাডো কুড কোয়ালিফাই ফর অ্যান এক্সাম্পল অব আ ট্রেইল ম্যাজিক। 

সহমত প্রকাশে আমি মাথা হেলাই, যুবকটি ঠোঁটে–মুখে বশীকরণ হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘ওয়াটার ইজ ওয়ার্ম, এনজয় আ ফাইন শাওয়ার।’

চলে যায় সে। গমনপথের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার টি–শার্টের পিঠে আজ লেখা, ‘হোয়াট কালার ইজ ইয়োর প্যারাস্যুট?’ এই মেসেজের মর্মার্থ কী হতে পারে, তা ভাবতে ভাবতে ফার্মহাউসের দিকে মেলা দিই। কিন্তু মাথা থেকে ক্রামকে সরাতে পারি না; কারণ তাকে দেখলেই মনে হয় যে চাইলে এই বান্দাকে চরিত্র করে গোয়েন্দা গল্প লেখা যায়। 

কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে ক্রামকে তাঁবুর সামনে কারও মাথার খুলি হাতে বসে থাকতে দেখলে, রহস্য গল্পের ধাঁচে কিছু একটা লেখার প্লট আমার মাথায় আসে; আর আমি যে ধরনের ভ্রমণ রচনা মুসাবিদা করে থাকি, তাতে চরিত্রহীন হওয়ার অবকাশ কম, রসদের তাগিদে সদাসর্বদা আমাকে তালাশ করতে হয় কোনো না কোনো চরিত্রের, তো সে প্রেষণায় জানতে চাই, ‘খুলিটি কার, বলা যায় আমাকে, ক্রাম?’ 

সম্মোহন ছড়ানো হাসি ফুটিয়ে সে করোটিকে সম্বোধন করে তার ‘সুইটহার্ট’ বা ‘প্রয়াত প্রেমিকা’ বলে। মন্তব্য করি, এ ধরনের বস্তু নিয়ে ট্রেইলে ঘোরাফেরা করাটা রেওয়াজ হিসেবে শুধু অপ্রচলই নয়, অপরাধও বটে। 

সহমত পোষণ করে কারামুচি ওরফে ক্রাম বলে, ইয়েস, সত্যিকারের খুলি নিয়ে খোলা আসমানের তলায় হাঁটাহাঁটি করলে, আঙিনায় রঙ্গন ফুটলে যেমন মধু চাখতে হাজির হয় ক্রিমসন সানবার্ড বা সিঁদুরে মৌটুসি পাখি, ঠিক তেমনি পরওয়ানা নিয়ে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা এসে উদয় হবে তৎক্ষণাৎ।

কথাবার্তায় জানতে পারি যে প্লাস্টিকের কয়েকটি টুকরাটাকরা জড়ো করে ক্রাম তার তথাকথিত সুইটহার্টের খুলি নির্মাণ করেছে। পেশা হিসেবে বছরজুড়ে প্লাস্টিকের করোটি ও কঙ্কাল তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে হ্যালোউইন পরবের সময় সেগুলো চড়া মূল্যে বিক্রি করে দিন গুজরান করে সে। প্রসঙ্গত উল্লখ্য যে হ্যালোউইন উদ্‌যাপনের সময় আঙিনায় মুখ ব্যাদান করা কৃত্রিম কঙ্কাল দাঁড় করিয়ে রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক রীতি-রেওয়াজেরই অংশ বিশেষ। 

ফার্মহাউসের কাছাকাছি আসতেই প্রান্তরে গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুটে ওঠা হলুদ ও নীল রঙের বুনো ফুলের কনট্রাস্ট খুব করে চোখে পড়ে। ফটক খুলে আঙিনায় ঢুকি, কিছু স্থানীয় ফুলের ঝোপঝাড় ছাড়া অন্য কোনো অর্থকরি ফসল চোখে পড়ে না। একদিকে ফার্মের মালিকের ইটে গড়া একটি সাদামাটা ঘর; তার দেয়াল ঘেঁষে লাগানো তিনটি ইয়াকা ফুলের গাছ। 

সূর্যপ্রিয় এই তরু লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে বিবেচিত হয় নেটিভ প্ল্যান্ট হিসেবে। সুতরাং ইনকা ট্রেইলের কাছাকাছি ইয়াকাগাছ দেখতে পেয়ে তেমন একটা অবাক হই না, তবে যা আমাকে বিপুলভাবে বিস্মিত করে, তা হচ্ছে তরুটির আচরণ! এই মৌসুমে এতে সাদা রঙের সুদীর্ঘ গর্জিয়াস ডাঁটিওয়ালা সব ফুল ফুটে ওঠার কথা। কিন্তু তা না ফুটিয়ে গাছটি তার পত্রালিতে ঝাঁপির মতো আকৃতি তৈরি করে যেন কিছু একটা থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছে। 

ইয়াকাগাছের পত্রালিতে তৈরি হয়েছে ঝাঁপির আকৃতি.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ