বিশ্বে ছাত্রদের নেতৃত্বে শীর্ষ ১০টি আন্দোলন
Published: 5th, August 2025 GMT
ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সব সময়ই শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন। হোক সরকার উচ্ছেদ কিংবা বড় সংস্কার, ছাত্ররা প্রায়ই থেকেছে পরিবর্তনশীল বিভিন্ন আন্দোলনের অগ্রভাগে। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলন এই তালিকার সর্বশেষ বড় উদাহরণ। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাই। বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন আনা ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ ধরনের ১০টি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা জেনে নেওয়া যাক।
১.জুলাই গণ–অভ্যুত্থান (বাংলাদেশ, ২০২৪)জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রতিবাদ মুখর শিক্ষার্থীরা, ঢাকা, জুলাই ২০২৪
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ ঘোষণায় শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন আর আস্থাহীনতার পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে এক সম্ভাবনাময় সন্ধিক্ষণে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর কয়েক মাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে চূড়ান্ত করেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এর ওপর ভিত্তি করেই ৫ আগস্ট ঘোষিত হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং তা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও সংলাপভিত্তিক ভবিষ্যতের নতুন সূচনা।
আলোচনা ও ঐকমত্যের কাঠামো
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মার্চ ২০২৫ থেকে দুই দফায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে। প্রথম পর্যায় (২০ মার্চ–১৯ মে): ৩৩টি দলের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় (২ জুন–৩১ জুলাই): ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ২৩ দিনব্যাপী ধারাবাহিক বৈঠকে। এ প্রক্রিয়ায় মোট ১৯টি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ইস্যুতে সম্মতির ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খসড়া প্রস্তুত হয়।
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দফা
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামতের সুযোগ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ,
নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষ গঠন ও ইলেক্টোরাল কলেজ চালু, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও পিএসসির নিয়োগে স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
আংশিক মতভেদ:
সব দল একযোগে সনদের সব দফা মানছে না। দলভেদে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা ১৯টির মধ্যে ১৫টি সংস্কারে একমত, তবে চারটি দফায় তারা সই দেবে না:
১. প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর বা
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) :উচ্চকক্ষে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছে।
২. প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত পদ বিলুপ্তি: একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান না থাকার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. দুদক ও পিএসসি নিয়োগে কমিটি গঠন: এটি ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙবে বলে তাদের মত।
৪. তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নির্বাচনে র্যাঙ্কড চয়েস: বিএনপি ‘সহজ গঠনমূলক নির্বাচন’ চায়, এই পদ্ধতিকে অকার্যকর বলে মনে করছে।
তবে তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে আংশিক সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে ‘আস্থা ভোট, নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন’ এ দলীয় অবস্থান বজায় রাখার শর্তে।
বাস্তবায়ন ছাড়া সই নয়
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্মত হয়েছে বেশিরভাগ সংস্কারে, তবে আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা ঘোষণাপত্রে সই দেবে না।
জামায়াত চায় নারী সরাসরি মনোনয়ন বাতিল করে সংসদে ১০০টি নারী আসন বাড়িয়ে প্রোপোরশনাল নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হোক।
এনসিপি নারী প্রতিনিধিত্ব ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় গণপরিষদ ভিত্তিক সাংবিধানিক সংশোধন কাঠামো। দুই দলই জোর দিয়েছে আইনি রূপ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ছাড়া সনদ কোনো অর্থ বহন করবে না।
জুলাই ঘোষণাপত্র
সরকার জানিয়েছে, ৫ আগস্ট বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ চত্বরে এক বিশেষ আয়োজনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা বলেছেন, ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলিল হবে, নাকি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসম্পন্ন সাংবিধানিক রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এ ঘোষণাপত্রটি যদি কেবল রাজনৈতিক অনুচ্চার প্রতিশ্রুতি হয়, তবে এর সাংবিধানিক গুরুত্ব থাকবে না। আমরা চাই, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হোক।”
ঘোষণাপত্রে কী আছে
খসড়া ঘোষণাপত্রে মোট ২৬টি দফা রয়েছে।
প্রথম ২১টি দফা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, গণআন্দোলনের ঐতিহাসিকতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিবরণ
শেষ ৫টি দফা: গুম-খুনের বিচারের অঙ্গীকার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি
এতে ২০২১–২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি রাখা হয়েছে।
বিকল্প পথে বাস্তবায়ন: আইন, অধ্যাদেশ, গণভোট?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণাপত্র কার্যকর করতে হলে থাকতে হবে একটি আইনি ভিত্তি। সম্ভাব্য ৩টি পথ:
১. রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ: জরুরি ভিত্তিতে এটি রূপান্তর করা যায়
২. সংসদীয় বিল: আলোচনা শেষে সংসদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে স্বীকৃতি
৩. গণভোট: জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ের মাধ্যমে সাংবিধানিক অনুমোদন
তবে এর কোনটি হবে, এখনো পরিষ্কার নয়। সরকার বা কমিশন এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা কাটাতে জুলাই সনদ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে তা বাস্তবায়নে একটি স্পষ্ট রূপরেখা দরকার।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “সবার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে। যারা বর্তমানে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ, তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “এটি ইতিহাসের এক মোড়লগ্ন মুহূর্ত। আমরা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে সনদ চূড়ান্ত করেছি, তা ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ।”
৫ আগস্টের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এতে থাকবেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা, নিহতদের পরিবার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে এই ঘোষণা কি কেবল অতীত স্মরণে একটি আয়োজিত মুহূর্ত, নাকি বাস্তব রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রাশিদুল হক বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ ও তার ভিত্তিতে প্রস্তুত ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। যতি এটি আইনি কাঠামোতে প্রণীত হয়। সব রাজনৈতিক দল সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তব বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। অন্যথায়, এই সনদ কেবল ঐতিহাসিক একটি প্রতীক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাহক হয়ে উঠবে না।”
ঢাকা/এএএম/ইভা