কানাডায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড, ভারতীয় বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার দাবি
Published: 10th, August 2025 GMT
গত ১৪ মে তারিখের কথা। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্রাম্পটনের বাসিন্দা হারজিৎ সিং ধাড্ডা মাথায় সবুজ রঙের পাগড়ি বেঁধে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন এবং মেয়ে গুরলীনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেন। এরপর টরন্টোর ব্যস্ত পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে মিসিসাগায় তাঁর কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দেন। এটাই ছিল বাবার সঙ্গে গুরলীনের শেষ দেখা।
এদিন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৫১ বছর বয়সী হারজিৎ কর্মস্থলের গাড়ি পার্কিংয়ে পৌঁছানোর পর দুই ব্যক্তি তাঁকে আটকে ফেলেন। একজন হারজিতের শরীরে একাধিক গুলি করেন এবং একটি চুরি করা গাড়িতে করে পালিয়ে যান। আহত অবস্থায় হারজিৎকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে মারা যান তিনি।
কয়েক ঘণ্টা পর দুই ব্যক্তি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে হারজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেন। তাঁরা নিজেদের ভারতের গুজরাট রাজ্যের সাবরমতি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নেতৃত্বাধীন একটি অপরাধী গ্যাংয়ের সদস্য বলে দাবি করেন।
হারজিৎ হত্যার এক মাসের মধ্যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে শহরের এক ব্যবসায়ী এবং হারজিতের শহর ব্রাম্পটনের আরেক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁরা দুজনও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব হত্যাকাণ্ড ভারতের অপরাধী চক্রগুলোর কানাডায় ছড়িয়ে পড়ার ভয়ংকর নজির। লরেন্স বিষ্ণোই নামের ভারতভিত্তিক একটি কুখ্যাত চক্র এসবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কানাডায় প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ বাস করেন; যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ১ শতাংশ। ভারতের বাইরে কানাডায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিখের বসবাস। ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় বাহিনী পাঞ্জাব রাজ্যের একটি অংশ নিয়ে ‘খালিস্তান’ নামে আলাদা শিখ রাষ্ট্র গঠনের দাবিদারদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালায়। এতে অনেক শিখ কানাডায় চলে যান।এখন কানাডার অনেক রাজনৈতিক নেতা বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি তুলেছেন।
‘জননিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে’
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মুখ্যমন্ত্রী ডেভিড ইবি গত ১৭ জুন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করা হলে পুলিশ এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারবে এবং এ ধরনের তৎপরতা থামাতে পারবে।
বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা উল্লেখজনক মাত্রায় বাড়বে। তখন তারা সন্ত্রাস–সম্পর্কিত অভিযোগ তুলতে পারবে, গ্যাংয়ে লোক নিয়োগ বা আর্থিক সাহায্য দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যাবে এবং তাদের ওপর নজরদারির ক্ষমতাও বাড়বে।অমরনাথ অমারাসিংহাম, অন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকগত জুলাইয়ে আলবার্টার মুখ্যমন্ত্রী ড্যানিয়েল স্মিথও একই ধরনের দাবি করেন। স্মিথ ১৪ জুলাই এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, বিষ্ণোই গ্যাংকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষমতা পাবে। এর মধ্য দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করে অপরাধী চক্রের তৎপরতা ঠেকাতে ও কার্যকরভাবে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে।
আলবার্টার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী মাইক এলিস আল–জাজিরাকে বলেন, আলবার্টা প্রদেশ এবং কানাডার অন্যান্য জায়গায় চাঁদাবাজি ও নিশানাভিত্তিক সহিংসতার ঘটনায় যে বিষ্ণোই গ্যাং জড়িত, সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য আছে। এ অপরাধী চক্রটির মূল উৎস ভারত। এ চক্র কেন বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিশানা করছে, তা জানতে তদন্ত চলছে।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্থানীয় পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির আইনপ্রণেতা জোডি টুর এবং ব্রাম্পটনের মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউনও বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।
কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, তারা এসব দাবি ভালো করে খতিয়ে দেখছে। কানাডার অপরাধ দমনবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রুবি সাহোতা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আগেও অপরাধী চক্রগুলোকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা করার নজির আছে। আর আমি চাই, সবকিছু তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাইয়ের ভিত্তিতে করা হোক।’
২০২৩ সালের ১৮ জুন শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে কানাডায় একটি শিখ মন্দিরের বাইরে হত্যা করা হয়। এরপরই লরেন্স বিষ্ণোই ও তাঁর গ্যাং কানাডা-ভারত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে চলে আসে।রুবি সাহোতার মতে, কোনো গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার মতো তথ্যপ্রমাণ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চরমপন্থাবিষয়ক গবেষক ও অন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অমরনাথ অমারাসিংহাম বলেন, বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা উল্লেখজনক মাত্রায় বাড়বে। তখন তারা সন্ত্রাস–সম্পর্কিত অভিযোগ তুলতে পারবে, গ্যাংয়ে লোক নিয়োগ বা আর্থিক সাহায্য দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যাবে এবং তাদের ওপর নজরদারির ক্ষমতাও বাড়বে।
২০২৪ সালে কানাডার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছিলেন, বিষ্ণোই গ্যাং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে কাজ করছে এবং তারা কানাডার মাটিতে ভারত সরকারের বিরোধীদের নিশানা করছে।
অমরাসিংহাম মনে করেন, বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করলে তা ভারতসহ অন্য মিত্র দেশকে শক্ত বার্তা দেবে যে কানাডা আন্তর্জাতিক হুমকিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে বিশ্বের অন্য মিত্র দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ আরও বাড়বে।
কাজে থাকলে কিছু সময়ের জন্য গ্যাংয়ের ভয় ভুলে থাকতে পারি। কিন্তু কাজ শেষ হলেই আবার সেই ভয় এসে ভর করে।সতীশ কুমার, কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীএই গবেষক আরও বলেন, সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হলে কানাডা ইন্টারপোলের মতো সংস্থার মাধ্যমে সংগঠনটির সদস্যদের গ্রেপ্তারের অনুরোধ আরও জোরালোভাবে জানাতে পারবে। এতে গ্যাংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, ভ্রমণ বিধিনিষেধ আরোপ, ভিসা বাতিল, আর্থিক লেনদেন বন্ধসহ সহযোগী ও অর্থদাতাদের কালো তালিকাভুক্ত করার সুযোগ তৈরি হবে।
গোষ্ঠীটিকে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু বাধা থাকতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অমরাসিংহাম। তাঁর মতে, বিষ্ণোই গ্যাং অপরাধমূলক কাজে জড়িত হলেও তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আদর্শগত কোনো লক্ষ্য নেই। কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়।
নিহত হরদীপ সিং নিজ্জরের ছবি ধরে রেখেছেন একটি শিখ সংগঠনের সদস্য.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ল ক ভ ক ত কর র ক ষমত মন ত র অপর ধ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর ভোটাধিকার বাতিল চেয়ে যাজকদের মন্তব্যে হেগসেথের সমর্থন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট
নারীর ভোটাধিকার নিয়ে যাজকদের করা নেতিবাচক মন্তব্যের ভিডিও সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। এতে সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
ভিডিওতে একটি খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদী গির্জার একাধিক যাজক মত দেন, নারীদের আর ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে এক্সে পুনঃপ্রকাশ করা হেগসেথের পোস্টে দেখা গেছে, তিনি খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদী এক যাজকের সঙ্গে গভীর ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখেন, যাঁর ধর্ম ও নারীর ভূমিকা বিষয়ে চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি আছে।
হেগসেথ তাঁর পোস্টে সিএনএনের প্রায় সাত মিনিটের এক প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করেন। কমিউনিয়ন অব রিফর্মড ইভানজেলিক্যাল চার্চেসের (সিআরইসি) সহপ্রতিষ্ঠাতা ডগ উইলসনের কর্মকাণ্ড নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিএনএন। প্রতিবেদনে উইলসনস চার্চের একজন যাজক মার্কিন সংবিধান থেকে নারীর ভোটাধিকার বাতিলের পক্ষে মত দেন। অন্য আরেকজন যাজক বলেন, তাঁর প্রত্যাশিত ‘আদর্শ সমাজে’ মানুষ পরিবারভিত্তিক ভোট দেবে। ভিডিওতে একজন নারী সদস্যকেও বলতে শোনা যায়, তিনি তাঁর স্বামীর প্রতি অনুগত।
ভিডিওটি পোস্ট করে হেগসেথ লিখেছেন, জীবনের সব ক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্মের বিধান প্রভাব বিস্তার করবে। হেগসেথের পোস্টে ১২ হাজারের বেশি লাইক ও ২ হাজারের বেশি শেয়ার হয়। কিছু ব্যবহারকারী ভিডিওতে থাকা যাজকদের মতের সঙ্গে একমত হলেও অনেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তবে প্রগ্রেসিভ ইভানজেলিকাল সংগঠন ‘ভোট কমন গুড’-এর নির্বাহী পরিচালক ও যাজক ডগ পাগিট বলেন, ভিডিওতে প্রচারিত মতামত শুধু ‘খ্রিষ্টানদের এক ক্ষুদ্র প্রান্তিক অংশের’ ধারণা এবং হেগসেথের এগুলো প্রচার করাকে তিনি ‘খুবই বিরক্তিকর’ বলে উল্লেখ করেন।
পেন্টাগনের প্রধান মুখপাত্র শন পারনেল গত শুক্রবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, হেগসেথ এমন ‘একটি চার্চের গর্বিত সদস্য’, যা সিআরইসির সঙ্গে যুক্ত। তিনি উইলসনের অনেক লেখা ও শিক্ষাকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেন।
গত মে মাসে হেগসেথ তাঁর ব্যক্তিগত যাজক ব্রুকস পোটেইগারকে পেন্টাগনে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি সরকারি কর্মঘণ্টায় একাধিক খ্রিষ্টান প্রার্থনাসভার প্রথমটি পরিচালনা করেন। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মী ও সামরিক সদস্যরা বলেন, তাঁরা এ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র সরকারি ই–মেইলে পেয়েছিলেন।
সিএনএনের প্রতিবেদনে উইলসন বলেন, ‘আমি এ দেশকে একটি খ্রিষ্টান দেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং চাই বিশ্বও খ্রিষ্টান বিশ্ব হোক।’