এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়।

গাজায় দুর্ভিক্ষ ইতিমধ্যে এসে গেছে। এটা কোনো রূপক অর্থ নয়, কোনো ভবিষ্যদ্বাণীও নয়। এটা প্রতিদিনের বাস্তবতা।

এটা সেই শিশু, যে ঘুম থেকে উঠে বিস্কুট চায় কিন্তু বিস্কুট আর নেই। এটা সেই ছাত্র, যে ক্ষুধায় অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হলেও পরীক্ষার জন্য পড়ে। 

আরো পড়ুন:

গাজা যুদ্ধে প্রশ্নের মুখে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতি

হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন প্রস্তাবে রাজি ইসরায়েল

এটা সেই মা, যে তার ছেলেকে বোঝাতে পারে না কেন ঘরে রুটি নেই। আর এটা সেই নীরবতা, যে নীরবতা এই ভয়াবহতা সম্ভব করে তুলেছে।

দুর্ভিক্ষের সন্তানরা
নূর, আমার বড় বোন তাসনিমের মেয়ে, তিন বছর বয়স; সে জন্মেছিল ২০২১ সালের ১১ মে।
আমার বোনের ছেলে, ইয্‌য আলদিন, জন্মেছিল ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর; যুদ্ধের শুরুর দিকেই।

এক সকালে, তাসনিম আমাদের ঘরে ঢুকল ওদের দুজনকে কোলে নিয়ে। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন করলাম, যা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছিল না, “তাসনিম, নূর আর ইয্‌য আলদিন কি ক্ষুধা বোঝে? ওরা কি জানে আমরা দুর্ভিক্ষে আছি?”

“হ্যাঁ,” সে সঙ্গে সঙ্গেই বলল।

“ইয্‌য পর্যন্ত, যে শুধু যুদ্ধ আর ধ্বংসই দেখেছে, সেও বোঝে। সে জীবনে কখনো আসল খাবার দেখেনি। সে জানেই না ‘বিকল্প’ কাকে বলে। ওর একটাই চাওয়া— রুটি।”

সে ওর শিশুকণ্ঠ অনুকরণ করল: “ওব্‌জ! ওব্‌জা! ওব্‌জা!”  শিশুটির “খোবজা” (এক টুকরো রুটি) বলার ধরন।
তাকে বলতে হয়, “ময়দা নেই, সোনা। তোমার বাবা বের হয়েছে খুঁজতে।”

ইয্‌য আলদিন যুদ্ধবিরতি, সীমান্ত বা রাজনীতি কিছুই জানে না। সে সামরিক অভিযান বা কূটনৈতিক বিবৃতি নিয়ে কিছুই ভাবে না।

সে শুধু চায় একটু করো রুটি। আর পৃথিবী তাকে কিছুই দেয় না।

নূর তার মায়ের কাছ থেকে সংখ্যা গোনা আর বর্ণমালা বলা শিখেছে। যুদ্ধের আগে সে ভালোবাসতো চকলেট ও বিস্কুট।

সে ছিল আমাদের পরিবারের প্রথম নাতনি; খেলনা, খাবার আর ছোট ছোট জামাকাপড়ে ভরা ভালোবাসা পেয়েছিল।

এখন প্রতিদিন সকালবেলা নূর জেগে উঠে বড় বড় উচ্ছ্বসিত চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার জন্য ১৫টা চকলেট আর বিস্কুট কিনে আনো।”

সে ১৫ বলে, কারণ এটিই তার জানা সবচেয়ে বড় সংখ্যা। তার কাছে এটা যথেষ্ট মনে হয়; পেট ভরানোর জন্য যথেষ্ট, তার চেনা পৃথিবীকে আবার ফিরে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কিছু কেনারই নেই। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

তোমার মানবতা কোথায়? তার দিকে তাকাও। তারপর আমাকে বলো, ন্যায়বিচার আসলে কাকে বলে।

অনাহারের পাঁচ দিন পর হত্যা
আমি একটি ভিডিও দেখেছিলাম, যা আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। একজন মানুষ তার পরিবারের সাতজন সদস্যের কাফনে মোড়ানো মরদেহের ওপর বিলাপ করছিল। হতাশায় সে চিৎকার করছিল, “আমরা ক্ষুধার্ত।”

তারা কয়েকদিন ধরে অনাহারে ছিল, এরপর একটি ইসরায়েলি নজরদারি ড্রোন দারাজের উত্তরে আল-তাবিন স্কুলের কাছে তাদের তাঁবুতে আঘাত হানে।

ভিডিওতে সেই মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “এটা সেই তরুণ, যাকে আমি লালন-পালন করছিলাম।” 

“দেখো, এদের কী অবস্থা হয়েছে,” বলতে বলতে সে তাদের মাথায় শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে দিল।

অনেকে এখনো বোঝে না। এটা টাকার বিষয় না। এটা সম্পূর্ণ খাদ্য সংকটের বিষয়। এই মুহূর্তে গাজায় তুমি যদি কোটিপতিও হও, তবুও রুটি পাবে না। এক ব্যাগ চাল বা এক ক্যান দুধও পাবে না। বাজার খালি। দোকান ধ্বংস হয়ে গেছে। শপিংমল মাটির সাথে মিশে গেছে। তাকগুলো খালি নয়; সেগুলো আর নেই।

আমরা এক সময় নিজেদের খাবার উৎপাদন করতাম। গাজা এক সময় ফলমূল আর শাকসবজি রপ্তানি করত; আমরা ইউরোপে স্ট্রবেরি পাঠাতাম। আমাদের জিনিসপত্রের দাম ছিল অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা।

এক কেজি আঙুর বা আপেল? তিন শেকেল (প্রায় ৯০ সেন্ট)। গাজার খামারে এক কেজি মুরগির দাম? ৯ শেকেল (প্রায় ২.

৭০ ডলার)। আর এখন? একটা ডিমও পাওয়া যায় না।

আগে খান ইউনিস থেকে আনা ২১ কেজির বিশাল এক তরমুজের দাম ছিল ১৮ শেকেল (প্রায় ৫ ডলার)। আজ সেই একই তরমুজের দাম ২৫০ ডলার, যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবেই।

অ্যাভোকাডো, যাকে এক সময় বিলাসী ফল ধরা হতো, টনকে টন উৎপাদিত হতো আল-মাওয়াসি, খান ইউনিস আর রাফাতে। এক কেজির দাম ছিল মাত্র এক ডলার।

আমাদের দুগ্ধজাত পণ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতাও ছিল; শুজাইয়ায় স্থানীয় লোকেরা তৈরি করত দই আর পনির।

আমাদের শিশুরা প্রাচুর্যতার মধ্যে বড় হয়েছে তা নয়; তারা তাদের প্রাথমিক অধিকারগুলো পেত। সকালের নাশতা মানে ছিল দুধ। একটা পনির স্যান্ডউইচ। একটা সেদ্ধ ডিম। এখন, সব কিছু বন্ধ।

আর আমি যতই শিশুদের বোঝাতে চেষ্টা করি, ‘দুর্ভিক্ষ’ বা ‘দামের ঊর্ধ্বগতি’, এই কথাগুলো তারা বুঝতে পারে না। তারা শুধু জানে তাদের পেট খালি।
এমনকি সমুদ্রের মাছ; যা এক সময় গাজার প্রধান খাদ্য ছিল, সেটাও আজ হারিয়ে গেছে। মাছ ধরায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও আমরা এক সময় পশ্চিম তীরে মাছ পাঠাতাম। আর এখন, আমাদের সমুদ্রটাও নীরব।

তুর্কি কফির সুখ্যাতি মাথায় রেখে বলছি, তোমরা এখনো সত্যিকারের কফি চেখে দেখোনি, যদি না গাজার মাজাজ কফি খেয়ে থাকো। ওটার শক্তি ছিল, যা হাড়ের ভেতর পর্যন্ত অনুভব করা যেত।

এটা কোনো পূর্বাভাস নয়। দুর্ভিক্ষ এখনই চলছে। আমাদের বেশিরভাগই গৃহহীন। বেকার। শোকগ্রস্ত। আমরা যদি দিনে একবেলা খাবার জোগাড় করতেও পারি, তাহলে সেটা রাতে খাই।

ওটা কোনো ভোজ নয়। ওটা শুধু ভাত। পাস্তা। হয়তো কিছু স্যুপ। টিনজাত মসুর বা মটরশুঁটি। যেগুলো তোমরা তোমাদের রান্নাঘরের আলমারিতে মজুত রাখো, এখানে সেগুলো এখন বিলাসিতা।

বেশিরভাগ দিন, আমরা শুধু পানি খাই। আর কিছুই না। যখন ক্ষুধা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে যায়, তখন আমরা পুরনো ছবি দেখি; আগের সময়ের খাবারের ছবি। শুধু জীবনটা একসময় কেমন ছিল, সেটা মনে করার জন্য।

অনাহারের মধ্যে পরীক্ষা
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সবসময় অনলাইনে হয়; কারণ ক্যাম্পাস এখন ধ্বংসস্তূপ। আমরা গণহত্যার মধ্যে বাস করছি। তবুও আমরা পড়াশোনা করার চেষ্টা করছি।

আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

আমরা শেষ করলাম প্রথম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা। আমরা পড়েছি ক্ষুধার মধ্যে, ড্রোনের শব্দে, আর একটানা ভয়ের মধ্যে। এটা কোনোভাবেই সেই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যেমনটা মানুষ কল্পনা করে।

আমরা পরীক্ষাগুলো দিয়েছি খালি পেটে, যুদ্ধবিমানের চিৎকারের নিচে। একদিকে আমরা তারিখ মনে রাখার চেষ্টা করেছি, আরেকদিকে ভুলে গেছি শেষ কবে রুটি খেয়েছিলাম।

প্রতিদিন আমি আমার বন্ধু হুদা, মরিয়ম আর এসরার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলি। আমরা একে অপরের খোঁজ নিই, আর বারবার একই প্রশ্ন করি, “আজ কী খেয়েছো?” “তুমি মনোযোগ দিতে পারছো?”

আমাদের এই কথোপকথন লেকচার বা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে নয়, বরং ক্ষুধা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা আর আমরা এখনো কীভাবে টিকে আছি, সেসব নিয়ে। 

কেউ বলে, “ক্ষুধায় পেট এতটাই ব্যথা করছে যে, কিছু ভাবতেই পারছি না।” আরেকজন বলে, “দাঁড়ানোর পর প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।”

তবুও আমরা চালিয়ে গেছি। আমাদের শেষ পরীক্ষা ছিল ১৫ জুলাই। আমরা টিকেছিলাম শুধু, শক্তিশালী ছিলাম না; আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। আমরা সেমিস্টার হারাতে চাইনি। কিন্তু এটা বলাও সত্যিকারের বাস্তবতার তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়। ক্ষুধার মধ্যে পড়াশোনা করতে করতে মনটা ধ্বংস হয়ে যায়। 

একদিন পরীক্ষার সময় আমাদের প্রতিবেশীদের ওপর এক বিমান হামলা হয়। বিস্ফোরণে দেয়াল কেঁপে ওঠে। এক মুহূর্ত আগে আমি ভাবছিলাম কতটা ক্ষুধার্ত লাগছে। এক মুহূর্ত পরে কিছুই অনুভব করিনি। আমি দৌড়াইনি।

আমি আমার ডেস্কে বসে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভালো ছিলাম না। ডেস্ক ছেড়ে গিয়ে আমার বিকল্প কিছু করারও ছিল না। 

আমাদের না খাইয়ে মারছে, তারপর দোষও দিচ্ছে আমাদেরই
একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই, গাজার মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে না খাইয়ে মারা হচ্ছে।
আমরা দুর্ভাগা নই। আমরা যুদ্ধাপরাধের শিকার।

সীমান্ত খুলে দাও। ত্রাণ ঢুকতে দাও। খাবার ঢুকতে দাও। ওষুধ ঢুকতে দাও।

গাজার মানুষের করুণা দরকার নেই। আমরা আবার গড়ে তুলতে পারি। আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু তার আগে আমাদের না খাইয়ে মারা বন্ধ করো।

হত্যা, অনাহার আর অবরোধ— এগুলো শুধু পরিস্থিতি নয়, এগুলো আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাষা-ই প্রকাশ করে, দায় এড়াতে চাইছে কে।

তাই আমরা বারবার বলে যাব, আমাদের হত্যা করেছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। আমাদের অনাহারে রেখেছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। আমাদের অবরোধ করেছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী।

ঢাকা/রাসেল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল এক সময র জন য অন হ র আম দ র পর ক ষ আম র ব ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

রাজকীয় ভোজে ট্রাম্প–মেলানিয়াকে কী কী খাওয়ালেন রাজা চার্লস

জমকালো সাজে সেজেছে যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল। উপলক্ষটাও অনন্য, রাজকীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সস্ত্রীক যুক্তরাজ্য সফর উপলক্ষে এখানে রাজকীয় নৈশ্যভোজ আয়োজন করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা।

বুধবার রাতের রাজকীয় এ আয়োজনে কূটনীতি, খাবার, ঐতিহ্য, সংগীত আর আভিজাত্য একসুতোয় বাঁধা পড়েছিল। ট্রাম্প–মেলানিয়াসহ রাজার অতিথি হয়েছিলেন বিশ্বের ১৬০ জন গণমান্য ব্যক্তি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্মানে রাজা তৃতীয় চার্লসের আয়োজন করা রাজকীয় ভোজের টেবিল। যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ