বান্দরবানের বেইলি ব্রিজগুলো যেন একেকটি মৃত্যু ফাঁদ
Published: 20th, September 2025 GMT
বান্দরবান জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে অসংখ্য ছোট-বড় বেইলি সেতু রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে এসব সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষের চলাচল এসব সেতু দিয়ে।
আশির দশকে নির্মিত সেতুগুলোতে পাঁচ টনের বেশি যান চলাচল নিষেধ থাকলেও নিয়ম ভঙ্গ করে অতি ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। দ্রুত সংস্কার বা নতুন স্থায়ী সেতু নির্মাণ না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
জেলা সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্যমতে, সাত উপজেলায় বর্তমানে ১১৪টি বেইলি সেতু রয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, থানচি এবং বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কে সড়ক ও জনপদ বিভাগের অধীনে রয়েছে ৬৬টি সেতু। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে ৫৪টি।
স্থানীয়রা জানান, আশির দশকে নির্মিত পুরানো বেইলি সেতুগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। তাই সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেতুগুলোতে পাঁচ টনের বেশি ভারী গাড়ি চলাচল নিষেধ করা হয়েছে। তবে এ নিয়ম মানছেন না কেউই।
প্রতিদিন ২০ টনের বেশি ওজনের কাঠবোঝাই ট্রাক, বাঁশ, বালি ও ইটবাহী ট্রাক চলাচল করছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি সেতুগুলো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। ঘটে যেতে পারে যেকোনো ধরনের বড় দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও সেতুর লোহার পাতাটন উঠে গেছে, কোথাও দেবে গেছে। আবার কোথাও গাছ দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে। কিছু সেতুর স্প্রিং পর্যন্ত খুলে পড়েছে। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন হাজারো মানুষ।
সিএনজি চালক সরোয়ার আলম বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি সেতুর পাশে লেখা থাকে পাঁচ টনের বেশি গাড়ি চলাচল নিষেধ। কিন্তু প্রতিদিনই ১০-২০ টনের গাড়ি চলাচল করছে। এত ভারী গাড়ি বেইলি সেতুগুলোতে নিরাপদ নয়।”
পর্যটকবাহী চাঁদের গাড়ির চালক মংক্যনুং মারমা বলেন, “এমনিতেই সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর গাছ, বাঁশ, বালি ও ইটবোজাই ভারি ট্রাক গেলে আরো বেশি ঝুঁকি বেড়ে যায়। পর্যটক নিয়ে গাড়ি চালাতে আমাদেরও অনেক কষ্ট হয়।”
স্থানীয় বাসিন্দা মো.
চাঁদের গাড়ি চালক মো. জসীম বলেন, “প্রতিবার গাড়ি নিয়ে সেতু পার হওয়ার সময় বুকটা ধড়ফড় করে। কয়েক মাস আগেও রুমা-থানচি সড়কের তিন মাইল এলাকায় সেতুর এক পাশ দেবে গিয়ে চার ঘণ্টা যোগাযোগ বন্ধ ছিল। প্রতিবছরই কোনো না কোনো ব্রিজ দেবে যায়। বৃষ্টির সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হয়ে যায়। বেইলি ব্রিজগুলো ভেঙে আরসিসি ব্রিজ করলে মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে।”
এ বিষয়ে বান্দরবান সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “বান্দরবান সড়ক বিভাগের অধীনে ৬৬টি বেইলি সেতু রয়েছে। বেশ কিছু সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা প্রতিবছর সেতুগুলোকে মেরামত করি। সেতুগুলোর ক্ষেত্রে পাঁচ টনের অধিক ভারি গাড়ি চলাচল করার কথা না কিন্তু নানান বাস্তবতার কারণে এসব সেতুতে ভারি গাড়ি চলাচল করছে, ঝুঁকিও বেশি বেড়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “এই বেইলি সেতুগুলোকে স্থায়ী সেতুতে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এরইমধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় দুটি সড়কে ২২টি বেইলি সেতুর পরিবর্তে আরসিসি স্থায়ী সেতু নির্মাণের কাজ করা হবে। অবশিষ্ট সেতুগুলোর জন্য চট্টগ্রাম জোন থেকে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি অনুমোদন করলে ধাপে ধাপে সব বেইলি সেতুর পরিবর্তে স্থায়ী আরসিসি সেতু নির্মিত হলে এ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগটা নিরবিচ্ছিন্ন থাকবে এবং জনগণের দুর্ভোগ কমে আসবে। সড়কের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে।”
ঢাকা/চাইমং/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ন দরব ন টন র ব শ চ টন র র ণ হয় সড়ক ও
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।
বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।
সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।
কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।
একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।
শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক