ছবি: ফেসবুক থেকে

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আয়ের ভরসা নারী শ্রমিক, সুরক্ষায় শূন্যতা

অপারেটর হিসেবে কারখানায় পোশাক তৈরির সেলাইয়ের একেবারে প্রাথমিক কাজটি করেন ৩২ বছর বয়সী রুপা আক্তার। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকেন কারখানায়। বেতন পান ১৫-২০ হাজারের মধ্যে। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারি পরীক্ষায় রক্তে ইনফেকশন ধরা পড়ে তার। 

চিকিৎসক টানা কয়েক সপ্তাহ পরামর্শ নিতে বলেছেন, তবে ছুটির দিন ছাড়া কারখানা কামাই দেওয়ার সুযোগ নেই তার। কামাই দিলেই কাটা যাবে বেতন। শরীরে অসুস্থতা নিয়েই তাই নিয়মিত কারখানায় যেতে হচ্ছে থাকে। আর চিকিৎসার বাড়তি খরচের চাপে পড়ে দিশাহারা তিনি।

শুধু রুপা আক্তার নয়, পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারী শ্রমিকদের প্রায় সবার গল্প প্রায় একই রকম।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমই-এর তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেজ অনুসারে) (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন।

এরমধ্যে শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ইপিজেডে ৯০টিসহ সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অঞ্চলে মোট ৫৫৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে বিজিএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৪০১টি এবং বিকেএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৮টি। এসব কারখানায় শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকের বেশিই নারী শ্রমিক। পোশাক কারখানার আয়ের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখলেও নারীদের সুরক্ষার সঙ্কট রয়েছে।

কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বেশিরভাগ শ্রমিকই মানবেতর জীবনযাপন করেন। রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি পর্যায়ে সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পোশাক খাতে কাজ করা প্রতি ১০ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ৬ জন কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হন। বিশেষ করে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ করা, গরম পরিবেশ, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার অভাব তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে তোলে।

এছাড়া ব্র্যাকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, নারী শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই সন্তান লালন-পালনে প্রতিবেশীর সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানকে গ্রামে রেখে শহরে কাজ করতে হয়। এতে শিশুর বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়, আবার মায়ের মানসিক চাপও বাড়ে।

সাভারের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক রুপা আক্তার বলেন, “প্রতিদিন সকাল আটটায় কারখানায় যেতে হয়। সেখানে টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করি। যা বেতন পাই, এই টাকায় সংসার, স্বামী-সন্তান আর অসুস্থ মাকে নিয়ে কোনও রকমে দিন চলে যায়। কিছু দিন ধরে আমি অসুস্থ। চিকিৎসার খরচ নিজেকে বহন করতে হচ্ছে। ঘর ভাড়া, খাওয়া, বাচ্চার পড়ার খরচ দিয়ে নিজের চিকিৎসার টাকা থাকে না।”

তিনি বলেন, “আমরা কাজ করি, কিন্তু বিপদে কেউ পাশে থাকে না। চাকরি করতে গিয়ে অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদেরই সব খরচ বহন করতে হয়। পরিবার-পরিজনই একমাত্র ভরসা।”

প্রায় সাত বছর ধরে আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় কর্মরত তানিয়া আক্তার বলেন, “সকালে বের হলে বাচ্চাদের দেখার কেউ থাকে না। পাশের বাসার খালার কাছে রেখে যাই। কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হলে বা ছুটি চাইলে অনেক সময় সমস্যা হয়। সন্তান ছোট বলে মাঝেমধ্যেই আমাকে বকা শুনতে হয়।”

তিনি বলেন, “ভাড়া বাসায় থাকি, মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া। তার ওপর ওষুধপত্র আর বাচ্চাদের খরচ জুটাতে হিমশিম খেতে হয়।”

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ও সোয়েটার্স ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, “নারী শ্রমিকরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। দুর্ঘটনা হলে মালিকরা দায় নিতে চায় না। অথচ এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব। শ্রম আইন প্রয়োগে কারখানাগুলোতে জবাবদিহি না থাকলে সুরক্ষা আসবে না।”

এই শ্রমিক নেতা বলেন, “অসংখ্য নারী শ্রমিক প্রতিদিন কাজের ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝামেলা আর পারিবারিক চাপে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ গড়ে তুললেও নিজেরা নিরাপদ নন। পরিবারের সহায়তা হয়তো সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। নারী শ্রমিকদের প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উভয় দিকেই টেকসই উদ্যোগ নিতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাভারের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা বলেন, “আমরা শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক কারখানায় বীমা সুবিধাও চালু করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও উৎপাদন ব্যয় সামলাতে গিয়ে সব কারখানায় একই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “এখানে সরকারের ভূমিকা প্রধান। বিজিএমইএ এর করার কথা, তাদের দেখার কথা। দেশে আগে যে কারখানা ছিল, সেগুলোতে হাসপাতাল, স্কুল সবই থাকতো। এখন কেন নাই, সেটা দেখা, শ্রম আইনের মধ্যে যাতে এগুলো কার্যকর হয়, তা দেখার এক দিকে দায়িত্ব বিজিএমইএ এর ও সরকারের। সরকারের অবহেলা বা শ্রম পরিদর্শক যারা আছে, তাদের ঘাটতির কারণে এটা কার্যকর হচ্ছে না। তারপর ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। সেটা হলে শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তি থাকলে তা বাস্তবায়িত হতো। সেটিও একটি দুর্বলতা আছে। সবমিলিয়ে হচ্ছে না। আর এখানেই উত্তরণের উপায় লুকিয়ে।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ