ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো আখলাকি মূল্যবোধ। এটা কেবল ব্যক্তিগত লাভের ওপর নির্ভর করে না, বরং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। এর মধ্যে ‘ইসার’ একটি অনন্য ধারণা, যা অন্যকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া বোঝায়।

এটাকে শুধু একটি নৈতিক গুণ বললে ভুল হবে, বরং এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি মৌলিক স্তম্ভও বটে। সমাজে সহযোগিতা, ন্যায়বিচার এবং দয়ার পরিবেশ গড়ে তুলতে ‘ইসার’-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

যারা অভাব সত্ত্বেও নিজেদের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়.

.. তারাই সফলকাম।’সুরা হাশর, আয়াত: ৯

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বার্থপরতা এবং সুদভিত্তিক অর্থনীতির বিপরীত এই নীতি। এতে ব্যক্তি তার সম্পদ বা সুবিধা অন্যকে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে, যা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিয়ে আসে।

‘ইসার’ অর্থ কী

ভাষাগত দিক থেকে, ইসার শব্দটি ‘আসারা’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ অগ্রাধিকার দেওয়া বা পছন্দ করা। ইসলামি পরিভাষায়, এটি হলো দুনিয়াবি সুবিধায় অন্যকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া, যাতে ধর্মীয় লাভের আশা থাকে। (আল-জুরজানি, আত-তা’রিফাত, পৃ. ৫৯, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৩)

ইসার অর্জনের জন্য তিনটি উপাদান দরকার: অধিকারের মর্যাদা বোঝা, লোভকে ঘৃণা করা এবং উন্নত চরিত্রের প্রতি আকাঙ্ক্ষা। (খালিদ সা’দ আন-নাজ্জার, আল-ইসার লুগাত আল-উজমা, ইসলামওয়েব, ২০১৫)।

ইসার সাধারণ দানশীলতা থেকে আলাদা। ইসার হলো নিজের দরকার সত্ত্বেও অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া। (ইবনে কাইয়িম আল-জাওজিয়্যাহ, মাদারিজ আস-সালিকিন, ২/২৬৭-২৬৮, দার আল-কিতাব আল-আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৬)।

আরও পড়ুনসন্তানদের দৃঢ়চেতা মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার উপায়০৮ আগস্ট ২০২৫‘ইসার’ কেন গুরুত্বপূর্ণ

ইসলামে ইসার উদারতার সর্বোচ্চ স্তর। আল্লাহ তাআলা কোরআনে মদিনার আনসারদের প্রশংসা করে বলেন: ‘যারা নিজেদের ওপর অভাব সত্ত্বেও অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়... তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)

মহানবী সদলবলে মক্কায়ে সবকিছু ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলে আনসাররা তাদের জন্য নিজেদের সম্পদ ভাগ করে দিয়েছিলেন, যা ইসারের উজ্জ্বল উদাহরণ। (তাফসির আস-সা’দি, আয়াত ৯, সুরা হাশর)।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বার্থপরতা ও সুদভিত্তিক অর্থনীতির বিপরীত এই নীতি। এতে ব্যক্তি তার সম্পদ অন্যকে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ হয়।

ইসারের সুবিধা অসংখ্য। এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা অর্জন করা যায়, ইমানের পরিপূর্ণতা আনে এবং নবী (সা.)-এর অনুসরণ করা হয়। দুনিয়ায় এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং মৃত্যুর পরও তার সুনাম ছড়িয়ে পরে। এর মাধ্যমে লোভ, স্বার্থপরতা এবং হিংসা দূর হয়। (দুরার আস-সানিয়্যাহ, মাউসু’আত আল-আখলাক, পৃ. ৩৭৭, ২০২৩)

অর্থনৈতিকভাবে, ইসার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করে। নবীজি (সা.) বলেন: ‘একজনের খাবার দুজনের জন্য যথেষ্ট, দুজনের চারজনের জন্য।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০৫৯)

এতে বরকত বাড়ে এবং সমাজে দারিদ্র্য দূর হয়। (ইবন হাজার আল-আসকালানি, ফাতহ আল-বারি, ৯/৪৪৫, দার আল-মা’রিফাহ, বৈরুত, ১৩৭৯ হি.)

আরও পড়ুনএক রাতেই তিনি প্রায় ৭০ কোটি টাকা দান করেন২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩‘ইসার’ কত রকম হতে পারে

ইসার বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

প্রথমত, আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অন্যের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া, যা নবীদের গুণ (ইবন উসাইমিন, শারহ বাব আল-ইসার ওয়াল-মুয়াসাহ, আলুকাহ, ২০২১)

দ্বিতীয়ত, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইসার করা।

তৃতীয়ত, ইসলামের ক্ষতি না করে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, যেমন অনাহারে অন্যকে খাওয়ানো।

কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই চায় যা নিজের জন্য চায়।সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩

ইসলামি অর্থনীতিতে ইসারের স্থান অনেক ওপরে। নবীজি (সা.) আশ’আরী গোত্রের প্রশংসা করে বলেন: ‘তারা যখন যুদ্ধে দরিদ্র হয়, তাদের সম্পদ একত্র করে সমানভাবে ভাগ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৪৮৬)

এতে পারস্পরিক সহায়তা বাড়ে।

আনসাররা মুহাজিরদের জন্য সবকিছু ভাগ করে দেওয়া ছাড়াও সাহাবাদের জীবনে ইসারের বহু উদাহরণ রয়েছে। ইয়ারমুক যুদ্ধে জখমি সাহাবিরা নিজের পানি তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও একে অপরকে পানি পান করায় অগ্রাধিকার দেন এবং শেষ পর্যন্ত তৃষ্ণা নিয়েই শহীদ হন। তালহা (রা.) উহুদ যুদ্ধে নবী (সা.)-কে রক্ষা করে হাত হারান। আবু তালহা (রা.) তাঁর প্রিয় জমিও সাদকা করেন। আলী (রা.) হিজরতের রাতে নবীজির বিছানায় শুয়ে প্রাণ বিপন্ন করেন।

নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই চায় যা নিজের জন্য চায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩)

আরও পড়ুনইসলামে বন্ধুত্বের গুরুত্ব কতটা১৭ আগস্ট ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল ল হ র জন য ইসল ম র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান নাম নিয়ে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বদদ্বীনি, কুফরি ও ভ্রান্ততার বিরুদ্ধে উলামায়ে কেরামকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যারা মুসলমান নাম নিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে হেফাজত আমির এ কথা বলেন। জাতীয় উলামা কাউন্সিল বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে ‘জাতীয় উলামা সম্মেলন-২০২৫’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন।

জাতীয় উলামা কাউন্সিলের সভাপতি ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অনেক আলেম-উলামা অংশ নেবেন। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আগামী জাতীয় নির্বাচনে উলামায়ে কেরামের পরস্পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য নয়।’

সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘ইসলামি রাজনীতিতে সব সময় প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়ানো যায় না। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভূমিকা রাখতে হয়। আজ ইসলামি রাজনীতির সোনালি সময় চলছে। আমরা যদি সুযোগ কাজে না লাগাই, তাহলে সামনে বড় ধরনের ভোগান্তি তৈরি হবে।’

মুন্সিগঞ্জের জামি’আ ইসলামিয়া হালীমিয়া মাদ্রাসার প্রধান ও মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনে বাতিলের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়তে লড়তে মরব, কিন্তু বিভক্ত হব না ইনশা আল্লাহ।’ তিনি বলেন, ১৬ নভেম্বরের কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলন শেষ হয়নি, শুরু হয়েছে মাত্র। সরকারকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, পরেরবার আর সুযোগ দেওয়া হবে না।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। যারা কাজ করতে চায়, তাদের বাধা দেব না। আমরা নিজেরা নিজেদের শত্রু হব না, ইনশা আল্লাহ।’

সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমাদ, জাতীয় উলামা কাউন্সিলের মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী, মাওলানা সালাহুদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা মুশতাক আহমদ প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ