ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব গ্রাহকের আস্থা রক্ষা ও সতর্কভাবে ঋণ অনুমোদন করা। কিন্তু রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ পদে থাকার সময় উল্টো কাজ করেছেন বলে সাম্প্রতিক এক তদন্তে উঠে এসেছে। ব্যাংকটির এমডি থাকার সময় কাগুজে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সেটির নামে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। ঋণ ছাড়ের তিন মাসের মধ্যেই সেই টাকার ৮৭ লাখ এমডির নিজের ও তাঁর ছেলের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরিত হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে—এই পাঁচ মাসের মধ্যেই এই অনিয়ম ঘটে। শুধু তা–ই নয়, রূপালী ব্যাংকের অন্য গ্রাহকের টাকাও তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের হিসাবে জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় এমন চিত্র পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিশেষ পরিদর্শনে এমন চিত্র ধরা পড়ার পর তাঁর বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে রূপালী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে বিএফআইইউ।

বিএফআইইউ যখন এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে, তখন তিনি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। সেখান থেকে তিনি গত জুলাইয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেন।

আমি ১০ বছরে ৭ কোটি টাকা শুধু বেতন পেয়েছি। এ ছাড়া বাড়িভাড়া পেয়েছি ২ কোটি টাকা ও ১ কোটি টাকা পেনশন পেয়েছি। এসব টাকা বিভিন্ন সময়ে আমার চাচাতো ভাইকে ধার দিয়েছি। এসব টাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের হিসাবে রাখা হয়। আমার সব আয় বৈধ। যে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ হয়েছিল, সেই টাকা শোধ করা হচ্ছে।—ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, সাবেক এমডি, রূপালী ব্যাংক।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোনালী ও রূপালী—দুই বড় সরকারি ব্যাংকের এমডি ছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। বৃহৎ ব্যাংক পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল।

ঋণের টাকা নিজেদের হিসাবে

মাস করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার ৯ নং বক্স নগর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি বাণিজ্যিক লাইসেন্স সংগ্রহ করে। এরপর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়ে রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় একটি হিসাব খোলে। রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখাটি প্রধান কার্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায়। এমডি বসতেন চতুর্থ তলায়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় প্রতিষ্ঠানটি ৩ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করে। প্রতিষ্ঠানটি সিসি বা ক্যাশ ক্রেডিট ঋণ চায়, যাতে নগদে উত্তোলন করা যায় বা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা যায়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করেন তৎকালীন এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। এরপর একই বছরের ১৮ মে মাস করপোরেশন থেকে ইশামনি ট্রেড লিংক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৪০ লাখ টাকা পাঠানো হয়। সেদিনই ইশামনি ট্রেড লিংক ৩৭ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেয় জুন্নুন সাফওয়ানের নামে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার একটি হিসাবে। পরদিন অর্থাৎ ১৯ মে মাস করপোরেশন ৫০ লাখ টাকা পাঠায় ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের নামে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার একটি হিসাবে। জুন্নুন সাফওয়ান হলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের ছেলে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমডি ও তাঁর চাচাতো ভাই ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তবে প্রকৃত সুবিধাভোগী ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ নিজে। রূপালী ব্যাংকের এই ঋণ এখন খেলাপির তালিকায়। ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ইসলামী ব্যাংকের পদ ছেড়ে দেওয়ার পর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে।

তবে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১০ বছরে ৭ কোটি টাকা শুধু বেতন পেয়েছি। এ ছাড়া বাড়িভাড়া পেয়েছি ২ কোটি টাকা ও ১ কোটি টাকা পেনশন পেয়েছি। এসব টাকা বিভিন্ন সময়ে আমার চাচাতো ভাইকে ধার দিয়েছি। এসব টাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের হিসাবে রাখা হয়। আমার সব আয় বৈধ। যে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ হয়েছিল, সেই টাকা শোধ করা হচ্ছে।’

সুদ মওকুফ করেও সুবিধা নেন এমডি

নথিপত্র অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংক ২০১২ সালে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের (হানিফ ফ্লাইওভার) ৫৫০ কোটি টাকার শেয়ারে বিনিয়োগ করে। ২০২০ সালে তৎকালীন এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটির ৩৬৪ কোটি টাকার লভ্যাংশ মওকুফ করা হয়। যা নজিরবিহীন ও সন্দেহজনক বলে অভিহিত করেছে বিএফআইইউ। তবে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও ব্যাংকগুলোর মধ্য একটি চুক্তির আওতায় এসব লভ্যাংশ বা সুদ মওকুফ করা হয়।

তবে ২০২৪ সালের ২৭ জুন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের নামে থাকা ইউসিবি ব্যাংকের হিসাবে ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা জমা করে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লভ্যাংশ মওকুফের পর তাঁর ব্যক্তিগত হিসাবে ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে অর্থ জমা হওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক। তৎকালীন এমডি ব্যাংকের স্বার্থ না দেখে লভ্যাংশ মওকুফের সিদ্ধান্তটি কোনো আর্থিক লেনদেন বা ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে গৃহীত হতে পারে।

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরি শেষে আমি ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডে যোগ দিই। কর পরিশোধ করার পর ছয় মাসের বেতন তারা একবারে দেয়। সেই ২০ লাখ টাকা আমার হিসাবে দেওয়া হয়। এখানে অনিয়মের কিছু নেই।’

স্ত্রী ও সন্তানদের হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের স্ত্রী মর্জিনা বেগম পেশায় গৃহিণী। তাঁর নামে ২০১৫ সালে ইউসিবি ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা হয়। এরপর হিসাবটিতে বিভিন্ন সময় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা করা হয় এবং ১ কোটি ৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই হিসাবে বিভিন্ন সময় তাঁর স্বামী ও ছেলেদের হিসাব থেকে অর্থ জমা হয়েছে বলে বিএফআইইউর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

এ ছাড়া ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের ছেলে জুন্নুন সাফওয়ানের নামে ইউসিবিতে একটি হিসাব খোলা হয় ২০১৫ সালে। এই হিসাবে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা হয় এবং ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা উত্তোলন হয়। আরেক ছেলে জুনায়েদ জুলকারনায়েন টিয়ানের নামে ইউসিবি ব্যাংকের একটি হিসাবে ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পার্কিং করার জন্য এসব হিসাব খোলা হয়। এসব অপরাধ অর্থ পাচারসংক্রান্ত। গত জুলাইয়ে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদসহ তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগম, দুই পুত্র জুন্নুন সাফওয়ান ও জুনায়েদ জুলকারনায়েন টিয়ান, কন্যা তাসমিয়া তারান্নুম নওমির ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। এরপর ১৭ জুলাই তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, ব্যক্তিগত কারণে এ সিদ্ধান্ত।

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি কাজী মো.

ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন,‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। খতিয়ে দেখা হচ্ছে আর কারা এর সঙ্গে জড়িত। এরপর বিষয়টি সরকারকে জানানো হবে। এই ঋণ এত দিন খেলাপি ছিল। সম্প্রতি ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত ঋণটি পুরোপুরি শোধ হয়ে যাবে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ন ন ন স ফওয় ন ব এফআইইউর ব ভ ন ন সময় ব এফআইইউ পর ব র র এসব ট ক র অন য মওক ফ ন এমড র একট প রথম ইউস ব ইসল ম তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

পিস্তল হাতকড়া ওয়াকিটকি নিয়ে জিপ-হাইয়েসে চলে যাওয়া ব্যক্তি কারা

ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি মহাসড়কে থামান একটি যাত্রীবাহী বাস। তাঁদের হাতে ছিল পিস্তল, হাতকড়া, টর্চলাইট ও ওয়াকিটকি। বাস থেকে চালককে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন তাঁরা। এরপর চলে যান একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস, একটি প্রাইভেট কার ও একটি জিপে করে।

ছয় বছর আগে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতুর দক্ষিণ পাড়ের শিকলবাহা ব্রিজ এলাকায় সংঘটিত এ ঘটনায় গত মাসের শেষের দিকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি সত্য, তবে কারা এ ঘটনায় জড়িত তা শনাক্ত করা যায়নি। ডিবি পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত নয় বলে জানানো হয়েছে এই তদন্ত প্রতিবেদনে। এর আগেও পুলিশ একইভাবে প্রতিবেদন দিয়েছিল।

নিহত চালকের নাম জালাল উদ্দিন। তিনি দিনাজপুর জেলার বাসিন্দা। ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল রাতে তাঁকে হত্যার ঘটনাটি ঘটে। নিহত ব্যক্তির পরিবার ও বাসচালকেরা বলেছেন, ছয় বছরেও এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে না পারা দুঃখজনক। জড়িত ব্যক্তিরা যাঁরাই হোক, শনাক্ত করে তাঁদের বিচারের আওতায় আনার দাবি তাঁদের। তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর আদালতে নারাজি আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী। আগামী ৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদীর উপস্থিতিতে প্রতিবেদনটি গ্রহণের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

দুই দফা তদন্তেও বাসচালক জালাল উদ্দিনের খুনিরা শনাক্ত না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মুছা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

বিচার দূরে থাক, পুলিশ তো ছয় বছরে খুনিদের শনাক্তই করতে পারেনি। গরিব বলে আমরা কি বিচার পাব না? আমার সন্তানেরা কি জানতে পারবে না তাদের বাবার খুনি কারা? ইলিনা খানম, নিহত জালালের স্ত্রী

নিহতের স্ত্রী ইলিনা খানম জানান, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে বড়জন প্রতিবন্ধী, অন্য দুজন এখনো ছোট। স্বামীর মৃত্যুতে অভাব-অনটনে সংসার চলছে তাঁর। তিনি আক্ষেপ করেন, ‘বিচার দূরে থাক, পুলিশ তো ছয় বছরে খুনিদেরই শনাক্ত করতে পারেনি। গরিব বলে আমরা কি বিচার পাব না? আমার সন্তানেরা কি জানতে পারবে না তাদের বাবার খুনি কারা?’

মামলার নথি ও নিহত ব্যক্তির পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জালাল উদ্দিন শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক ছিলেন। ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল রাতে গাড়িতে যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার থেকে গাজীপুরের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তিনি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রামের পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলাসংলগ্ন শিকলবাহা ব্রিজ এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে প্রথমে চারজন লোক তাঁর গাড়ি থামান। এরপর গাড়িতে ইয়াবা রয়েছে দাবি করে তা খুঁজে বের করে দিতে জালাল উদ্দিনকে পিটুনি দিতে থাকেন। সেখানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ের ১০-১২ জন লোক ছিলেন। একপর্যায়ে আহত অবস্থায় চালককে বাসে ফেলে চলে যান তাঁরা। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশের করা লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিহত ব্যক্তির পিঠ, কোমর, হাঁটু ও কবজিতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই জুয়েল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে নগরের কর্ণফুলী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাড়িতে ওঠা লোকজনের হাতে পিস্তল, হাতকড়া ও ওয়াকিটকি ছিল।

হত্যার এ ঘটনা তখন দেশব্যাপী পরিবহনশ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। চালককে হত্যার প্রতিবাদে ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ ৮৮টি রুটে বাস ধর্মঘট পালন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

শুরুতে মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রাম। তদন্ত চলাকালে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাসটির সুপারভাইজার আজিম উদ্দিন ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ব্যক্তি ওই বছরের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। আজিম জবানবন্দিতে বলেন, কক্সবাজার থেকে ২৮ জন যাত্রী নিয়ে রাত আটটার দিকে গাজীপুরের উদ্দেশে তাঁরা রওনা হন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে গাড়িটি শিকলবাহা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছালে চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাড়িটি থামান। তাঁদের হাতে পিস্তল, হাতকড়া, ওয়াকিটকি ও টর্চলাইট ছিল। চালক জালালকে ওই ব্যক্তিরা বলেন, তাঁর কাছে ইয়াবা আছে। ওই সময় চালককে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়। এরপর ওই ব্যক্তিরা চালককে মারধর করতে থাকেন। যাঁরা চালককে মেরেছিলেন, তাঁদের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে হবে। ঘটনার সময় কেউ কারও নাম উচ্চারণ করেননি। পরে চালককে বাসে ফেলে তাঁরা জিপগাড়ি, হাইয়েস ও প্রাইভেট কারে করে চলে গেছেন।

ঘটনার যে প্রত্যক্ষদর্শী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন, তিনি পেশায় দারোয়ান। স্থানীয় ওই ব্যক্তি জবানবন্দিতে বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয়ের ব্যক্তিদের নিয়ে প্রথমে ঘটনাস্থলে একটি মাইক্রোবাস আসে। গাড়ি থেকে চার–পাঁচজন লোক নামেন। এর পরপরই জিপগাড়ি ও প্রাইভেট কার আসে। গাড়িতে আসা ব্যক্তিদের কাউকে তিনি চেনেন না।

তিন বছর তদন্ত শেষে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের তৎকালীন পরিদর্শক সঞ্জয় কুমার সিনহা ২০২২ সালের ১৬ জুলাই আদালতে এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এতে বলা হয়, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মারধরে বাসচালক জালালের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনাস্থল নির্জন হওয়ায় কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। যে গাড়িতে করে জড়িত ব্যক্তিরা পালিয়ে যান, সেই গাড়ির নম্বরও পাওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশের কেউ ঘটনায় জড়িত নয়।

প্রথম এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দেওয়া হলে বাদী নারাজি আবেদন করেন। এরপর আদালত ডিবি পুলিশকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে নগর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক জয়নাল আবেদীনও গত মাসের শেষের দিকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। তিনিও আগের তদন্তকারী কর্মকর্তার মতো চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশ জড়িত নয় উল্লেখ করেন। পুলিশের কেউ ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত না থাকার বিষয়টি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ঘটনার পর চলে যাওয়া হাইয়েস ও জিপ শনাক্ত করা যায়নি। জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, মারধরে মৃত্যু হয়েছে এটি সত্য হলেও জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে না পারায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় দফায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় আদালতে নারাজি আবেদন করবেন জানান মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই জুয়েল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই দফা তদন্তে বলা হচ্ছে চট্টগ্রামের পুলিশ জড়িত নয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে এরা কারা। প্রকাশ্যে ব্যস্ত সড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কোনো অপরাধী চক্রের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে বিচার যেন হয়, এটিই আমাদের চাওয়া।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যুক্তরাজ্যে রাতের বেলায় মসজিদে ঢুকে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা
  • দেশে ফিরেছেন নুরুল হক
  • ৩৪ ছক্কায় দেড় লাখ টাকার বল হারালেন অস্ট্রেলিয়ার হারজাস
  • নির্বাচন না পেছালে ক্রিকেট বর্জনের হুমকি ঢাকার ক্লাবগুলোর
  • দুই কোচের টানাটানির মধ্যে নতুন করে ইয়ামালের চোট
  • চুরির অভিযোগে সালিসের পর গাছে ঝুলছিল যুবকের লাশ
  • ৮৬ বল পর টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা মারলেন জাকের
  • বিজয়ের ব্যাটে খুলনার দাপুটে জয়
  • পিস্তল হাতকড়া ওয়াকিটকি নিয়ে জিপ-হাইয়েসে চলে যাওয়া ব্যক্তি কারা