মুন্সিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শতবর্ষী একটি খাল ভরাট করে নালা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খালটি একটি অংশ অস্তিত্ব হারিয়েছে। অবশিষ্ট অংশও দখল হওয়ার পথে।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খালটি মুন্সিগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের সড়ক ঘেঁষে শুরু হয়েছে। খালটি পাঁচঘরিয়াকান্দি ও মুন্সিরহাট দিয়ে রজতরেখা নদীতে মিশেছে। খালটি দৈর্ঘ্যে ৬০০ মিটারের বেশি। স্থানভেদে চওড়া ৩০-৪০ ফুট। 

অভিযোগ উঠেছে, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান খালের একটি অংশ দখল করে বহুতল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সে বাড়িটি রক্ষা করতেই পৌরসভা কর্তৃপক্ষ খালটি ভরাট করে নালা নির্মাণ করে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে খালের অংশ মাটি দিয়ে ৪-৫ বছর আগে পূর্ব পাড়ের লোকজন ভরাট করেছে। সেখান থেকে প্রায় দুই শ ফুট দক্ষিণে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হাসানের বাড়ি। সে অংশ থেকে বছরখানেক আগে খালের মধ্যখানে ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি আরসিসি নালা নির্মাণ করা হয়েছে। নালার দুই পাশে খালের যে অংশ ছিল তাতে মাটি ও ময়লা–আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এতে নালা নির্মাণ করা অংশে খালটির সম্পূর্ণ অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।

গত সরকারের আমলে পৌরসভার সভায় সবার সিদ্ধান্তে খালের ওপর নালা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আমার কাজ হচ্ছে পৌরসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা।  মোশাররফ হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা

খালপাড়ের বাসিন্দা পাঁচঘরিয়াকান্দি এলাকার অন্তত ৮-১০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, খালটি শত বছরের পুরোনো। একসময় বড় বড় নৌকা চলত। চরকেওয়ার, আধারা, বাংলাবাজার ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের মানুষ এ খাল পাড়ি দিয়ে শহরে আসত। খালের পানি গোসল, রান্নাবান্নাসহ গৃহস্থালির সব ধরনের কাজে ব্যবহৃত হতো। খালটি দিয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর ও কলেজপাড়া এলাকার বন্যা–বৃষ্টির পানি নামত। খাল ঘেঁষে সড়ক নির্মাণের পর নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে শুরু হয় দখল–দূষণ। ফলে খালের পানি গৃহস্থালির ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। তবে অন্যান্য কাজে ব্যবহার হতো। দুই বছর আগেও বর্ষায় কাদাযুক্ত ঘোলা জোয়ারে পানি ঢুকত খালটিতে। তবে খালের উৎসমুখসহ বিভিন্ন স্থান দখলে খালটি এখন ডোবায় পরিণত হয়েছে। যে যার মতো ভরাট ও দখল করেছে। 

পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৪ এপ্রিল ৮৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৪০ টাকা ব্যয়ে খালটির ওপর ১৫০ মিটার আরসিসি নালা নির্মাণ করা শুরু হয়। নালাটি নাজমুল হাসানের বাড়ি থেকে শুরু হয়ে আইনজীবী সুমনের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।

এটি অত্যন্ত অপরিকল্পিত, আত্মঘাতী, ভয়ংকর রকমের পরিবেশবিরোধী। খালকে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন হিসেবে ব্যববহার করা দরকার।  মজিবুর রহমান, সভাপতি, পরিবেশ আন্দোলন, মুন্সিগঞ্জ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার এক কর্মী বলেন, কয়েক বছর আগে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নাজমুল হাসানের বহুতল বাড়ি নির্মাণ করতে খালটির পূর্ব পাশ ভরাট করে। খালের পশ্চিম পাশে শহরে প্রবেশের মূল সড়ক। নাজমুল হাসান সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মোহাম্মদ ফয়সালের ঘনিষ্ঠ হিসবে পরিচিত ছিলেন। মূলত নাজমুল হাসানের বাড়িটি রক্ষায় এবং বাড়ি থেকে সরাসরি সড়কে ওঠার ব্যবস্থা করতেই পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নালা নির্মাণের প্রকল্প নেয়। 

স্থানীয় এজাল হক নামে (৮০) এক ব্যক্তি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর লোকজন খাল দখল করে স্থাপনা ও নালার নির্মাণকাজ শুরু করেছিল। গত বছর তারা পালিয়ে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম খালটি দখলমুক্ত হবে, ড্রেন নির্মাণ বন্ধ হবে। বাস্তবতা হলো পৌরসভার লোকজন শেষ পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ করে খালটি শেষ করে দিল।’

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে পৌরসভার সভায় সবার সিদ্ধান্তে খালের ওপর নালা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আমার কাজ হচ্ছে পৌরসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। সে ক্ষেত্রে আমি তদারকি করেছি।’

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক মৌসুমী মাহবুব গত ৩১ জুলাই বলেছিলেন, তিনি খালের ওপর নালা নির্মাণের কাজের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোনো নির্দেশনা দেননি। পৌরসভার সব চলমান কাজ শেষ করতে বলেছিলেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো এবং মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, এখনো বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। উল্টো ভরাট কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়েছে। ড্রেনের শেষ প্রান্তে মাটি ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। 

এক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই শহরে প্রধান সড়কজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। শহরের সুপারমার্কেট, ফার্নিচার পট্টি, বাজার, হাসপাতাল ও থানা সড়ক জমে থাকছে হাঁটুসমান পানি। শহর এবং শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো ভরাটের ফলে এসব জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় ব্যক্তিরা।  

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি হরগঙ্গা কলেজের পেছনে খালটি ভরাট করে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত অপরিকল্পিত, আত্মঘাতী, ভয়ংকর রকমের পরিবেশবিরোধী। খালকে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন হিসেবে ব্যববহার করা দরকার।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ম ণ কর প রসভ র স ভর ট ক পর ব শ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারের নীরবতার কারণেই সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আক্রমণ হচ্ছে

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। সরকারের নীরবতার কারণেই সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার এমন আক্রমণ হচ্ছে। এ নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় দুর্গাপূজায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে।

‘আসন্ন দুর্গাপূজার নিরাপত্তা, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর, বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্রের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ সনাতন পার্টি।

সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সনাতন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সুমন কুমার রায়। তিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করেন। লিখিত বক্তব্যে সুমন কুমার বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি উপেক্ষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বৈষম্যের শিকার।

এ সময় আসন্ন দুর্গাপূজায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তাসহ তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানান সুমন কুমার রায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ অন্যদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন তিনি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দুর্গাপূজার নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে সাহায্য চাইতে হয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী মহাসচিব পলাশ কান্তি দে বলেন, দুর্গাপূজার মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। গত সাত দিনে ছয়টি জেলায় দুর্গাপ্রতিমার ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। সরকারের নীরবতায় এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুবিষয়ক সম্পাদক মকবুল হোসাইন বলেন, পূজামণ্ডপে কেউ অপরাধ করলে তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি দেশে শান্তি, সম্প্রীতি, শৃঙ্খলা, মানবতাকে রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন খান বলেন, দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি দাবি নয়, এটি অধিকার। রাসুলের (সা.) বাণী মেনে চললে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নেই।

গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, চারদিকে যখন প্রতিমা ভাঙা শুরু হয়ে যায়, তখনই বুঝবেন যে দুর্গাপূজা আসছে। আগামী দুর্গাপূজায় আর যেন এমন একটি ঘটনাও না ঘটে। বাংলাদেশে তাঁরা কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ধর্মীয় উৎসব করতে চান না। সেটা ঈদে মিলাদুন্নবী হোক, বৌদ্ধপূর্ণিমা হোক বা দুর্গাপূজা। জনগণের সমর্থন নিয়ে নিরাপদে সমস্ত পূজা, পার্বণ, উৎসব পালন করতে চান তাঁরা।

পুলিশ, আনসার দেখে ভক্তরা বেশ ভয় পেয়ে যান উল্লেখ করে সুব্রত চৌধুরী বলেন, এখান থেকে বেরোনোর জন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে দুর্গাপূজায় দুই কোটি টাকা অনুদান দিত। অন্তর্বর্তী সরকার গত বছর সেই অনুদান চার কোটি টাকা করেছে। এ বছর পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, ‘অন্যায় হচ্ছে। কারা প্রশাসনে ঢুকে আছে, আপনারা জানেন। এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু করার নেই। গণতন্ত্রই পারে সব জায়গায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে।’

হাসান শাহ সুরেশ্বরী দীপু নুরি বলেন, আজকের দিনে এসে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। যাঁরা সুফিবাদী, মাজারপন্থী, অলি-আউলিয়াপন্থী, তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকেও অধিক সংখ্যালঘু। এই সরকারের আমলে হিন্দু সম্প্রদায় যতটুকু আক্রান্ত হয়েছে, তার চেয়ে তাঁরা (সুফিবাদী, মাজারপন্থী, অলি-আউলিয়াপন্থী) বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। মাজারগুলো উৎসবের মতো করে ভাঙা হচ্ছে। এখন তাঁরাই সাচ্চা মুসলমান, যাঁরা অন্য ধর্মকে নিয়ে বেশি বিষোদ্‌গার করতে পারেন। হাসান শাহ সুরেশ্বরী দীপু নুরি বলেন, যারা (মাজারপন্থী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী, খেলাধুলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য) সম্ভাব্য ভুক্তভোগী, তাদের একটি যোগসূত্র তৈরি করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ